বিমান-‘রেভিনিউ কম কিন্তু খরচ বেশি’ by এ কে এম জাকারিয়া
বাংলাদেশ বিমান পরপর দুই বছর লাভ করার পর দুই বছর ধরে আবার লোকসান দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘রেভিনিউ কম কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় লোকসান হয়েছে’ (প্রথম আলো, ১০ জানুয়ারি, ২০১১)। ব্যাখ্যা বটে! কম আয় ও বেশি ব্যয় কখন হয়? অদক্ষতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে।
আসলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিষয়টি ঘুরিয়ে বলেছেন। তাঁর বলা উচিত ছিল, আগের দুই বছর প্রতিষ্ঠানটি ভালোভাবে পরিচালিত হয়েছে, তাই লাভ হয়েছে। এর পরের দুই বছর তা হয়নি বলে লোকসান হয়েছে। এভাবে বিষয়টি খুলে বললে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর চাকরি থাকার কথা নয়। তাই তিনি ‘রেভিনিউ কম’ আর ‘বেশি খরচের’ দোহাই দিয়েছেন। কিন্তু আসল ব্যাপারটি যে লুকানো যায়নি, তা তিনি বুঝেছেন কি না, কে জানে!
তবে বিমানের এই লোকসানের দায় শুধু এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ বা এর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা হবে অন্যায়। সরকার বিমানকে কীভাবে চালাতে চায়, সেটাই বড় কথা। বিমান লাভ করেছিল ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে। এই দুই বছরে লাভ হয়েছিল ২১ কোটি টাকার বেশি। এর পরের এক অর্থবছরেই (২০০৯-১০) লোকসান হয়েছে ৮০ কোটি টাকারও বেশি। দুই বছরের লাভের প্রায় চার গুণ এক বছরেই খতম। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের এর আগের তিন বছরে বিমান লোকসান দিয়েছে ৯১৭ কোটি টাকা। লাভের বছর দুটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। বিমানকে সে সময় কোম্পানি করা হয়েছে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার জন্য, যার ফল পাওয়া গিয়েছিল পরের দুই বছর। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার আগের অবস্থায়। লোকসানের দায়টা সেদিক থেকে দেখলে সরকারেরই।
একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে চলে, কোম্পানি গঠনের পরও বাংলাদেশ বিমান সেভাবে চলছে না। বিমানের ব্যবস্থাপনাও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। একটি বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাতে যেমন ব্যবসায় অভিজ্ঞ একজন প্রধান নির্বাহীর প্রয়োজন হয়, বিমানের জন্যও প্রয়োজন আকাশ পরিবহন ব্যবসায় অভিজ্ঞ লোকজনের। বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক এয়ারলাইনসগুলো সেভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সে ধরনের পরিকল্পনাই নেওয়া হয়েছিল। তখন এমনও ভাবা হয়েছিল যে দেশে যদি এ ধরনের অভিজ্ঞ কাউকে পাওয়া না যায়, প্রয়োজনে দেশের বাইরে থেকে আকাশ পরিবহন ব্যবসায় অভিজ্ঞ কাউকে প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। সে ধরনের কিছু বর্তমান সরকারের মাথায় আছে বলে মনে হয় না। বিমান আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। ‘মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার পুরোনো ধারায় ফিরে যায় বিমানের ব্যবস্থাপনা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনাহীন যাত্রা, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ—সবই পুনর্বহাল হয়েছে’ (প্রথম আলো, ১০ জানুয়ারি, ২০১১)। এখন বিমান আবার লোকসান দিতে শুরু করেছে। এভাবে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় চলতে থাকলে বছর বছর লোকসান আরও বাড়তে থাকবে।
কোনো দেশের বাণিজ্যিক এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে সে দেশের সামরিক বিমানবাহিনীর কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। দীর্ঘ সামরিক শাসন আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামরিকায়নের যে সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে, বাংলাদেশ বিমান তার বড় শিকার। বাংলাদেশ বিমান মানেই এর শীর্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাবেন বিমানবাহিনীর কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা! বেসামরিক বাণিজ্যিক এয়ারলাইনস পরিচালনা একটি বিশুদ্ধ ব্যবসা। বিমানবাহিনীর একজন দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তার সমরজ্ঞান এ ক্ষেত্রে কাজে লাগার কথা নয়। ব্যবসায় প্রশাসনে পড়াশোনা করা বা বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জনকারী একজন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কাজটি যেমন বুঝবেন, একজন বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তেমনটি বুঝবেন—এমন আশা করা বোকামি হবে। দুজন অভিজ্ঞতা অর্জন করেন দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ বিমানের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এবং বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান দুজনই বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। পরিচালক হিসেবে আছেন আরও দুজন সামরিক কর্মকতা। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পরিচালিত ১৬টি প্রতিষ্ঠানের একটি হচ্ছে র্যাডিসন ওয়াটার গার্ডেন হোটেল। সেনা হোটেল ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (এসএইচডিএল) মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানটি কোনো অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নয়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হোটেল ব্যবসার আন্তর্জাতিক চেইন কার্লটন হোটেল ওয়ার্ল্ডওয়াইডের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের পাঁচতারা হোটেলের মধ্যে সবচেয়ে ব্যবসাসফল হিসেবে বিবেচিত। ব্যবসা ব্যবসাই।
কীভাবে চলছে বাংলাদেশ বিমান? দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের শেষ নেই। গত এক বছরে বিমান নিয়ে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের কয়েকটি শিরোনাম আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। ‘সবকিছু পুরোনো ধারায় তবু নবযাত্রায় বিমান’ (২১ জানুয়ারি, ২০১০), ‘বিদেশি সংস্থার স্বার্থ রক্ষায় উৎসাহী বাংলাদেশ বিমান’ (১৪ মার্চ, ২০১০), ‘বিমানের দুর্নীতি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর’ (৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১০), ‘বিমানের লাভজনক দুবাই রুট চীনা প্রতিষ্ঠানের হাতে যাচ্ছে!’ (১৩ এপ্রিল, ২০১০), ‘বিমানের বিতর্কিত উড়োজাহাজটির পক্ষে নেমেছে সংসদীয় কমিটি’ (৫ জুলাই, ২০১০), ‘বিমানের কাজে স্বচ্ছতা নেই: জি এম কাদের’ (১৮ আগস্ট, ২০১০)। এক দিকে প্রধানমন্ত্রী নিজে বিমানের দুর্নীতির ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন, আরেক দিকে বিমানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন যে বিমানে স্বচ্ছতা নেই। সেদিকে না গিয়ে অপচয়ের একটি ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। বাংলাদেশ বিমানের কেবিন ক্রুরা কখন কোন ফ্লাইটে দায়িত্ব পালন করবেন, তার জন্য প্রতি মাসে একটি শিডিউল তৈরি হয়, যা খুব স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। মাসের শিডিউল, পরিবর্তিত শিডিউল ও ফ্লাইটের আগের রাতের শিডিউলের কাগজটি এই যানজটের ঢাকা শহরে একজন পত্রবাহক দিয়ে প্রতিজনের বাড়ি বাড়ি পাঠানো হয়। ই-মেইল ও মোবাইল ফোনের এই যুগে এই পদ্ধতি চলছে, ভাবা যায়! বাংলাদেশ বিমানে মোট কেবিন ক্রুর সংখ্যা শ তিনেক। এই সংখ্যক ক্রুর বাড়িতে এই শিডিউল পাঠাতে প্রতি মাসে কত অর্থ ও সময়ের ব্যয় হয়, কতজন লোককে এ জন্য বেতন দিতে হচ্ছে, এর একটি হিসাব করে দেখা যেতে পারে। একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কখনো এই অপচয় করতে পারে না। কর্মীদের শিফট পরিবর্তন হয়, প্রতি সপ্তাহে নতুন শিডিউল করতে হয়—এমন অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে রয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানই যে তার কর্মীদের কাছে এভাবে কাজের শিডিউল পাঠায় না, তা দায়িত্ব নিয়েই বলা যায়। যদি বিমান ব্যবসা অভিজ্ঞ একজন পেশাদার নির্বাহীর মাধ্যমে পরিচালিত হতো, তবে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে এ ধরনের অর্থ ও সময়ের অপচয় তিনি কখনো হতে দিতেন না। কীভাবে খরচ সবচেয়ে কমানো যায় এবং লাভ বাড়ানো যায়, সেটাই আধুনিক ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় কথা।
অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম লাভজনক এয়ারলাইনসে পরিণত হওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। তখন মার্গারেট থ্যাচারের রক্ষণশীল সরকার ক্ষমতায়। লোকসান দিয়ে চলছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। সরকার জাতীয় পতাকাবাহী এই প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করার জন্য এর বেসরকারীকরণ ও লন্ডন শেয়ারবাজারে শেয়ার ছাড়ার উদ্যোগ নেয়। কাজটি সফল করার জন্য ১৯৮১ সালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় একজন সফল ব্যবসায়ী জন কিংকে। এয়ারলাইনস ব্যবসার ইতিহাসে তিনি অদক্ষ একটি জাতীয় বিমান সংস্থাকে বিশ্বের অন্যতম ব্যবসাসফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার নায়ক হিসেবে বিবেচিত। দায়িত্ব নিয়ে তিনি অদক্ষ ও কাজে লাগে না এমন ২২ হাজার কর্মীকে বিদায় করেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেন আরেক সফল ব্যবসা নির্বাহী কলিন মার্শালকে। বহর থেকে পুরোনো ও লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা উড়োজাহাজ বাদ দিয়ে নতুন ও আধুনিক উড়োজাহাজ কেনেন, অলাভজনক রুটগুলো বাতিল করেন। ১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বেসরকারীকরণ করা হয় এবং শেয়ারবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের বিপরীতে জমা পড়া চাঁদার পরিমাণ ছিল ১১ গুণ বেশি।
বিমানের শেয়ার ছাড়ার কথা বিমানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন গত বছরের মার্চ মাসে। পুঁজিবাজার মেলার উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আগামী ডিসেম্বরের (২০১০) মধ্যে বাংলাদেশ বিমানকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা হবে। কাজটি হয়নি, কবে হবে এমন কোনো নতুন সময়সীমার কথাও শোনা যায়নি। বাংলাদেশ বিমান নিয়ে আমরা কী করব? লোকসানের যে ধারা শুরু হয়েছে, তাকে আরও বাড়ানো যায় বর্তমান ব্যবস্থাপনা কাঠামো ঠিক রেখে। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছ থেকে আগামী বছর আবার ‘রেভিনিউ কম কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় লোকসান হয়েছে’ ধরনের কথা শুনতে পারি! অথবা লাভজনক করার চেষ্টায় একটি প্রকৃত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিমানকে চালানোর জন্য ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার আসলে কোনটি চায়?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
তবে বিমানের এই লোকসানের দায় শুধু এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ বা এর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা হবে অন্যায়। সরকার বিমানকে কীভাবে চালাতে চায়, সেটাই বড় কথা। বিমান লাভ করেছিল ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে। এই দুই বছরে লাভ হয়েছিল ২১ কোটি টাকার বেশি। এর পরের এক অর্থবছরেই (২০০৯-১০) লোকসান হয়েছে ৮০ কোটি টাকারও বেশি। দুই বছরের লাভের প্রায় চার গুণ এক বছরেই খতম। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের এর আগের তিন বছরে বিমান লোকসান দিয়েছে ৯১৭ কোটি টাকা। লাভের বছর দুটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। বিমানকে সে সময় কোম্পানি করা হয়েছে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার জন্য, যার ফল পাওয়া গিয়েছিল পরের দুই বছর। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার আগের অবস্থায়। লোকসানের দায়টা সেদিক থেকে দেখলে সরকারেরই।
একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে চলে, কোম্পানি গঠনের পরও বাংলাদেশ বিমান সেভাবে চলছে না। বিমানের ব্যবস্থাপনাও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। একটি বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাতে যেমন ব্যবসায় অভিজ্ঞ একজন প্রধান নির্বাহীর প্রয়োজন হয়, বিমানের জন্যও প্রয়োজন আকাশ পরিবহন ব্যবসায় অভিজ্ঞ লোকজনের। বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক এয়ারলাইনসগুলো সেভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সে ধরনের পরিকল্পনাই নেওয়া হয়েছিল। তখন এমনও ভাবা হয়েছিল যে দেশে যদি এ ধরনের অভিজ্ঞ কাউকে পাওয়া না যায়, প্রয়োজনে দেশের বাইরে থেকে আকাশ পরিবহন ব্যবসায় অভিজ্ঞ কাউকে প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। সে ধরনের কিছু বর্তমান সরকারের মাথায় আছে বলে মনে হয় না। বিমান আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। ‘মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার পুরোনো ধারায় ফিরে যায় বিমানের ব্যবস্থাপনা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনাহীন যাত্রা, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ—সবই পুনর্বহাল হয়েছে’ (প্রথম আলো, ১০ জানুয়ারি, ২০১১)। এখন বিমান আবার লোকসান দিতে শুরু করেছে। এভাবে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় চলতে থাকলে বছর বছর লোকসান আরও বাড়তে থাকবে।
কোনো দেশের বাণিজ্যিক এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে সে দেশের সামরিক বিমানবাহিনীর কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। দীর্ঘ সামরিক শাসন আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামরিকায়নের যে সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে, বাংলাদেশ বিমান তার বড় শিকার। বাংলাদেশ বিমান মানেই এর শীর্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাবেন বিমানবাহিনীর কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা! বেসামরিক বাণিজ্যিক এয়ারলাইনস পরিচালনা একটি বিশুদ্ধ ব্যবসা। বিমানবাহিনীর একজন দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তার সমরজ্ঞান এ ক্ষেত্রে কাজে লাগার কথা নয়। ব্যবসায় প্রশাসনে পড়াশোনা করা বা বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জনকারী একজন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কাজটি যেমন বুঝবেন, একজন বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তেমনটি বুঝবেন—এমন আশা করা বোকামি হবে। দুজন অভিজ্ঞতা অর্জন করেন দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ বিমানের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এবং বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান দুজনই বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। পরিচালক হিসেবে আছেন আরও দুজন সামরিক কর্মকতা। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পরিচালিত ১৬টি প্রতিষ্ঠানের একটি হচ্ছে র্যাডিসন ওয়াটার গার্ডেন হোটেল। সেনা হোটেল ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (এসএইচডিএল) মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানটি কোনো অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নয়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হোটেল ব্যবসার আন্তর্জাতিক চেইন কার্লটন হোটেল ওয়ার্ল্ডওয়াইডের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের পাঁচতারা হোটেলের মধ্যে সবচেয়ে ব্যবসাসফল হিসেবে বিবেচিত। ব্যবসা ব্যবসাই।
কীভাবে চলছে বাংলাদেশ বিমান? দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের শেষ নেই। গত এক বছরে বিমান নিয়ে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের কয়েকটি শিরোনাম আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। ‘সবকিছু পুরোনো ধারায় তবু নবযাত্রায় বিমান’ (২১ জানুয়ারি, ২০১০), ‘বিদেশি সংস্থার স্বার্থ রক্ষায় উৎসাহী বাংলাদেশ বিমান’ (১৪ মার্চ, ২০১০), ‘বিমানের দুর্নীতি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর’ (৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১০), ‘বিমানের লাভজনক দুবাই রুট চীনা প্রতিষ্ঠানের হাতে যাচ্ছে!’ (১৩ এপ্রিল, ২০১০), ‘বিমানের বিতর্কিত উড়োজাহাজটির পক্ষে নেমেছে সংসদীয় কমিটি’ (৫ জুলাই, ২০১০), ‘বিমানের কাজে স্বচ্ছতা নেই: জি এম কাদের’ (১৮ আগস্ট, ২০১০)। এক দিকে প্রধানমন্ত্রী নিজে বিমানের দুর্নীতির ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন, আরেক দিকে বিমানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন যে বিমানে স্বচ্ছতা নেই। সেদিকে না গিয়ে অপচয়ের একটি ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। বাংলাদেশ বিমানের কেবিন ক্রুরা কখন কোন ফ্লাইটে দায়িত্ব পালন করবেন, তার জন্য প্রতি মাসে একটি শিডিউল তৈরি হয়, যা খুব স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। মাসের শিডিউল, পরিবর্তিত শিডিউল ও ফ্লাইটের আগের রাতের শিডিউলের কাগজটি এই যানজটের ঢাকা শহরে একজন পত্রবাহক দিয়ে প্রতিজনের বাড়ি বাড়ি পাঠানো হয়। ই-মেইল ও মোবাইল ফোনের এই যুগে এই পদ্ধতি চলছে, ভাবা যায়! বাংলাদেশ বিমানে মোট কেবিন ক্রুর সংখ্যা শ তিনেক। এই সংখ্যক ক্রুর বাড়িতে এই শিডিউল পাঠাতে প্রতি মাসে কত অর্থ ও সময়ের ব্যয় হয়, কতজন লোককে এ জন্য বেতন দিতে হচ্ছে, এর একটি হিসাব করে দেখা যেতে পারে। একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কখনো এই অপচয় করতে পারে না। কর্মীদের শিফট পরিবর্তন হয়, প্রতি সপ্তাহে নতুন শিডিউল করতে হয়—এমন অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে রয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানই যে তার কর্মীদের কাছে এভাবে কাজের শিডিউল পাঠায় না, তা দায়িত্ব নিয়েই বলা যায়। যদি বিমান ব্যবসা অভিজ্ঞ একজন পেশাদার নির্বাহীর মাধ্যমে পরিচালিত হতো, তবে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে এ ধরনের অর্থ ও সময়ের অপচয় তিনি কখনো হতে দিতেন না। কীভাবে খরচ সবচেয়ে কমানো যায় এবং লাভ বাড়ানো যায়, সেটাই আধুনিক ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় কথা।
অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম লাভজনক এয়ারলাইনসে পরিণত হওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। তখন মার্গারেট থ্যাচারের রক্ষণশীল সরকার ক্ষমতায়। লোকসান দিয়ে চলছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। সরকার জাতীয় পতাকাবাহী এই প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করার জন্য এর বেসরকারীকরণ ও লন্ডন শেয়ারবাজারে শেয়ার ছাড়ার উদ্যোগ নেয়। কাজটি সফল করার জন্য ১৯৮১ সালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় একজন সফল ব্যবসায়ী জন কিংকে। এয়ারলাইনস ব্যবসার ইতিহাসে তিনি অদক্ষ একটি জাতীয় বিমান সংস্থাকে বিশ্বের অন্যতম ব্যবসাসফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার নায়ক হিসেবে বিবেচিত। দায়িত্ব নিয়ে তিনি অদক্ষ ও কাজে লাগে না এমন ২২ হাজার কর্মীকে বিদায় করেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেন আরেক সফল ব্যবসা নির্বাহী কলিন মার্শালকে। বহর থেকে পুরোনো ও লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা উড়োজাহাজ বাদ দিয়ে নতুন ও আধুনিক উড়োজাহাজ কেনেন, অলাভজনক রুটগুলো বাতিল করেন। ১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বেসরকারীকরণ করা হয় এবং শেয়ারবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের বিপরীতে জমা পড়া চাঁদার পরিমাণ ছিল ১১ গুণ বেশি।
বিমানের শেয়ার ছাড়ার কথা বিমানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন গত বছরের মার্চ মাসে। পুঁজিবাজার মেলার উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আগামী ডিসেম্বরের (২০১০) মধ্যে বাংলাদেশ বিমানকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা হবে। কাজটি হয়নি, কবে হবে এমন কোনো নতুন সময়সীমার কথাও শোনা যায়নি। বাংলাদেশ বিমান নিয়ে আমরা কী করব? লোকসানের যে ধারা শুরু হয়েছে, তাকে আরও বাড়ানো যায় বর্তমান ব্যবস্থাপনা কাঠামো ঠিক রেখে। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছ থেকে আগামী বছর আবার ‘রেভিনিউ কম কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় লোকসান হয়েছে’ ধরনের কথা শুনতে পারি! অথবা লাভজনক করার চেষ্টায় একটি প্রকৃত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিমানকে চালানোর জন্য ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার আসলে কোনটি চায়?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments