স্বচ্ছতাও আজ স্রেফ একটা মুখোশ! by শাহনেওয়াজ বিপ্লব
সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়িতে পাওয়া ৭০ লাখ টাকার কেলেঙ্কারি নিয়ে পানি অনেক ঘোলা হলো। সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতারা আর বিরোধী দল বিএনপির নেতারা সেই ঘোলা পানিতে মাছ ধরতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন ইতিমধ্যে।
রাজনীতির মাঠ থেকে সংবাদপত্রে বিবৃতি- উভয় পক্ষের মধ্যে দুর্নীতি নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িও অব্যাহত। উভয় পক্ষই প্রমাণ করতে চাইছে, তারাই সৎ, তারাই স্বচ্ছ।
ঘটনার দায়ভার স্বীকার করে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগে সরকার আর বিরোধী দলের 'দুর্নীতি' নিয়ে লড়াই আরো প্রবল হয়েছে। এবং সন্দেহ নেই এই লড়াইয়ে শেখ হাসিনার সরকার এখন কিছুটা ব্যাকফুটে। কারণ শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি থেকে পদ্মা সেতু দুর্নীতি হয়ে সর্বশেষ মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে টাকা পাওয়া পর্যন্ত যাদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে অথবা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই সরকারি লোকজন। ফলে 'শেখ হাসিনার সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত'- এ কথাটা বিরোধী দল বিএনপি যত সহজে প্রচার করতে পারছে, লোকের বিশ্বাস, সরকারের পক্ষে ঠিক ততটাই কঠিন হয়ে পড়ছে এর মোকাবিলা করা। তার ওপর আছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি আর জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে দেশের মানুষ খুবই ক্ষুব্ধ; তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। সাধারণ মানুষ বিশ্ববাজার, বিশ্ব অর্থনীতি- এসব বোঝে না, বুঝতে চায় না। মানুষ বোঝে কাছের বাজারহাট, যেখান থেকে জীবনধারণের জিনিসপত্র কিনতে হয় তাদের, সেখানে দাম বাড়লে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রাণদণ্ড পর্যন্ত দিতে হাত কাঁপে না তার। মূল্যবৃদ্ধির চাপে পিষ্ট মানুষ যখন দেখে সরকারি লোকজন একটার পর একটা নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স পাচ্ছে, মন্ত্রীর এপিএসরা লাখ লাখ টাকা নিয়ে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছেন মধ্যরাতে, তখন ক্ষুব্ধ মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে নেয় যে সরকার 'দুর্নীতিগ্রস্ত'।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়ি পিলখানায় আটক হওয়ার রাতে ওই গাড়িতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই স্বীকার করেছেন যে তাঁরা মন্ত্রীর বাড়িতেই যাচ্ছিলেন টাকা নিয়ে। এ অবিশ্বাস্য সংবাদটি সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে একটা প্রবল ধাক্কা দিয়েছে। কারণ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের সৎ রাজনীতিকদের একজন বলে একটা ধারণা ছিল দেশের সাধারণ মানুষের ভেতর। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সংসদ থেকে টক শো- সব জায়গায় ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। এমনকি রেলমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি বলেছিলেন, রেলের দুর্নীতির পেছনের কালো বিড়াল তিনি খুঁজে বের করবেন। তাই ঘটনার দায়ভার নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ আমাদের রাজনীতির জন্য। তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দোষী বা নির্দোষ, যা-ই প্রমাণিত হোন না কেন ঘটনার সব দায়দায়িত্ব তিনি স্বীকার করার পর শেখ হাসিনার সরকার সৎ না অসৎ-এ রকম একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে। আর এ বিতর্কে বিএনপির ইন্ধন তো আছেই।
কারণ বিরোধী দল বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে হাওয়া ভবন দুর্নীতির অন্যতম কেন্দ্র ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারেক রহমান, আরাফাত রহমান ও বিএনপি নেতাদের শত কোটি টাকার দুর্নীতির সংবাদ বিএনপির জনপ্রিয়তায় ভাটার সৃষ্টি করেছিল। যার ফলে গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি চরম পরাজয় বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। আর সে সময় থেকেই বিএনপি মরিয়া হয়ে চাইছিল আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীদের অথবা শেখ হাসিনার কাছের মানুষগুলোর দুর্নীতির সংবাদ বা কিছু ঘটনা, যাতে তারা তা পরবর্তী নির্বাচনে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে পারেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে রেলওয়েগেট কেলেঙ্কারির দায় নিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করে আবারও তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করার পর বিএনপি এখন চাইছে সরকারি দলের মন্ত্রী, পিএস, এপিএসদের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন বাড়ুক জনমনে, তাতে বরং তাদেরই লাভ। সরকারের বিরুদ্ধে জনবিশ্বাসে ফাটল ধরানোর জন্য বিএনপি তিন বছর ধরে ইস্যু খুঁজে আসছিল, যাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। দুর্নীতির অভিযোগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগে তাদের উৎসাহ যে শতগুণ বেড়ে গেছে সন্দেহ নেই।
এ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে, তা আমরা জানি না। কিন্তু যেটা চিন্তার বিষয় সেটা হলো, দুর্নীতির প্রশ্নে আমাদের দেশের নেতা-মন্ত্রী ও তাদের আত্মীয়-পরিজনদের অবস্থান। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি কেউই পরিষ্কার নয়? স্বচ্ছতাও আজ স্রেফ একটা মুখোশ! সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সততা, নিষ্ঠা আর শৃঙ্খলা নিয়ে কত কথা, কত প্রশস্তি শুনেছি! আর এ কী! মানছি, এখনো কিছুই প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু মন্ত্রীর এপিএস তো বলছেন যে টাকা নিয়ে তাঁরা মন্ত্রীর বাসাতেই যাচ্ছিলেন।
ক্ষমতার জোরে নয়কে ছয় আর ছয়কে নয় করা আমাদের দেশে কোনো ব্যাপার নয়। রেলমন্ত্রীর লাখ লাখ টাকার এসব দুর্নীতির কাহিনী আগামী কয়েক দিনের মধ্যে হয়তো চাপা পড়ে যাবে; কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা যেটি সেটি হচ্ছে, এসব ঘটনায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাদের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা-ভক্তি কিন্তু বিপজ্জনক মাত্রায় কমে যাচ্ছে।
দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে এটা খুব সুখবর নয়।
লেখক : গল্পকার, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত।
shahnewazbiplob@hotmail.com
ঘটনার দায়ভার স্বীকার করে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগে সরকার আর বিরোধী দলের 'দুর্নীতি' নিয়ে লড়াই আরো প্রবল হয়েছে। এবং সন্দেহ নেই এই লড়াইয়ে শেখ হাসিনার সরকার এখন কিছুটা ব্যাকফুটে। কারণ শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি থেকে পদ্মা সেতু দুর্নীতি হয়ে সর্বশেষ মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে টাকা পাওয়া পর্যন্ত যাদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে অথবা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই সরকারি লোকজন। ফলে 'শেখ হাসিনার সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত'- এ কথাটা বিরোধী দল বিএনপি যত সহজে প্রচার করতে পারছে, লোকের বিশ্বাস, সরকারের পক্ষে ঠিক ততটাই কঠিন হয়ে পড়ছে এর মোকাবিলা করা। তার ওপর আছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি আর জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে দেশের মানুষ খুবই ক্ষুব্ধ; তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। সাধারণ মানুষ বিশ্ববাজার, বিশ্ব অর্থনীতি- এসব বোঝে না, বুঝতে চায় না। মানুষ বোঝে কাছের বাজারহাট, যেখান থেকে জীবনধারণের জিনিসপত্র কিনতে হয় তাদের, সেখানে দাম বাড়লে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রাণদণ্ড পর্যন্ত দিতে হাত কাঁপে না তার। মূল্যবৃদ্ধির চাপে পিষ্ট মানুষ যখন দেখে সরকারি লোকজন একটার পর একটা নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স পাচ্ছে, মন্ত্রীর এপিএসরা লাখ লাখ টাকা নিয়ে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছেন মধ্যরাতে, তখন ক্ষুব্ধ মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে নেয় যে সরকার 'দুর্নীতিগ্রস্ত'।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়ি পিলখানায় আটক হওয়ার রাতে ওই গাড়িতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই স্বীকার করেছেন যে তাঁরা মন্ত্রীর বাড়িতেই যাচ্ছিলেন টাকা নিয়ে। এ অবিশ্বাস্য সংবাদটি সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে একটা প্রবল ধাক্কা দিয়েছে। কারণ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের সৎ রাজনীতিকদের একজন বলে একটা ধারণা ছিল দেশের সাধারণ মানুষের ভেতর। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সংসদ থেকে টক শো- সব জায়গায় ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। এমনকি রেলমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি বলেছিলেন, রেলের দুর্নীতির পেছনের কালো বিড়াল তিনি খুঁজে বের করবেন। তাই ঘটনার দায়ভার নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ আমাদের রাজনীতির জন্য। তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দোষী বা নির্দোষ, যা-ই প্রমাণিত হোন না কেন ঘটনার সব দায়দায়িত্ব তিনি স্বীকার করার পর শেখ হাসিনার সরকার সৎ না অসৎ-এ রকম একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে। আর এ বিতর্কে বিএনপির ইন্ধন তো আছেই।
কারণ বিরোধী দল বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে হাওয়া ভবন দুর্নীতির অন্যতম কেন্দ্র ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারেক রহমান, আরাফাত রহমান ও বিএনপি নেতাদের শত কোটি টাকার দুর্নীতির সংবাদ বিএনপির জনপ্রিয়তায় ভাটার সৃষ্টি করেছিল। যার ফলে গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি চরম পরাজয় বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। আর সে সময় থেকেই বিএনপি মরিয়া হয়ে চাইছিল আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীদের অথবা শেখ হাসিনার কাছের মানুষগুলোর দুর্নীতির সংবাদ বা কিছু ঘটনা, যাতে তারা তা পরবর্তী নির্বাচনে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে পারেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে রেলওয়েগেট কেলেঙ্কারির দায় নিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করে আবারও তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করার পর বিএনপি এখন চাইছে সরকারি দলের মন্ত্রী, পিএস, এপিএসদের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন বাড়ুক জনমনে, তাতে বরং তাদেরই লাভ। সরকারের বিরুদ্ধে জনবিশ্বাসে ফাটল ধরানোর জন্য বিএনপি তিন বছর ধরে ইস্যু খুঁজে আসছিল, যাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। দুর্নীতির অভিযোগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগে তাদের উৎসাহ যে শতগুণ বেড়ে গেছে সন্দেহ নেই।
এ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে, তা আমরা জানি না। কিন্তু যেটা চিন্তার বিষয় সেটা হলো, দুর্নীতির প্রশ্নে আমাদের দেশের নেতা-মন্ত্রী ও তাদের আত্মীয়-পরিজনদের অবস্থান। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি কেউই পরিষ্কার নয়? স্বচ্ছতাও আজ স্রেফ একটা মুখোশ! সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সততা, নিষ্ঠা আর শৃঙ্খলা নিয়ে কত কথা, কত প্রশস্তি শুনেছি! আর এ কী! মানছি, এখনো কিছুই প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু মন্ত্রীর এপিএস তো বলছেন যে টাকা নিয়ে তাঁরা মন্ত্রীর বাসাতেই যাচ্ছিলেন।
ক্ষমতার জোরে নয়কে ছয় আর ছয়কে নয় করা আমাদের দেশে কোনো ব্যাপার নয়। রেলমন্ত্রীর লাখ লাখ টাকার এসব দুর্নীতির কাহিনী আগামী কয়েক দিনের মধ্যে হয়তো চাপা পড়ে যাবে; কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা যেটি সেটি হচ্ছে, এসব ঘটনায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাদের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা-ভক্তি কিন্তু বিপজ্জনক মাত্রায় কমে যাচ্ছে।
দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে এটা খুব সুখবর নয়।
লেখক : গল্পকার, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত।
shahnewazbiplob@hotmail.com
No comments