বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৮০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। হুমায়ুন কবীর চৌধুরী, বীর প্রতীক দুঃসাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবীর চৌধুরী বর্তমানে কানাডায় বসবাস করেন। ১৯৭১ সালে তিনি যুদ্ধ করেন দুই নম্বর সেক্টরে।
১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সেই বয়ানে তিনি বলেন:
‘১৭ মে আমাকে অপারেশনে পাঠানো হয়। তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়। আমাদের ওপর নির্দেশ ছিল হঠাৎ করে আক্রমণ করো এবং সরে এসো। আমরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে এক দলকে রক্ষণভাগে রাখি। দ্বিতীয় দল মর্টারের সাহায্যে পাকিস্তানি সেনাদের একটি ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়।
‘আমি ছিলাম মর্টার শেলিংয়ে। শোলিং করে আমরা চলে আসি। আসার সময় পাকিস্তানি সেনারা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের ওপর প্রচণ্ড গোলাগুলি করে। আমরা সবাই নিরাপদে ফিরে আসি। পরে খবর পেয়েছিলাম, ওদের (পাকিস্তানি সেনাবাহিনী) ১৫ জনের মতো নিহত হয়েছে।
‘এটাই ছিল আমার প্রথম অপারেশন। ক্যাম্পে আমাদের সব মুক্তিযোদ্ধা দেখি শত্রু খতম বা আক্রমণের এক নেশার মধ্যে আছে। খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম বা কাপড়চোপড়ের অভাব তাদের ছিল, কিন্তু সেদিকে কারও খেয়াল ছিল না। শত্রুর খোঁজ পেলে তারা তৎক্ষণাৎ আক্রমণ করার আনন্দে মেতে উঠত। দেশপ্রেম এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে মৃত্যুভয়ও তাদের টলাতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যে আমাকেও এই নেশায় পেয়ে বসল।
‘কসবা হচ্ছে এমন একটি স্থান, যার ভৌগোলিক গুরুত্ব অপরিসীম। কসবা রেলস্টেশন থেকে ভারতীয় সীমান্ত দেখা যায়। সীমান্তের পাশ দিয়ে ছোট ছোট পাহাড়। মে মাসের ২২/২৩ তারিখে খবর পেলাম, পাকিস্তানি সেনারা দুটি ট্রলি বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র মন্দভাগ রেলস্টেশন থেকে সালদা নদীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রেলট্রলির দুই পাশ দিয়ে এক প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা টহল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
‘খবর পেয়ে দুই সেকশন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি খালি গায়ে এবং লুঙ্গি পরা অবস্থায় পাহাড়ের গাছপালার ফাঁক দিয়ে মন্দভাগ রেলস্টেশনের দিকে অগ্রসর হলাম। খালি গায়ে ছিলাম এই জন্য যে গেঞ্জি বা কোনো কিছু পরে থাকলে তাদের নজর পড়ে যেতে পারে। আমরা সকাল নয়টায় এসে মন্দভাগ গ্রামে অ্যামবুশ পেতে বসে থাকলাম। আধঘণ্টা পরই দেখলাম সেনাবাহিনীর লোকেরা ট্রলির দুই পাশ দিয়ে পাহারা দিতে দিতে যাচ্ছে।
‘ট্রলি দুটি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দিল। আমরা এসএমজি, এলএমজির সাহায্যে শত্রুর ওপর অতর্কিতে গুলি ছুড়তে লাগলাম। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল। বাকি পাকিস্তানি সেনারা ট্রলির ওপাশে পজিশন নিয়ে আমাদের ওপর গুলি ছুড়তে থাকল। আমরা রকেট লঞ্চারের সাহায্যে ট্রলির ওপর আঘাত হানলাম। ট্রলির অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
‘তারপর পাকিস্তানি সেনারা আর্টিলারির সাহায্যে আমাদের ওপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করে তাদের আহত জওয়ানদের নিয়ে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার পর আমি কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যাই। দেখি ভাঙাচোরা অনেক অস্ত্র পড়ে আছে। এর মধ্যে কিছু ভালো অস্ত্র ছিল। এ এক দুঃসাহসিক অভিযান ছিল, যা আমার জীবনে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে।’
হুমায়ুন কবীর চৌধুরী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার্স কোর্সের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকায় আসেন। পরে ভারতে গিয়ে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হুমায়ুন কবীর চৌধুরীকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২২।
হুমায়ুন কবীর চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার লাঙ্গলকোট উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে। তবে বসবাস করতেন ঢাকায়। তাঁর বাবার নাম শফিকুর রহমান চৌধুরী, মা জাহানারা বেগম, স্ত্রী পারভীন কবীর। তাঁদের দুই ছেলে।
সূত্র: হুমায়ুন কবীর চৌধুরী বীর প্রতীক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
‘১৭ মে আমাকে অপারেশনে পাঠানো হয়। তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়। আমাদের ওপর নির্দেশ ছিল হঠাৎ করে আক্রমণ করো এবং সরে এসো। আমরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে এক দলকে রক্ষণভাগে রাখি। দ্বিতীয় দল মর্টারের সাহায্যে পাকিস্তানি সেনাদের একটি ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়।
‘আমি ছিলাম মর্টার শেলিংয়ে। শোলিং করে আমরা চলে আসি। আসার সময় পাকিস্তানি সেনারা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের ওপর প্রচণ্ড গোলাগুলি করে। আমরা সবাই নিরাপদে ফিরে আসি। পরে খবর পেয়েছিলাম, ওদের (পাকিস্তানি সেনাবাহিনী) ১৫ জনের মতো নিহত হয়েছে।
‘এটাই ছিল আমার প্রথম অপারেশন। ক্যাম্পে আমাদের সব মুক্তিযোদ্ধা দেখি শত্রু খতম বা আক্রমণের এক নেশার মধ্যে আছে। খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম বা কাপড়চোপড়ের অভাব তাদের ছিল, কিন্তু সেদিকে কারও খেয়াল ছিল না। শত্রুর খোঁজ পেলে তারা তৎক্ষণাৎ আক্রমণ করার আনন্দে মেতে উঠত। দেশপ্রেম এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে মৃত্যুভয়ও তাদের টলাতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যে আমাকেও এই নেশায় পেয়ে বসল।
‘কসবা হচ্ছে এমন একটি স্থান, যার ভৌগোলিক গুরুত্ব অপরিসীম। কসবা রেলস্টেশন থেকে ভারতীয় সীমান্ত দেখা যায়। সীমান্তের পাশ দিয়ে ছোট ছোট পাহাড়। মে মাসের ২২/২৩ তারিখে খবর পেলাম, পাকিস্তানি সেনারা দুটি ট্রলি বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র মন্দভাগ রেলস্টেশন থেকে সালদা নদীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রেলট্রলির দুই পাশ দিয়ে এক প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা টহল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
‘খবর পেয়ে দুই সেকশন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি খালি গায়ে এবং লুঙ্গি পরা অবস্থায় পাহাড়ের গাছপালার ফাঁক দিয়ে মন্দভাগ রেলস্টেশনের দিকে অগ্রসর হলাম। খালি গায়ে ছিলাম এই জন্য যে গেঞ্জি বা কোনো কিছু পরে থাকলে তাদের নজর পড়ে যেতে পারে। আমরা সকাল নয়টায় এসে মন্দভাগ গ্রামে অ্যামবুশ পেতে বসে থাকলাম। আধঘণ্টা পরই দেখলাম সেনাবাহিনীর লোকেরা ট্রলির দুই পাশ দিয়ে পাহারা দিতে দিতে যাচ্ছে।
‘ট্রলি দুটি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দিল। আমরা এসএমজি, এলএমজির সাহায্যে শত্রুর ওপর অতর্কিতে গুলি ছুড়তে লাগলাম। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল। বাকি পাকিস্তানি সেনারা ট্রলির ওপাশে পজিশন নিয়ে আমাদের ওপর গুলি ছুড়তে থাকল। আমরা রকেট লঞ্চারের সাহায্যে ট্রলির ওপর আঘাত হানলাম। ট্রলির অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
‘তারপর পাকিস্তানি সেনারা আর্টিলারির সাহায্যে আমাদের ওপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করে তাদের আহত জওয়ানদের নিয়ে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার পর আমি কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যাই। দেখি ভাঙাচোরা অনেক অস্ত্র পড়ে আছে। এর মধ্যে কিছু ভালো অস্ত্র ছিল। এ এক দুঃসাহসিক অভিযান ছিল, যা আমার জীবনে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে।’
হুমায়ুন কবীর চৌধুরী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার্স কোর্সের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকায় আসেন। পরে ভারতে গিয়ে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হুমায়ুন কবীর চৌধুরীকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২২।
হুমায়ুন কবীর চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার লাঙ্গলকোট উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে। তবে বসবাস করতেন ঢাকায়। তাঁর বাবার নাম শফিকুর রহমান চৌধুরী, মা জাহানারা বেগম, স্ত্রী পারভীন কবীর। তাঁদের দুই ছেলে।
সূত্র: হুমায়ুন কবীর চৌধুরী বীর প্রতীক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments