পর্যটন-অবহেলায় পড়ে থাকা বিপুল সম্ভাবনা by অভয় প্রকাশ চাকমা
প্রায় সব দেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প বিশেষ অবদান রাখছে। আমাদের দেশে পর্যটন শিল্পের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল। পর্বতশোভিত সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্তি্বক বৈচিত্র্যপূর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটনের জন্য আদর্শ স্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের মিলনমেলায় পরিণত হবে এ অঞ্চল।
জানা গেছে, গত চার বছরে রাঙামাটি পর্যটন করপোরেশন আয় করেছে ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে করপোরেশনের লাভ হয়েছে দেড় কোটি টাকা। এ হিসাবে বছরে লাভ করেছে মাত্র সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। বিনিয়োগ এবং সম্ভাবনার তুলনায় এ আয় খুবই নগণ্য।
পার্বত্যাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। রাস্তা একে তো খানাখন্দে পরিপূর্ণ আর এতই সরু যে, একটি গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে আরেকটি গাড়ির উল্টে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। পরিবহনের ব্যবস্থাপনাও ভালো নয়। দীর্ঘকাল রাউজান বাস মালিক সমিতি রাঙামাটিবাসীদের জিম্মি করে রেখেছে। সমিতি অন্য কোনো ভালো বাস নামতে দেয় না। পুরনো চলাচল অযোগ্য বাস দিয়ে যাত্রী পরিবহন করে আসছে। চট্টগ্রামের অক্সিজেন নামক স্থানে বাস কাউন্টারে বসার কোনো জায়গা নেই, কোনো টয়লেট নেই। তিন পার্বত্য জেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা অত্যন্ত সেকেলে।
কাপ্তাই হ্রদ রাঙামাটি শহরের অন্যতম আকর্ষণ। বিভিন্ন উপজেলার মধ্যেও যোগাযোগের মাধ্যম হ্রদের নদীপথ। এই হ্রদ দূষিত, পলি ও কচুরিপানায় ভরপুর। শহর ও উপজেলা সদরে গড়ে ওঠা অধিকাংশ আবাসিক হোটেল, বাড়ি, ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও লঞ্চের টয়লেটের পয়ঃবর্জ্য হ্রদে ফেলা হয়। দেশের বৃহত্তম পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থাকলেও পার্বত্যাঞ্চলের অধিকাংশ অঞ্চল রয়েছে বিদ্যুৎহীন। অথচ এ বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের কারণে ১৯৬১ সালে অর্ধলক্ষাধিক আদিবাসী পরিবার বাস্তুহারা হয়েছিল। বিদ্যুতায়িত অনেক স্থানেও রয়েছে গড়ে দৈনিক বারো ঘণ্টা লোডশেডিং এবং ভোল্টেজের ওঠানামা ও লো-ভোল্টেজের যন্ত্রণা। প্রতি জেলা-উপজেলায় প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা অসম্ভব।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তনের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অন্তত একটি করে আধুনিক সাফারি পার্ক গড়ে তোলা সম্ভব। প্রাকৃতিকভাবেই এ অঞ্চল বিভিন্ন প্রজাতির বুনো প্রাণী আবাসের উপযোগী। এতে ইকো-ট্যুরিজম সৃষ্টি করাও সহজ হবে। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে। তাই আদিবাসীদের বিলীয়মান সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। আদিবাসীদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখলে দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ হবে এবং পর্যটকদেরও আকর্ষণ বাড়বে।
পর্যটনের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশও অতি প্রয়োজন। প্রতি উপজেলা সদরে পৌর সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ময়লা-আবর্জনামুক্ত পরিচ্ছন্ন শহর গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। রাস্তাঘাট বৃক্ষ ও পুষ্পসজ্জিত করে উন্নত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার রাখার জন্য পৌর আইনের আলোকে বিধি প্রণয়ন করতে হবে। এলাকাবাসীর হাইজিন প্র্যাকটিসে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
নিরাপত্তার অজুহাতে এর আগে পার্বত্য জেলাগুলোকে সেলফোন নেটওয়ার্কের বাইরে রাখা হয়েছিল। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জেলা সদরে সেলফোন চালু হয়। বর্তমানে উপজেলা সদরেও নেটওয়ার্ক চালু হয়েছে। তবে এখনও সবখানে নেটওয়ার্ক দেওয়া হয়নি। অল্প কিছু জায়গা কী কারণে নেটওয়ার্কের বাইরে রাখা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। কাজেই পর্যটনের স্বার্থে সবখানে সেলফোন চালু করা দরকার।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে। রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরের পুরনো চাকমা রাজবাড়ি সংরক্ষণ না করায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চাকমা রাজ্যের এককালের রাজধানী সুখবিলাসও বিলুপ্তপ্রায়। তাছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পশ্চিমে অবস্থিত রাজাপুরের চাকমা রাজবাড়ি ও দীঘি অপদখল এবং বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কাপ্তাই বাঁধের ফলে পানিতে নিমজ্জিত রাঙামাটির চাকমা রাজবাড়িও এখন ধ্বংসপ্রায়। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, যেগুলো অনুসন্ধান করে অবিলম্বে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা দরকার।
রাঙামাটিতে দেশি-বিদেশি পর্যটক এলে চাকমা রাজবাড়ি না দেখে যান না। কিন্তু গত বছরের ১০ নভেম্বর সেই রাজবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চাকমারা অনেক জমি, রাজবাড়িসহ অনেক কিছু হারিয়েছে। চাকমা সংস্কৃতি ও আধুনিক স্থাপত্যের সংমিশ্রণে একটি দর্শনীয় রাজবাড়ি গড়লে শুধু পর্যটন নয়, দেশের জন্যও গৌরব বয়ে আনবে। তবে রাজবাড়ির জমি চারদিকে হ্রদবেষ্টিত হওয়ায় নৌকার মাধ্যমে যাওয়া-আসা করতে হয়। এতে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের বেশ কষ্ট পেতে হয়। চাকমা সংস্কৃতি ও শিল্পকলা সাজিয়ে ব্রিজ নির্মাণ করলে হ্রদবেষ্টিত রাজবাড়িখানা পার্বত্য চট্টগ্রামের সেরা ও অনন্য সুন্দর দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে।
পর্যটনের প্রধান শর্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর সৃষ্ট পাহাড়িদের সহিংস অন্তর্দ্বন্দ্বে অনেক পাহাড়ি খুন হচ্ছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে প্রশাসন নীরব দর্শকের মতো রয়েছে। পাহাড়িদের অন্তর্দ্বন্দ্বে শক্তিশালী মহলের ইন্ধন রয়েছে বলে শোনা যায়। এ কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন কার্যক্রম ও ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পর্যটনের বিকাশ সম্ভব নয়।
অভয় প্রকাশ চাকমা : কলাম লেখক
পার্বত্যাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। রাস্তা একে তো খানাখন্দে পরিপূর্ণ আর এতই সরু যে, একটি গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে আরেকটি গাড়ির উল্টে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। পরিবহনের ব্যবস্থাপনাও ভালো নয়। দীর্ঘকাল রাউজান বাস মালিক সমিতি রাঙামাটিবাসীদের জিম্মি করে রেখেছে। সমিতি অন্য কোনো ভালো বাস নামতে দেয় না। পুরনো চলাচল অযোগ্য বাস দিয়ে যাত্রী পরিবহন করে আসছে। চট্টগ্রামের অক্সিজেন নামক স্থানে বাস কাউন্টারে বসার কোনো জায়গা নেই, কোনো টয়লেট নেই। তিন পার্বত্য জেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা অত্যন্ত সেকেলে।
কাপ্তাই হ্রদ রাঙামাটি শহরের অন্যতম আকর্ষণ। বিভিন্ন উপজেলার মধ্যেও যোগাযোগের মাধ্যম হ্রদের নদীপথ। এই হ্রদ দূষিত, পলি ও কচুরিপানায় ভরপুর। শহর ও উপজেলা সদরে গড়ে ওঠা অধিকাংশ আবাসিক হোটেল, বাড়ি, ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও লঞ্চের টয়লেটের পয়ঃবর্জ্য হ্রদে ফেলা হয়। দেশের বৃহত্তম পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থাকলেও পার্বত্যাঞ্চলের অধিকাংশ অঞ্চল রয়েছে বিদ্যুৎহীন। অথচ এ বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের কারণে ১৯৬১ সালে অর্ধলক্ষাধিক আদিবাসী পরিবার বাস্তুহারা হয়েছিল। বিদ্যুতায়িত অনেক স্থানেও রয়েছে গড়ে দৈনিক বারো ঘণ্টা লোডশেডিং এবং ভোল্টেজের ওঠানামা ও লো-ভোল্টেজের যন্ত্রণা। প্রতি জেলা-উপজেলায় প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা অসম্ভব।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তনের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অন্তত একটি করে আধুনিক সাফারি পার্ক গড়ে তোলা সম্ভব। প্রাকৃতিকভাবেই এ অঞ্চল বিভিন্ন প্রজাতির বুনো প্রাণী আবাসের উপযোগী। এতে ইকো-ট্যুরিজম সৃষ্টি করাও সহজ হবে। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে। তাই আদিবাসীদের বিলীয়মান সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। আদিবাসীদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখলে দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ হবে এবং পর্যটকদেরও আকর্ষণ বাড়বে।
পর্যটনের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশও অতি প্রয়োজন। প্রতি উপজেলা সদরে পৌর সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ময়লা-আবর্জনামুক্ত পরিচ্ছন্ন শহর গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। রাস্তাঘাট বৃক্ষ ও পুষ্পসজ্জিত করে উন্নত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার রাখার জন্য পৌর আইনের আলোকে বিধি প্রণয়ন করতে হবে। এলাকাবাসীর হাইজিন প্র্যাকটিসে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
নিরাপত্তার অজুহাতে এর আগে পার্বত্য জেলাগুলোকে সেলফোন নেটওয়ার্কের বাইরে রাখা হয়েছিল। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জেলা সদরে সেলফোন চালু হয়। বর্তমানে উপজেলা সদরেও নেটওয়ার্ক চালু হয়েছে। তবে এখনও সবখানে নেটওয়ার্ক দেওয়া হয়নি। অল্প কিছু জায়গা কী কারণে নেটওয়ার্কের বাইরে রাখা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। কাজেই পর্যটনের স্বার্থে সবখানে সেলফোন চালু করা দরকার।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে। রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরের পুরনো চাকমা রাজবাড়ি সংরক্ষণ না করায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চাকমা রাজ্যের এককালের রাজধানী সুখবিলাসও বিলুপ্তপ্রায়। তাছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পশ্চিমে অবস্থিত রাজাপুরের চাকমা রাজবাড়ি ও দীঘি অপদখল এবং বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কাপ্তাই বাঁধের ফলে পানিতে নিমজ্জিত রাঙামাটির চাকমা রাজবাড়িও এখন ধ্বংসপ্রায়। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, যেগুলো অনুসন্ধান করে অবিলম্বে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা দরকার।
রাঙামাটিতে দেশি-বিদেশি পর্যটক এলে চাকমা রাজবাড়ি না দেখে যান না। কিন্তু গত বছরের ১০ নভেম্বর সেই রাজবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চাকমারা অনেক জমি, রাজবাড়িসহ অনেক কিছু হারিয়েছে। চাকমা সংস্কৃতি ও আধুনিক স্থাপত্যের সংমিশ্রণে একটি দর্শনীয় রাজবাড়ি গড়লে শুধু পর্যটন নয়, দেশের জন্যও গৌরব বয়ে আনবে। তবে রাজবাড়ির জমি চারদিকে হ্রদবেষ্টিত হওয়ায় নৌকার মাধ্যমে যাওয়া-আসা করতে হয়। এতে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের বেশ কষ্ট পেতে হয়। চাকমা সংস্কৃতি ও শিল্পকলা সাজিয়ে ব্রিজ নির্মাণ করলে হ্রদবেষ্টিত রাজবাড়িখানা পার্বত্য চট্টগ্রামের সেরা ও অনন্য সুন্দর দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে।
পর্যটনের প্রধান শর্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর সৃষ্ট পাহাড়িদের সহিংস অন্তর্দ্বন্দ্বে অনেক পাহাড়ি খুন হচ্ছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে প্রশাসন নীরব দর্শকের মতো রয়েছে। পাহাড়িদের অন্তর্দ্বন্দ্বে শক্তিশালী মহলের ইন্ধন রয়েছে বলে শোনা যায়। এ কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন কার্যক্রম ও ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পর্যটনের বিকাশ সম্ভব নয়।
অভয় প্রকাশ চাকমা : কলাম লেখক
No comments