সুশাসন-সংসদ সদস্য আচরণ আইন প্রণয়ন জরুরি by বদিউল আলম মজুমদার
একটি সংবাদপত্রের সাম্প্রতিক শিরোনাম অনুযায়ী, 'শতাধিক এমপি সরকারের মাথাব্যথার কারণ' (আমাদের সময়, ২৩ জুলাই ২০১১)। গণমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে অনেক সংসদ সদস্যের অপকর্মের কাহিনীই এখন জানা যাচ্ছে। অনেকেই আইন-কানুন উপেক্ষা করে সংসদ সদস্য পদ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়িক ফায়দা লুটছেন।
কয়েকজন মিথ্যা হলফনামা ব্যবহার করে আবাসিক এলাকায় পল্গটের আবেদন করেছেন, যা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। আবার অনেকে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি, যা সংসদে গৃহীত একটি আইন উপেক্ষা করে ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে নিজেদের স্বার্থ বিবেচিত হয় এমন সব সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়েছেন। কেউ কেউ দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য, দখলদারিত্ব ইত্যাদিতে লিপ্ত। অধিকাংশ সংসদ সদস্যই সংবিধানকে পদদলিত ও উচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষা করে 'স্থানীয় উন্নয়ন' কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন। কারও কারও বিরুদ্ধে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে জড়িত হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এমনকি দু'একজনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগও উঠেছে।
এটি আজ সুস্পষ্ট যে, আমাদের সংসদ সদস্যের অনেকেই এখন সংবিধান, আইনের বিধিবিধান, এমনকি উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছেন। বস্তুত আমাদের আইন প্রণেতাদের অনেকেই বর্তমানে আইন ভঙ্গকারীতে পরিণত হয়েছেন। এ অবস্থা আইনের শাসনের শুধু পরিপন্থীই নয়, এটি একটি চরম অরাজক পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত বহন করে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সংসদ নেতারা যেন চোখে প্যাঁচ লাগিয়েছেন এবং কানে তুলা দিয়েছেন_ তারা 'সি নো ইভিল, হিয়ার নো ইভিল অ্যান্ড স্পিক নো ইভিল' বা নিজেদের লোকদের খারাপ কিছু দেখব না, খারাপ কিছু শুনব না এবং খারাপ কিছু বলব না নীতি অবলম্বন করেছেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ ধরনের নির্লিপ্ততা সমস্যার সমাধান তো করবেই না বরং সমস্যাকে আরও প্রকট ও ব্যাপক করবে, যার ফলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র তার কার্যকারিতাই হারিয়ে ফেলতে পারে।
তবে আশার কথা যে, এ অরাজক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে গত ১৪ জানুয়ারি ২০১১ সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী 'সংসদ সদস্য আচরণ আইন' শিরোনামের একটি বেসরকারি বিল সংসদে উত্থাপন করেছেন। আরও আশার কথা যে, সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি বিলটি সংশোধিত আকারে আইনে পরিণত করার লক্ষ্যে গত ২৪ মার্চ সুপারিশ করেছেন।
প্রসঙ্গত, কমিটির সুপারিশটি সর্বসম্মত ছিল না। কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, যেহেতু সংসদ সদস্যদের জন্য একটি কার্যপ্রণালি বিধি রয়েছে, তাই সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক, ইকবালুর রহিম, সৈয়দা আশিফা আশরাফী পাপিয়া তাদের আচরণ নির্ধারণকল্পে কোনো আইনের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। আ স ম ফিরোজ প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের প্রধানদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্য সৃষ্টি হলে প্রস্তাবিত বিলটি পাসের সুপারিশ করেন। পক্ষান্তরে আবদুুল হাই, জুনায়েদ আহ্মেদ পলক ও হাফিজ আহমেদ মজুমদার বিলটির পক্ষে মতামত প্রদান করেন।
সংশোধিত বিলে ১৪টি ধারা রয়েছে। প্রথম তিনটিতে শিরোনাম, সংজ্ঞা ও কিছু নীতিকথা রয়েছে। ধারা ৪-এ বলা হয়েছে যে, সংসদ সদস্যগণ কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন এবং দায়বদ্ধতার সঙ্গে জনগণের প্রতিনিধিত্ব, আইন প্রণয়ন এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই তাদের মূল দায়িত্ব। তারা সর্বক্ষেত্রে আইনকে সমুন্নত রাখবেন এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়াও দায়িত্ব পালনে তারা ব্যক্তিগত ও আর্থিক লাভের বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন না।
সংসদ সদস্যরা দায়িত্ব পালনকালে তাদের দায়িত্বের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বার্থ সম্পর্কিত থাকলে তা প্রকাশ করবেন। তারা স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন, জনগণের কাছে জবাবদিহি করবেন এবং যে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকবেন। তারা পরিবার ও স্বজনদের কোনো ধরনের আর্থিক বা বস্তুগত সুবিধা দেওয়ার পরিবর্তে শুধু জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
সংসদ সদস্যরা বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে এমন কোনো আর্থিক বা অন্য কোনো বাধ্যবাধকতায় সম্পৃক্ত হবেন না যা তাদের সংসদীয় দায়িত্ব পালনে প্রভাবিত করতে পারে। এ ছাড়াও তারা দায়িত্ব পালনকালে নিয়োগ, চুক্তি সম্পাদন বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে পুরস্কার প্রদান এবং অন্য কোনো সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সুপারিশসহ যে কোনো ধরনের কাজে মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেবেন।
বর্তমানে আমাদের সংসদ সদস্যের অনেকেই তাদের সংসদ সদস্যপদ ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন এবং শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানিসহ আরও অনেকভাবে লাভবান হচ্ছেন। আশা করি, প্রস্তাবিত আইনটি পাস হওয়ার মাধ্যমে এসবের অবসান ঘটবে। প্রসঙ্গত, বর্তমানে সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ দেওয়া হয় নির্বাহী আদেশে, যা অবৈধ। কারণ সংবিধানের ৬৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যদের পারিশ্রমিক, ভাতা ও বিশেষ অধিকার আইন দ্বারা নির্ধারিত হওয়া বাধ্যতামূলক। এ ছাড়াও আশা করি, এর মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের তথাকথিত স্থানীয় উন্নয়ন কাজে জড়িত হওয়া থেকে, যা সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের এবং উচ্চ আদালতের রায়ের [১৬ বিএলটি (এইচসিডি) ২০০৮] পরিপন্থী_ বিরত রাখা যাবে।
প্রস্তাবিত আইনের ধারা ৫-এ বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যগণ নিজের বা অন্যের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে অবৈধ ও অসৎ পথ অবলম্বন করবেন না। তারা নিজের এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বার্থগত দ্বন্দ্ব, আয় ও সম্পদের উৎস সংক্রান্ত তথ্য সংসদ কর্তৃক নির্ধারিত ছকে সংসদ শুরুর প্রথম অধিবেশনের মধ্যে প্রকাশ করবেন ও প্রতি বছর নবায়ন করবেন এবং নৈতিকতা কমিটি তা যাচাই-বাছাই করে জনসমক্ষে প্রকাশ করবে। কার্যপ্রণালি বিধি অনুসারে প্রকাশ ব্যতিরেকে, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে তদবির করবেন না। সংসদ সদস্যরা কার্যক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আর্থিক স্বার্থ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে কোনো স্বার্থগত দ্বন্দ্ব প্রকাশ করবেন এবং তা নিরসনে তারা ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধ থাকবেন। আমরা মনে করি, মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় আয়কর বিবরণী ও আদালতের নির্দেশনাক্রমে হলফনামার মাধ্যমে প্রদত্ত আট তথ্যের মধ্যে প্রথম সাতটি নবায়ন করে প্রত্যেক সংসদ সদস্যের প্রতি বছর জনসমক্ষে সরাসরি প্রকাশ করা উচিত। এসব তথ্য নৈতিকতা কমিটি কর্তৃক যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমরা মনে করি না।
সংসদ সদস্যরা সরকারি বা বেসরকারি খাতে কোনো ধরনের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, জ্যেষ্ঠতা বা অন্য কোনো সিদ্ধান্তে সুবিধা পেতে ক্ষমতার অপব্যবহার, সুপারিশ বা হস্তক্ষেপ করবেন না। তারা সরকারি ক্রয়-বিক্রয়, প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সরকারি নীতিনির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত বা দলীয় প্রভাব বা স্বার্থ অর্জন থেকে বিরত থাকবেন। তারা বিচার বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানে নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠার পথে কোনো প্রকার অন্তরায় সৃষ্টি করবেন না। তারা মানবাধিকার এবং নারী, সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীসহ সব সুবিধাবঞ্চিত জনগণের উন্নয়নে ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। আশা করি, এর মাধ্যমে তদবির সংস্কৃতির অবসান ঘটবে এবং 'গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে'র ১২ ধারা লঙ্ঘন করে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত ব্যক্তিদের সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকা বন্ধ হবে।
বিলের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালনে সংসদ সদস্যগণ জাতীয় স্বার্থকে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থের ঊধর্ে্ব প্রাধান্য দেবেন। তারা আর্থিক প্রতিদান বা অন্য কোনো ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে সংসদ বা এর কোনো কমিটিতে কোনো বিষয় উত্থাপন, কোনো বিল বা প্রস্তাবের পক্ষে ভোটদান অথবা প্রশ্ন উত্থাপন করবেন না। প্রস্তাবিত আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী, স্বার্থগত দ্বন্দ্বের অথবা দায়িত্ব পালনে প্রভাবিত করতে পারে এমন ধরনের কোনো উপঢৌকন তারা গ্রহণ করবেন না। ৮ ধারা অনুযায়ী, তারা সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্ত বিশেষ অধিকারসমূহ কোনো অবস্থাতেই আর্থিক উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবেন না। ৯ ধারা অনুযায়ী, সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কোনো গোপনীয় তথ্য অবগত হলে তা ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করতে পারবেন না। ১০ ধারা অনুযায়ী, সংসদে বক্তব্য উপস্থাপন ও সার্বিক আচরণে গণতান্ত্রিক, মুক্তবুদ্ধি, সহনশীল, বস্তুনিষ্ঠ, চিন্তাশীল ও যুক্তিপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করবেন। এ ছাড়াও তারা জ্ঞাতসারে বিবৃতি ও বক্তব্যের মাধ্যমে সংসদ বা জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করবেন না। আশা করি, এর মাধ্যমে গাড়ি-বাণিজ্যের অবসান ঘটবে এবং বক্তব্য প্রদান ও আচরণে সংসদ সদস্যরা অধিকতর দায়িত্বশীল হতে বাধ্য হবেন।
প্রস্তাবিত আইনে ১২, ১৩ ও ১৪ ধারায় নৈতিকতা কমিটির মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের অসদাচরণের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। ১২ ও ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত আইনটি বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে সংসদে স্পিকারের নেতৃত্বে অনধিক ৯ সদস্যবিশিষ্ট 'নৈতিকতা কমিটি' গঠন করা হবে। যে কোনো ব্যক্তি কমিটির কাছে যে কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন বা সদস্য আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে তা কমিটির গোচরে আনতে পারবেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগও নৈতিকতা কমিটি আমলে নিতে পারবে। কমিটি স্বপ্রণোদিত হয়েও তা করতে পারবে। কমিটি সংশ্লিষ্ট সদস্যকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে হয় বিষয়টি নিজেরাই নিষ্পন্ন করবেন অথবা অভিযুক্ত সংসদ সদস্যের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য না হলে সুনির্দিষ্ট শাস্তির সুপারিশসহ বিষয়টি সংসদে উপস্থাপন করবে। কমিটি প্রতি মাসে অন্তত একবার বৈঠকে মিলিত হবে।
প্রস্তাবিত আইনের ১৪ ধারা অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ পর্যন্ত নৈতিকতা কমিটির কার্যক্রম বলবৎ থাকবে। প্রতি বছর কমিটি তার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করবে। স্পিকার প্রতিবেদনটি সম্পর্কে সংসদে আলোচনা ও জনসমক্ষে প্রকাশের ব্যবস্থা করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে সংসদ আইনটি সংশোধন করতে পারবে।
উলেল্গখ্য, সংসদীয় কমিটি তার সুপারিশে সাবের হোসেন চৌধুরী কর্তৃক সংসদে উত্থাপিত মূল বিলে অন্তর্ভুক্ত পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতা সম্পর্কিত ধারাটি বাদ দেয়। ওই ধারায় বলা হয়েছে, 'সংসদের পবিত্রতা, সম্মান ও ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখতে সংসদ সদস্যগণ পরমতসহিষুষ্ণ এবং ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইবেন, সংসদ অধিবেশনে সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী আচরণ করিবেন এবং সংসদে আলোচনা বা বক্তব্য উপস্থাপনে ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসামূলক বক্তব্য, অযাচিত সমালোচনা বা স্তুতি, কটু বা অশ্লীল ভাষা এবং অসৌজন্যমূলক অঙ্গভঙ্গি সচেতনভাবে পরিহার করিবেন।' এ ধারা বাদ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আমরা খুঁজে পাই না। সংসদ সদস্যদের আত্মসম্মানবোধ সমুন্নত রাখার এবং সংসদে বিতর্কের মান উন্নয়নের লক্ষ্যে আমরা এ ধারাটি পুনঃসংযোজনের সুপারিশ করছি।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, অসদাচরণের অভিযোগে আমাদের সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। ফলে অনেক সংসদ সদস্যই অন্যায় ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়েও পার পেয়ে যান। সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার যার এক জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটির তদন্তে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও, নবম জাতীয় সংসদ তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। দাবি করা হয় যে, সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের অধীনে সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি সম্পর্কিত কোনো আইন এ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি বলেই তা করা সম্ভব হয়নি, যা একটি খোঁড়া যুক্তি বলে আমরা মনে করি। কারণ সংসদ ইচ্ছা করলেই দুর্নীতির মাধ্যমে সংসদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত। তাই প্রস্তাবিত সংসদ সদস্য আচরণ আইন, ২০১১ ভবিষ্যতে কার্যকর করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি সম্পর্কিত একটি আইন প্রণয়ন করা আবশ্যক। এ ছাড়া সংসদ সদস্যদের লাগামহীন আচরণের প্রতিকারের স্বার্থে তাদের 'রি-কল' বা প্রত্যাহারের বিধানের কথাও বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১১
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
এটি আজ সুস্পষ্ট যে, আমাদের সংসদ সদস্যের অনেকেই এখন সংবিধান, আইনের বিধিবিধান, এমনকি উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছেন। বস্তুত আমাদের আইন প্রণেতাদের অনেকেই বর্তমানে আইন ভঙ্গকারীতে পরিণত হয়েছেন। এ অবস্থা আইনের শাসনের শুধু পরিপন্থীই নয়, এটি একটি চরম অরাজক পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত বহন করে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সংসদ নেতারা যেন চোখে প্যাঁচ লাগিয়েছেন এবং কানে তুলা দিয়েছেন_ তারা 'সি নো ইভিল, হিয়ার নো ইভিল অ্যান্ড স্পিক নো ইভিল' বা নিজেদের লোকদের খারাপ কিছু দেখব না, খারাপ কিছু শুনব না এবং খারাপ কিছু বলব না নীতি অবলম্বন করেছেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ ধরনের নির্লিপ্ততা সমস্যার সমাধান তো করবেই না বরং সমস্যাকে আরও প্রকট ও ব্যাপক করবে, যার ফলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র তার কার্যকারিতাই হারিয়ে ফেলতে পারে।
তবে আশার কথা যে, এ অরাজক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে গত ১৪ জানুয়ারি ২০১১ সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী 'সংসদ সদস্য আচরণ আইন' শিরোনামের একটি বেসরকারি বিল সংসদে উত্থাপন করেছেন। আরও আশার কথা যে, সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি বিলটি সংশোধিত আকারে আইনে পরিণত করার লক্ষ্যে গত ২৪ মার্চ সুপারিশ করেছেন।
প্রসঙ্গত, কমিটির সুপারিশটি সর্বসম্মত ছিল না। কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, যেহেতু সংসদ সদস্যদের জন্য একটি কার্যপ্রণালি বিধি রয়েছে, তাই সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক, ইকবালুর রহিম, সৈয়দা আশিফা আশরাফী পাপিয়া তাদের আচরণ নির্ধারণকল্পে কোনো আইনের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। আ স ম ফিরোজ প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের প্রধানদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্য সৃষ্টি হলে প্রস্তাবিত বিলটি পাসের সুপারিশ করেন। পক্ষান্তরে আবদুুল হাই, জুনায়েদ আহ্মেদ পলক ও হাফিজ আহমেদ মজুমদার বিলটির পক্ষে মতামত প্রদান করেন।
সংশোধিত বিলে ১৪টি ধারা রয়েছে। প্রথম তিনটিতে শিরোনাম, সংজ্ঞা ও কিছু নীতিকথা রয়েছে। ধারা ৪-এ বলা হয়েছে যে, সংসদ সদস্যগণ কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন এবং দায়বদ্ধতার সঙ্গে জনগণের প্রতিনিধিত্ব, আইন প্রণয়ন এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই তাদের মূল দায়িত্ব। তারা সর্বক্ষেত্রে আইনকে সমুন্নত রাখবেন এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়াও দায়িত্ব পালনে তারা ব্যক্তিগত ও আর্থিক লাভের বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন না।
সংসদ সদস্যরা দায়িত্ব পালনকালে তাদের দায়িত্বের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বার্থ সম্পর্কিত থাকলে তা প্রকাশ করবেন। তারা স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন, জনগণের কাছে জবাবদিহি করবেন এবং যে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকবেন। তারা পরিবার ও স্বজনদের কোনো ধরনের আর্থিক বা বস্তুগত সুবিধা দেওয়ার পরিবর্তে শুধু জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
সংসদ সদস্যরা বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে এমন কোনো আর্থিক বা অন্য কোনো বাধ্যবাধকতায় সম্পৃক্ত হবেন না যা তাদের সংসদীয় দায়িত্ব পালনে প্রভাবিত করতে পারে। এ ছাড়াও তারা দায়িত্ব পালনকালে নিয়োগ, চুক্তি সম্পাদন বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে পুরস্কার প্রদান এবং অন্য কোনো সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সুপারিশসহ যে কোনো ধরনের কাজে মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেবেন।
বর্তমানে আমাদের সংসদ সদস্যের অনেকেই তাদের সংসদ সদস্যপদ ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন এবং শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানিসহ আরও অনেকভাবে লাভবান হচ্ছেন। আশা করি, প্রস্তাবিত আইনটি পাস হওয়ার মাধ্যমে এসবের অবসান ঘটবে। প্রসঙ্গত, বর্তমানে সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ দেওয়া হয় নির্বাহী আদেশে, যা অবৈধ। কারণ সংবিধানের ৬৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যদের পারিশ্রমিক, ভাতা ও বিশেষ অধিকার আইন দ্বারা নির্ধারিত হওয়া বাধ্যতামূলক। এ ছাড়াও আশা করি, এর মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের তথাকথিত স্থানীয় উন্নয়ন কাজে জড়িত হওয়া থেকে, যা সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের এবং উচ্চ আদালতের রায়ের [১৬ বিএলটি (এইচসিডি) ২০০৮] পরিপন্থী_ বিরত রাখা যাবে।
প্রস্তাবিত আইনের ধারা ৫-এ বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যগণ নিজের বা অন্যের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে অবৈধ ও অসৎ পথ অবলম্বন করবেন না। তারা নিজের এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বার্থগত দ্বন্দ্ব, আয় ও সম্পদের উৎস সংক্রান্ত তথ্য সংসদ কর্তৃক নির্ধারিত ছকে সংসদ শুরুর প্রথম অধিবেশনের মধ্যে প্রকাশ করবেন ও প্রতি বছর নবায়ন করবেন এবং নৈতিকতা কমিটি তা যাচাই-বাছাই করে জনসমক্ষে প্রকাশ করবে। কার্যপ্রণালি বিধি অনুসারে প্রকাশ ব্যতিরেকে, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে তদবির করবেন না। সংসদ সদস্যরা কার্যক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আর্থিক স্বার্থ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে কোনো স্বার্থগত দ্বন্দ্ব প্রকাশ করবেন এবং তা নিরসনে তারা ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধ থাকবেন। আমরা মনে করি, মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় আয়কর বিবরণী ও আদালতের নির্দেশনাক্রমে হলফনামার মাধ্যমে প্রদত্ত আট তথ্যের মধ্যে প্রথম সাতটি নবায়ন করে প্রত্যেক সংসদ সদস্যের প্রতি বছর জনসমক্ষে সরাসরি প্রকাশ করা উচিত। এসব তথ্য নৈতিকতা কমিটি কর্তৃক যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমরা মনে করি না।
সংসদ সদস্যরা সরকারি বা বেসরকারি খাতে কোনো ধরনের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, জ্যেষ্ঠতা বা অন্য কোনো সিদ্ধান্তে সুবিধা পেতে ক্ষমতার অপব্যবহার, সুপারিশ বা হস্তক্ষেপ করবেন না। তারা সরকারি ক্রয়-বিক্রয়, প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সরকারি নীতিনির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত বা দলীয় প্রভাব বা স্বার্থ অর্জন থেকে বিরত থাকবেন। তারা বিচার বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানে নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠার পথে কোনো প্রকার অন্তরায় সৃষ্টি করবেন না। তারা মানবাধিকার এবং নারী, সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীসহ সব সুবিধাবঞ্চিত জনগণের উন্নয়নে ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। আশা করি, এর মাধ্যমে তদবির সংস্কৃতির অবসান ঘটবে এবং 'গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে'র ১২ ধারা লঙ্ঘন করে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত ব্যক্তিদের সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকা বন্ধ হবে।
বিলের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালনে সংসদ সদস্যগণ জাতীয় স্বার্থকে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থের ঊধর্ে্ব প্রাধান্য দেবেন। তারা আর্থিক প্রতিদান বা অন্য কোনো ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে সংসদ বা এর কোনো কমিটিতে কোনো বিষয় উত্থাপন, কোনো বিল বা প্রস্তাবের পক্ষে ভোটদান অথবা প্রশ্ন উত্থাপন করবেন না। প্রস্তাবিত আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী, স্বার্থগত দ্বন্দ্বের অথবা দায়িত্ব পালনে প্রভাবিত করতে পারে এমন ধরনের কোনো উপঢৌকন তারা গ্রহণ করবেন না। ৮ ধারা অনুযায়ী, তারা সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্ত বিশেষ অধিকারসমূহ কোনো অবস্থাতেই আর্থিক উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবেন না। ৯ ধারা অনুযায়ী, সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কোনো গোপনীয় তথ্য অবগত হলে তা ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করতে পারবেন না। ১০ ধারা অনুযায়ী, সংসদে বক্তব্য উপস্থাপন ও সার্বিক আচরণে গণতান্ত্রিক, মুক্তবুদ্ধি, সহনশীল, বস্তুনিষ্ঠ, চিন্তাশীল ও যুক্তিপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করবেন। এ ছাড়াও তারা জ্ঞাতসারে বিবৃতি ও বক্তব্যের মাধ্যমে সংসদ বা জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করবেন না। আশা করি, এর মাধ্যমে গাড়ি-বাণিজ্যের অবসান ঘটবে এবং বক্তব্য প্রদান ও আচরণে সংসদ সদস্যরা অধিকতর দায়িত্বশীল হতে বাধ্য হবেন।
প্রস্তাবিত আইনে ১২, ১৩ ও ১৪ ধারায় নৈতিকতা কমিটির মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের অসদাচরণের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। ১২ ও ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত আইনটি বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে সংসদে স্পিকারের নেতৃত্বে অনধিক ৯ সদস্যবিশিষ্ট 'নৈতিকতা কমিটি' গঠন করা হবে। যে কোনো ব্যক্তি কমিটির কাছে যে কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন বা সদস্য আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে তা কমিটির গোচরে আনতে পারবেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগও নৈতিকতা কমিটি আমলে নিতে পারবে। কমিটি স্বপ্রণোদিত হয়েও তা করতে পারবে। কমিটি সংশ্লিষ্ট সদস্যকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে হয় বিষয়টি নিজেরাই নিষ্পন্ন করবেন অথবা অভিযুক্ত সংসদ সদস্যের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য না হলে সুনির্দিষ্ট শাস্তির সুপারিশসহ বিষয়টি সংসদে উপস্থাপন করবে। কমিটি প্রতি মাসে অন্তত একবার বৈঠকে মিলিত হবে।
প্রস্তাবিত আইনের ১৪ ধারা অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ পর্যন্ত নৈতিকতা কমিটির কার্যক্রম বলবৎ থাকবে। প্রতি বছর কমিটি তার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করবে। স্পিকার প্রতিবেদনটি সম্পর্কে সংসদে আলোচনা ও জনসমক্ষে প্রকাশের ব্যবস্থা করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে সংসদ আইনটি সংশোধন করতে পারবে।
উলেল্গখ্য, সংসদীয় কমিটি তার সুপারিশে সাবের হোসেন চৌধুরী কর্তৃক সংসদে উত্থাপিত মূল বিলে অন্তর্ভুক্ত পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতা সম্পর্কিত ধারাটি বাদ দেয়। ওই ধারায় বলা হয়েছে, 'সংসদের পবিত্রতা, সম্মান ও ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখতে সংসদ সদস্যগণ পরমতসহিষুষ্ণ এবং ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইবেন, সংসদ অধিবেশনে সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী আচরণ করিবেন এবং সংসদে আলোচনা বা বক্তব্য উপস্থাপনে ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসামূলক বক্তব্য, অযাচিত সমালোচনা বা স্তুতি, কটু বা অশ্লীল ভাষা এবং অসৌজন্যমূলক অঙ্গভঙ্গি সচেতনভাবে পরিহার করিবেন।' এ ধারা বাদ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আমরা খুঁজে পাই না। সংসদ সদস্যদের আত্মসম্মানবোধ সমুন্নত রাখার এবং সংসদে বিতর্কের মান উন্নয়নের লক্ষ্যে আমরা এ ধারাটি পুনঃসংযোজনের সুপারিশ করছি।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, অসদাচরণের অভিযোগে আমাদের সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। ফলে অনেক সংসদ সদস্যই অন্যায় ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়েও পার পেয়ে যান। সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার যার এক জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটির তদন্তে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও, নবম জাতীয় সংসদ তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। দাবি করা হয় যে, সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের অধীনে সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি সম্পর্কিত কোনো আইন এ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি বলেই তা করা সম্ভব হয়নি, যা একটি খোঁড়া যুক্তি বলে আমরা মনে করি। কারণ সংসদ ইচ্ছা করলেই দুর্নীতির মাধ্যমে সংসদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত। তাই প্রস্তাবিত সংসদ সদস্য আচরণ আইন, ২০১১ ভবিষ্যতে কার্যকর করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি সম্পর্কিত একটি আইন প্রণয়ন করা আবশ্যক। এ ছাড়া সংসদ সদস্যদের লাগামহীন আচরণের প্রতিকারের স্বার্থে তাদের 'রি-কল' বা প্রত্যাহারের বিধানের কথাও বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১১
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
No comments