সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-রাষ্ট্রপতির ক্ষমা কোন বার্তা দিল? by আবু সাঈদ খান
ক্ষমা প্রদর্শনের বিধান বলে রাষ্ট্রপতির যেমন মানবিক ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে, তেমনি দলীয় বিবেচনায় প্রকৃত অপরাধীদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের দ্বারও খোলা আছে। এ বাস্তবতা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি নীতিমালা বা আইন প্রণয়নের তাগিদ দেয়; যা সরকার ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ নিয়ন্ত্রিত করতে পারে।
পরিশেষে বলা আবশ্যক, মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। ভুল করতে পারেন সরকার ও রাষ্ট্রপতিও। তবে ভুল আঁকড়ে থাকা বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়। তাই আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে বিপ্লবের প্রতি যে অনুকম্পা দেখানো হয়েছে, তা প্রত্যাহার করা হলে সেটি হবে একটি উত্তম উদাহরণ
গণমাধ্যমে সাধারণভাবে রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি হয় না। সবার মাথার ওপর তার স্থান হলেও তিনি থাকেন নীরবে, নিভৃতে। এর বড় কারণ, সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির কর্মপরিধি ও ক্ষমতা খুবই সীমিত। তাই এক সময়ের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ফিতা কাটা আর মিলাদ পড়ার বাইরে আমার কোনো কাজ নেই। সে যাই হোক, রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ভিন্ন এক কারণে কয়েকবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন। এবারও লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামের দণ্ডপ্রাপ্ত হত্যাকারীকে ক্ষমা করে আলোচনায় এলেন। গণমাধ্যমে এখন তার পক্ষে ও বিপক্ষে আলোচনার ঝড় বইছে।
রাষ্ট্রপতি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র এবং আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা আবু তাহেরের পুত্র এএইচএম বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফ করে দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা কি রাষ্ট্রপতির নেই? অবশ্যই আছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।' এ বিধান অনুযায়ী বিপ্লবকে ক্ষমা প্রদর্শন অসাংবিধানিক হয়েছে_ এমন কথা বলার সুযোগ নেই। তবে সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতার সুষ্ঠু ও যৌক্তিক প্রয়োগের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে_ রাষ্ট্রপতির অধিকার বা ক্ষমতা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক না নেতিবাচক ফল বয়ে আনছে? এ মওকুফের ঘোষণা আইনের শাসনকে নিশ্চিত না প্রশ্নবিদ্ধ করেছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আগে খতিয়ে দেখা যাক, বিপ্লব কী অপরাধ করেছিলেন? আদালতে প্রমাণিত সত্য যে, ২০০০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরের বাসা থেকে আইনজীবী ও বিএনপি নেতা নুরুল ইসলামকে অপহরণ করে বিপ্লব, তার ভাই ও সহযোগীরা। তারপর তাকে জবাই করে লাশ টুকরো টুকরো করে কেটে বস্তায় ভরে মেঘনা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার আদালতের রায়ে বিপ্লবকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এখনও মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। এর আগে ১৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি এক আদেশে বিপ্লবের সব অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন। কোনো মৃত্যুদণ্ডাদেশের মামলা সুপ্রিম কোর্টেই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, তার আগে এ ক্ষমা প্রদর্শনের ঘোষণা আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কি-না সে জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। তার চেয়ে বড় কথা, দণ্ডাদেশ মওকুফের এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে কী মেসেজ পেলাম আমরা? সাদা চোখে যা দেখছি, তা হলো_ এই ক্ষমা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দণ্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়া হলো। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে যখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমাবনতিশীল, দলীয় সন্ত্রাসীদের দাপটে অনেক স্থানেই সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ, তখন এই ক্ষমা তাদের কাছে ভুল মেসেজ পাঠাতে পারে। আওয়ামী লীগের নেতা আবু তাহেরের পুত্রের বিরুদ্ধে লক্ষ্মীপুরে সন্ত্রাস সৃষ্টি বহু অভিযোগ উঠেছে এর আগে। ক্ষমা ঘোষণার পর সন্ত্রাসীদের নতুন তৎপরতাও দেখা গেছে। ভবিষ্যতে তারা আরও উৎসাহিত হবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে? শুধু লক্ষ্মীপুরেই নয় সমগ্র দেশেই ঘটনাটি সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতাকে উস্কে দিতে পারে।
অন্যদিকে নুরুল ইসলামের স্ত্রী তার স্বামী হত্যার বিচার থেকে বঞ্চিত হলেন। না, কেবল স্বামী হত্যার বিচার থেকে বঞ্চিতই হলেন না, পরিবারটি এক আতঙ্কের মধ্যেও নিক্ষেপিত হলো। একজন সাংবাদিক নুরুল ইসলামের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর তিনি অনুরোধ করেছেন, তার বাড়ির ঠিকানা যেন ছাপানো না হয়, কাউকে বলা না হয় যে তার সন্তানরা কে কোথায় লেখাপড়া করছে। তিনি বলেছেন, ভয়ে তিনি গৃহবন্দি হয়ে থাকেন, পারতপক্ষে তিনি ও তার সন্তানরা রাস্তায় বের হন না। নিহত নুরুল ইসলামের পত্নী প্রশ্ন তুলেছেন, রাষ্ট্রপতি কি একইভাবে ২১ আগস্ট মর্মান্তিক গ্রেনেড হামলায় নিহত তার স্ত্রী আইভি রহমানের হত্যাকারীদের ক্ষমা করবেন? এ প্রশ্ন সঙ্গত।
এখন খতিয়ে দেখা যাক, কেন বিপ্লবকে ক্ষমা করা হলো? এটি কি দলীয় বিবেচনা না অন্য কিছু? রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগের একজন পরীক্ষিত নেতা। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি দলীয় সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠবেন_ এটিই ছিল প্রত্যাশিত। কেবল তাহেরপুত্র বিপ্লবকেই নয়, তিনি সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পুত্রের দণ্ডও ক্ষমা করেছেন। এর আগে নাটোরের সাবি্বর আহম্মদ ওরফে গামা হত্যাকারী ২০ জন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়েছেন। তবে একই ধরনের ক্ষমার নজির স্থাপন করে গেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদও। তিনি দুই খুনের মামলায় অভিযুক্ত পলাতক মহিউদ্দিন আহমেদ ঝিন্টুকে বিদেশ থেকে এনে তার ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করেছিলেন। এ নিয়ে সে সময় বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ নেতারাসহ সর্বস্তরের মানুষ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি হয়েও কটুকথা শুনতে হয়েছিল। তবে জিল্লুর রহমানের মতো একজন সৎ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের পথে হাঁটবেন, সেটি জাতি আশা করেনি।
বিপ্লবকে ক্ষমা করার ঘোষণা নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ আওয়ামী লীগের নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, 'সংবিধানের ৫৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ এবং সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিদের নিয়োগ ছাড়া বাকি সব কাজে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হয়। এ কথা সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে। অন্য যে কোনো বিষয়ে নথি গেলে তাতে রাষ্ট্রপতির সই করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সুতরাং রাষ্ট্রপতি নন, যারা রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে এসব করাচ্ছেন, তাদের সমালোচনা করতে হবে' (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০১১)। তিনি যথার্থই বলেছেন যে, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করতে হয়। সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে এ দায় সরকারের। মূলত এটি সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে 'রাষ্ট্রপতির এতে সই করা ছাড়া অন্য উপায় নেই' কথাটি কতটুকু যৌক্তিক? সংবিধানের ৮০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অর্থবিল ছাড়া রাষ্ট্রপতি যে কোনো বিল পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে কি বাধা ছিল? আর ক্ষমা করার বিষয়টি যখন রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার তিনি চাইলে তা প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না কেন_ সেটিই প্রশ্ন।
এ ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের রানীর প্রসঙ্গ টেনে বলা হচ্ছে যে, সেখানে রানী সমালোচনার ঊধর্ে্ব। কোনো বিবেচনাতেই রাজা বা রানী আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এক নন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কারোরই সমালোচনার ঊধর্ে্ব থাকার সুযোগ নেই। ইংল্যান্ডে এখন রানী ও তার পরিবারের সদস্যদের সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। রাজতন্ত্রের এই অবশেষ রক্ষার যৌক্তিকতা নিয়ে কথা উঠেছে।
তবে এটি সরকারের সিদ্ধান্ত, তাই সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। রাষ্ট্রপতি এতে স্বাক্ষর করে তিনি এর দায় গ্রহণ করছেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাষ্ট্রপতিকে সমালোচনার ঊধর্ে্ব রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। আসলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে কেউই সমালোচনার ঊধর্ে্ব নন। জনগণের নির্বাচিত (যদিও প্রত্যক্ষ ভোটে নয়) রাষ্ট্রপতি তার কর্মকাণ্ডের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করবেন, এটিই গণতন্ত্রের বিধান। এতে রাষ্ট্রপতি-প্রতিষ্ঠান বিতর্কিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
জাতির সামনে এক বিপজ্জনক সমস্যা তথাকথিত রাজনৈতিক বিবেচনা, আসলে দলীয় বিবেচনা। দলীয় বিবেচনায় চাকরি-বাকরি, ঠিকাদারি, ত্রাণসামগ্রীর ভাগাভাগি সবই হয়েছে। এখনও হচ্ছে। এটি আইনের শাসনের জন্য বড় হুমকি। তাই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রপতি ও সরকারের সুবিবেচনাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সঙ্গত কারণেই শান্তিপ্রিয় জনগণ প্রত্যাশা করে, সরকার কোনো অপরাধীর প্রতি সদয় হবে না। কোনো অভিযুক্তকে ক্ষমা করা হলে তার ব্যাখ্যা জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা ঈদের সময় বৃদ্ধ, অসুস্থ কয়েদিদের ক্ষমা কিংবা সাজা কমানো হয়। তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন ওঠে না। বিপ্লবসহ এ ধরনের আরও কিছু অপরাধীর সাজা মওকুফের বিষয়টি এ থেকে ভিন্ন। দণ্ডপ্রাপ্ত খুনের আসামিকে ক্ষমা করার সঙ্গে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রশ্ন জড়িত।
ক্ষমা প্রদর্শনের বিধান বলে রাষ্ট্রপতির যেমন মানবিক ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে, তেমনি দলীয় বিবেচনায় প্রকৃত অপরাধীদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের দ্বারও খোলা আছে। এ বাস্তবতা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি নীতিমালা বা আইন প্রণয়নের তাগিদ দেয়; যা সরকার ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ নিয়ন্ত্রিত করতে পারে।
পরিশেষে বলা আবশ্যক, মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। ভুল করতে পারেন সরকার ও রাষ্ট্রপতিও। তবে ভুল আঁকড়ে থাকা বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়। তাই আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে বিপ্লবের প্রতি যে অনুকম্পা দেখানো হয়েছে, তা প্রত্যাহার করা হলে সেটি হবে একটি উত্তম উদাহরণ।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
গণমাধ্যমে সাধারণভাবে রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি হয় না। সবার মাথার ওপর তার স্থান হলেও তিনি থাকেন নীরবে, নিভৃতে। এর বড় কারণ, সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির কর্মপরিধি ও ক্ষমতা খুবই সীমিত। তাই এক সময়ের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ফিতা কাটা আর মিলাদ পড়ার বাইরে আমার কোনো কাজ নেই। সে যাই হোক, রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ভিন্ন এক কারণে কয়েকবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন। এবারও লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামের দণ্ডপ্রাপ্ত হত্যাকারীকে ক্ষমা করে আলোচনায় এলেন। গণমাধ্যমে এখন তার পক্ষে ও বিপক্ষে আলোচনার ঝড় বইছে।
রাষ্ট্রপতি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র এবং আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা আবু তাহেরের পুত্র এএইচএম বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফ করে দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা কি রাষ্ট্রপতির নেই? অবশ্যই আছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।' এ বিধান অনুযায়ী বিপ্লবকে ক্ষমা প্রদর্শন অসাংবিধানিক হয়েছে_ এমন কথা বলার সুযোগ নেই। তবে সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতার সুষ্ঠু ও যৌক্তিক প্রয়োগের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে_ রাষ্ট্রপতির অধিকার বা ক্ষমতা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক না নেতিবাচক ফল বয়ে আনছে? এ মওকুফের ঘোষণা আইনের শাসনকে নিশ্চিত না প্রশ্নবিদ্ধ করেছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আগে খতিয়ে দেখা যাক, বিপ্লব কী অপরাধ করেছিলেন? আদালতে প্রমাণিত সত্য যে, ২০০০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরের বাসা থেকে আইনজীবী ও বিএনপি নেতা নুরুল ইসলামকে অপহরণ করে বিপ্লব, তার ভাই ও সহযোগীরা। তারপর তাকে জবাই করে লাশ টুকরো টুকরো করে কেটে বস্তায় ভরে মেঘনা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার আদালতের রায়ে বিপ্লবকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এখনও মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। এর আগে ১৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি এক আদেশে বিপ্লবের সব অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন। কোনো মৃত্যুদণ্ডাদেশের মামলা সুপ্রিম কোর্টেই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, তার আগে এ ক্ষমা প্রদর্শনের ঘোষণা আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কি-না সে জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। তার চেয়ে বড় কথা, দণ্ডাদেশ মওকুফের এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে কী মেসেজ পেলাম আমরা? সাদা চোখে যা দেখছি, তা হলো_ এই ক্ষমা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দণ্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়া হলো। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে যখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমাবনতিশীল, দলীয় সন্ত্রাসীদের দাপটে অনেক স্থানেই সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ, তখন এই ক্ষমা তাদের কাছে ভুল মেসেজ পাঠাতে পারে। আওয়ামী লীগের নেতা আবু তাহেরের পুত্রের বিরুদ্ধে লক্ষ্মীপুরে সন্ত্রাস সৃষ্টি বহু অভিযোগ উঠেছে এর আগে। ক্ষমা ঘোষণার পর সন্ত্রাসীদের নতুন তৎপরতাও দেখা গেছে। ভবিষ্যতে তারা আরও উৎসাহিত হবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে? শুধু লক্ষ্মীপুরেই নয় সমগ্র দেশেই ঘটনাটি সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতাকে উস্কে দিতে পারে।
অন্যদিকে নুরুল ইসলামের স্ত্রী তার স্বামী হত্যার বিচার থেকে বঞ্চিত হলেন। না, কেবল স্বামী হত্যার বিচার থেকে বঞ্চিতই হলেন না, পরিবারটি এক আতঙ্কের মধ্যেও নিক্ষেপিত হলো। একজন সাংবাদিক নুরুল ইসলামের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর তিনি অনুরোধ করেছেন, তার বাড়ির ঠিকানা যেন ছাপানো না হয়, কাউকে বলা না হয় যে তার সন্তানরা কে কোথায় লেখাপড়া করছে। তিনি বলেছেন, ভয়ে তিনি গৃহবন্দি হয়ে থাকেন, পারতপক্ষে তিনি ও তার সন্তানরা রাস্তায় বের হন না। নিহত নুরুল ইসলামের পত্নী প্রশ্ন তুলেছেন, রাষ্ট্রপতি কি একইভাবে ২১ আগস্ট মর্মান্তিক গ্রেনেড হামলায় নিহত তার স্ত্রী আইভি রহমানের হত্যাকারীদের ক্ষমা করবেন? এ প্রশ্ন সঙ্গত।
এখন খতিয়ে দেখা যাক, কেন বিপ্লবকে ক্ষমা করা হলো? এটি কি দলীয় বিবেচনা না অন্য কিছু? রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগের একজন পরীক্ষিত নেতা। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি দলীয় সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠবেন_ এটিই ছিল প্রত্যাশিত। কেবল তাহেরপুত্র বিপ্লবকেই নয়, তিনি সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পুত্রের দণ্ডও ক্ষমা করেছেন। এর আগে নাটোরের সাবি্বর আহম্মদ ওরফে গামা হত্যাকারী ২০ জন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়েছেন। তবে একই ধরনের ক্ষমার নজির স্থাপন করে গেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদও। তিনি দুই খুনের মামলায় অভিযুক্ত পলাতক মহিউদ্দিন আহমেদ ঝিন্টুকে বিদেশ থেকে এনে তার ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করেছিলেন। এ নিয়ে সে সময় বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ নেতারাসহ সর্বস্তরের মানুষ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি হয়েও কটুকথা শুনতে হয়েছিল। তবে জিল্লুর রহমানের মতো একজন সৎ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের পথে হাঁটবেন, সেটি জাতি আশা করেনি।
বিপ্লবকে ক্ষমা করার ঘোষণা নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ আওয়ামী লীগের নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, 'সংবিধানের ৫৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ এবং সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিদের নিয়োগ ছাড়া বাকি সব কাজে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হয়। এ কথা সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে। অন্য যে কোনো বিষয়ে নথি গেলে তাতে রাষ্ট্রপতির সই করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সুতরাং রাষ্ট্রপতি নন, যারা রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে এসব করাচ্ছেন, তাদের সমালোচনা করতে হবে' (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০১১)। তিনি যথার্থই বলেছেন যে, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করতে হয়। সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে এ দায় সরকারের। মূলত এটি সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে 'রাষ্ট্রপতির এতে সই করা ছাড়া অন্য উপায় নেই' কথাটি কতটুকু যৌক্তিক? সংবিধানের ৮০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অর্থবিল ছাড়া রাষ্ট্রপতি যে কোনো বিল পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে কি বাধা ছিল? আর ক্ষমা করার বিষয়টি যখন রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার তিনি চাইলে তা প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না কেন_ সেটিই প্রশ্ন।
এ ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের রানীর প্রসঙ্গ টেনে বলা হচ্ছে যে, সেখানে রানী সমালোচনার ঊধর্ে্ব। কোনো বিবেচনাতেই রাজা বা রানী আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এক নন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কারোরই সমালোচনার ঊধর্ে্ব থাকার সুযোগ নেই। ইংল্যান্ডে এখন রানী ও তার পরিবারের সদস্যদের সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। রাজতন্ত্রের এই অবশেষ রক্ষার যৌক্তিকতা নিয়ে কথা উঠেছে।
তবে এটি সরকারের সিদ্ধান্ত, তাই সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। রাষ্ট্রপতি এতে স্বাক্ষর করে তিনি এর দায় গ্রহণ করছেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাষ্ট্রপতিকে সমালোচনার ঊধর্ে্ব রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। আসলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে কেউই সমালোচনার ঊধর্ে্ব নন। জনগণের নির্বাচিত (যদিও প্রত্যক্ষ ভোটে নয়) রাষ্ট্রপতি তার কর্মকাণ্ডের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করবেন, এটিই গণতন্ত্রের বিধান। এতে রাষ্ট্রপতি-প্রতিষ্ঠান বিতর্কিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
জাতির সামনে এক বিপজ্জনক সমস্যা তথাকথিত রাজনৈতিক বিবেচনা, আসলে দলীয় বিবেচনা। দলীয় বিবেচনায় চাকরি-বাকরি, ঠিকাদারি, ত্রাণসামগ্রীর ভাগাভাগি সবই হয়েছে। এখনও হচ্ছে। এটি আইনের শাসনের জন্য বড় হুমকি। তাই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রপতি ও সরকারের সুবিবেচনাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সঙ্গত কারণেই শান্তিপ্রিয় জনগণ প্রত্যাশা করে, সরকার কোনো অপরাধীর প্রতি সদয় হবে না। কোনো অভিযুক্তকে ক্ষমা করা হলে তার ব্যাখ্যা জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা ঈদের সময় বৃদ্ধ, অসুস্থ কয়েদিদের ক্ষমা কিংবা সাজা কমানো হয়। তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন ওঠে না। বিপ্লবসহ এ ধরনের আরও কিছু অপরাধীর সাজা মওকুফের বিষয়টি এ থেকে ভিন্ন। দণ্ডপ্রাপ্ত খুনের আসামিকে ক্ষমা করার সঙ্গে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রশ্ন জড়িত।
ক্ষমা প্রদর্শনের বিধান বলে রাষ্ট্রপতির যেমন মানবিক ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে, তেমনি দলীয় বিবেচনায় প্রকৃত অপরাধীদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের দ্বারও খোলা আছে। এ বাস্তবতা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি নীতিমালা বা আইন প্রণয়নের তাগিদ দেয়; যা সরকার ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ নিয়ন্ত্রিত করতে পারে।
পরিশেষে বলা আবশ্যক, মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। ভুল করতে পারেন সরকার ও রাষ্ট্রপতিও। তবে ভুল আঁকড়ে থাকা বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়। তাই আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে বিপ্লবের প্রতি যে অনুকম্পা দেখানো হয়েছে, তা প্রত্যাহার করা হলে সেটি হবে একটি উত্তম উদাহরণ।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments