চারদিক-বেথুন বীথি by রেজিনা বেগম
কলকাতার কাছেই মির্জাপুর (বাহির শিমুলিয়া)। সেখানে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি মেয়েদের স্কুল। গেটের কাছে একটি ছোট্ট মেয়ে কাঁদছে দেখে এগিয়ে এলেন একজন ব্রিটিশ ভদ্রলোক। পরম স্নেহে বালিকাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন।
ছোট্ট শিশু, মুখের ভাষা না বুঝলেও স্নেহের ভাষা বুঝতে পারল, তার কান্না থেমে গেল। লোকটি বললেন, ‘মা, তুমি রানি হইবে? এই দেখো, আমি ঘোড়া হইয়াছি, তুমি আমার পৃষ্ঠে চড়িয়া রানির মতন আমাকে হাঁকাও।’ খানিক পরে দেখা গেল সাহেব ধুলির মধ্যে চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলছেন, আর তাঁর পিঠে বসে মেয়েটি বলছে, ‘বেথুন ঘোড়া, হ্যাট হ্যাট।’
এটা কোনো অলীক কল্পনা নয়, ইতিহাসবিদেরা ঠিক এমনই বাস্তব দৃশ্য বর্ণনা করেছেন, তবে সেটি ১৮৫০ সালের। আর এই বেথুন ঘোড়া হচ্ছেন জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বিটন। ব্রিটিশ সাহেব বিটন ভারতের বিশেষ করে, ঔপনিবেশিক বাংলার জনগণের কাছে এসে বেথুন সাহেব হয়ে রয়ে গেছেন। তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন ১৮৪৮ সালে, ব্রিটিশ সরকারের আইনসচিব হয়ে; আর ফিরে যাননি।
যাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহ আছে, যাঁরা খুঁজে ফেরেন অতীতের ছায়া, তাঁদের জন্য কলকাতা যথেষ্ট আকর্ষণীয় স্থান। যতবার কলকাতায় গিয়েছি, দেখে নেওয়ার চেষ্টা করেছি জোব চার্নকের এই শহরটি। দুঃখ ছিল মনে, আমাদের মধুকবির সমাধি দেখা হয়নি বলে, বঙ্গে জন্মেও ক্ষণিক এই কবির সমাধির পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ ঘটেনি বলে। মহররমের ছুটির সুযোগে চলে গেলাম পার্ক স্ট্রিট ক্রিশ্চিয়ান বেরিয়াল বোর্ড সমাধিস্থলে (সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি)। মূল ফটকেই জেনে নিয়েছিলাম, সোজা গিয়ে ডান দিকে দেখতে পাব মধু বিশ্রাম কুঞ্জ। এই তো ডান দিকেই মধু বিশ্রাম কুঞ্জ। বাঁ দিকে পথের মুখে একটা আর্চওয়ে, ওপরে লেখা ‘বেথুন বীথি রক্ষণাবেক্ষণে পূর্ত দপ্তর’। একে ইতিহাসের ছাত্রী, তাই নারী বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ। বেথুন নামটিই যথেষ্ট আমার জন্য। মধুকবির প্রতি সম্মান জানিয়ে এগোলাম বাঁ দিকে। দুই ধারে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে আসা ইংরেজদের সমাধি, যার অনেকগুলোই এখন ধ্বংসস্তূপ। দাঁড়ালাম বেথুন সাহেবের সমাধির সামনে। রক্ষণাবেক্ষণের ফলে অক্ষতই সমাধি, কালো মার্বেল পাথরের স্মৃতিফলকটিও বেশ ঝকঝকে, তবে ধুলো আর শুকনো পাতা ঢেকে রেখেছে সমাধির গায়ের লেখাগুলো। পড়ছি সমাধিতে লেখা বাণী; দূর থেকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন এই কবরস্থানের মতোই প্রাচীন এক বৃদ্ধ। বললেন, তিনিই দেখাশোনা করেন এখানকার সমাধিগুলো। শীতের পড়ন্ত বিকেল, আবছায়া কুয়াশায় ইতিহাস যেন চলমান বর্তমান হয়ে ঘটে যেতে থাকে চোখের সামনে।
সেই কবেকার কথা, রাজা রামমোহন রায় সচেষ্ট হয়েছেন ভারতীয় হিন্দু নারীদের মৃত স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়ে মরার মতো পৈশাচিক সতীদাহ প্রথার হাত থেকে রক্ষা করতে। আবার একদল চাইছে এই প্রথাটি বহাল রাখতে। এই নিয়ে লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলে দুই পক্ষই আবেদন করেছে। যাঁরা সতীদাহ প্রথার পক্ষে, তাঁরা তৎকালীন লন্ডনের তরুণ আইনজীবী বিটনকে তাঁদের পক্ষের উকিল নিয়োগ করেন। ভারতবর্ষ সম্পর্কে অজ্ঞ বিটন না জেনেই তাঁদের পক্ষে লড়েন। পরবর্তী সময়ে এর জন্য প্রায়শ্চিত্ত করেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাঙালি মেয়েদের দুঃখ মোচনে ব্রতী থেকে।
আমরা কজনে জানি, সুদূর বিলেতের এক সাহেব তাঁর মায়ের নির্দেশে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ভারতে এসে বাংলার অভাগা মেয়েদের জন্য আমৃত্যু কাজ করেছেন এবং পরম শান্তিতে শুয়ে আছেন এই বাংলাতেই? বেথুন সাহেবের মা ভারতীয় নারীদের সহমরণ নামক অনাচারের কথা জেনেছিলেন, এ বিষয়ে ছেলের ভূমিকা জানতে পেরে হয়েছিলেন বেদনাহত। মায়ের কথাতেই তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে। এ বিষয়ে পড়াশোনা করতে করতেই উপলব্ধি করেন ভারতীয় নারীর জীবন কতটা দুর্বিষহ। মনে-প্রাণে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এই নারীদের দুঃখ মোচনে কী করা যায়, তাই ভেবে। মা নির্দেশ দিলেন, ভারতবর্ষে গিয়ে নারীকল্যাণ ও নারীশিক্ষার ব্যবস্থা করতে। শিক্ষিত হলেই এরা নিজেদের অবস্থা বুঝে নিজেরাই ব্যাধি দূর করতে পারবে। অবশেষে ভারতে আসার সুযোগও পেয়ে গেলেন। ব্রিটিশ ভারতের আইনসচিব হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ১৮৪৮ সালে এসে পৌঁছান কলকাতায়। তারপর ব্রিটিশ-ভারতের অবিভক্ত বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসে লেখা আছে।
প্রাথমিকভাবে মির্জাপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন মেয়েদের জন্য একটি স্কুল। যখন মির্জাপুর থেকে স্কুলটি বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত করা হচ্ছিল, তখন তিনি চেষ্টা করেছিলেন স্কুলটির নামকরণ মহারানি ভিক্টোরিয়ার নাম অনুসারে করার অনুমতি পেতে, কিন্তু সেই অনুমতি তিনি পাননি। আগস্ট ১৮৫১ নতুন স্কুলভবন নির্মাণের কাজ শেষের পথে, তখন বেথুন সাহেব স্কুল পরিদর্শনের কাজে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে শয্যা নেন। সেই শয্যা ছিল তাঁর শেষশয্যা। ১২ আগস্ট ১৮৫১ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু স্কুলটির নামকরণ-সমস্যা দূর করে দেয়। স্কুলটির নাম হলো বেথুন স্কুল। সেপ্টেম্বর ১৮৫১ স্কুলটির নিজস্ব ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়। মৃত্যুর আগে বেথুন তাঁর সব সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন মেয়েদের স্কুলটির জন্য, আর মৃত্যুবরণ করে দিয়ে গেলেন নিজ নামটি। আজ বেথুন কলেজ তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত, কিন্তু এর জনক বেথুন সাহেব যেন হারিয়ে গেছেন ইতিহাস বইয়ের পাতায় আর বেথুন কলেজ প্রাঙ্গণে তাঁর আবক্ষ মূর্তির মধ্যে।
এটা কোনো অলীক কল্পনা নয়, ইতিহাসবিদেরা ঠিক এমনই বাস্তব দৃশ্য বর্ণনা করেছেন, তবে সেটি ১৮৫০ সালের। আর এই বেথুন ঘোড়া হচ্ছেন জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বিটন। ব্রিটিশ সাহেব বিটন ভারতের বিশেষ করে, ঔপনিবেশিক বাংলার জনগণের কাছে এসে বেথুন সাহেব হয়ে রয়ে গেছেন। তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন ১৮৪৮ সালে, ব্রিটিশ সরকারের আইনসচিব হয়ে; আর ফিরে যাননি।
যাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহ আছে, যাঁরা খুঁজে ফেরেন অতীতের ছায়া, তাঁদের জন্য কলকাতা যথেষ্ট আকর্ষণীয় স্থান। যতবার কলকাতায় গিয়েছি, দেখে নেওয়ার চেষ্টা করেছি জোব চার্নকের এই শহরটি। দুঃখ ছিল মনে, আমাদের মধুকবির সমাধি দেখা হয়নি বলে, বঙ্গে জন্মেও ক্ষণিক এই কবির সমাধির পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ ঘটেনি বলে। মহররমের ছুটির সুযোগে চলে গেলাম পার্ক স্ট্রিট ক্রিশ্চিয়ান বেরিয়াল বোর্ড সমাধিস্থলে (সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি)। মূল ফটকেই জেনে নিয়েছিলাম, সোজা গিয়ে ডান দিকে দেখতে পাব মধু বিশ্রাম কুঞ্জ। এই তো ডান দিকেই মধু বিশ্রাম কুঞ্জ। বাঁ দিকে পথের মুখে একটা আর্চওয়ে, ওপরে লেখা ‘বেথুন বীথি রক্ষণাবেক্ষণে পূর্ত দপ্তর’। একে ইতিহাসের ছাত্রী, তাই নারী বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ। বেথুন নামটিই যথেষ্ট আমার জন্য। মধুকবির প্রতি সম্মান জানিয়ে এগোলাম বাঁ দিকে। দুই ধারে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে আসা ইংরেজদের সমাধি, যার অনেকগুলোই এখন ধ্বংসস্তূপ। দাঁড়ালাম বেথুন সাহেবের সমাধির সামনে। রক্ষণাবেক্ষণের ফলে অক্ষতই সমাধি, কালো মার্বেল পাথরের স্মৃতিফলকটিও বেশ ঝকঝকে, তবে ধুলো আর শুকনো পাতা ঢেকে রেখেছে সমাধির গায়ের লেখাগুলো। পড়ছি সমাধিতে লেখা বাণী; দূর থেকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন এই কবরস্থানের মতোই প্রাচীন এক বৃদ্ধ। বললেন, তিনিই দেখাশোনা করেন এখানকার সমাধিগুলো। শীতের পড়ন্ত বিকেল, আবছায়া কুয়াশায় ইতিহাস যেন চলমান বর্তমান হয়ে ঘটে যেতে থাকে চোখের সামনে।
সেই কবেকার কথা, রাজা রামমোহন রায় সচেষ্ট হয়েছেন ভারতীয় হিন্দু নারীদের মৃত স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়ে মরার মতো পৈশাচিক সতীদাহ প্রথার হাত থেকে রক্ষা করতে। আবার একদল চাইছে এই প্রথাটি বহাল রাখতে। এই নিয়ে লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলে দুই পক্ষই আবেদন করেছে। যাঁরা সতীদাহ প্রথার পক্ষে, তাঁরা তৎকালীন লন্ডনের তরুণ আইনজীবী বিটনকে তাঁদের পক্ষের উকিল নিয়োগ করেন। ভারতবর্ষ সম্পর্কে অজ্ঞ বিটন না জেনেই তাঁদের পক্ষে লড়েন। পরবর্তী সময়ে এর জন্য প্রায়শ্চিত্ত করেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাঙালি মেয়েদের দুঃখ মোচনে ব্রতী থেকে।
আমরা কজনে জানি, সুদূর বিলেতের এক সাহেব তাঁর মায়ের নির্দেশে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ভারতে এসে বাংলার অভাগা মেয়েদের জন্য আমৃত্যু কাজ করেছেন এবং পরম শান্তিতে শুয়ে আছেন এই বাংলাতেই? বেথুন সাহেবের মা ভারতীয় নারীদের সহমরণ নামক অনাচারের কথা জেনেছিলেন, এ বিষয়ে ছেলের ভূমিকা জানতে পেরে হয়েছিলেন বেদনাহত। মায়ের কথাতেই তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে। এ বিষয়ে পড়াশোনা করতে করতেই উপলব্ধি করেন ভারতীয় নারীর জীবন কতটা দুর্বিষহ। মনে-প্রাণে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এই নারীদের দুঃখ মোচনে কী করা যায়, তাই ভেবে। মা নির্দেশ দিলেন, ভারতবর্ষে গিয়ে নারীকল্যাণ ও নারীশিক্ষার ব্যবস্থা করতে। শিক্ষিত হলেই এরা নিজেদের অবস্থা বুঝে নিজেরাই ব্যাধি দূর করতে পারবে। অবশেষে ভারতে আসার সুযোগও পেয়ে গেলেন। ব্রিটিশ ভারতের আইনসচিব হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ১৮৪৮ সালে এসে পৌঁছান কলকাতায়। তারপর ব্রিটিশ-ভারতের অবিভক্ত বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসে লেখা আছে।
প্রাথমিকভাবে মির্জাপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন মেয়েদের জন্য একটি স্কুল। যখন মির্জাপুর থেকে স্কুলটি বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত করা হচ্ছিল, তখন তিনি চেষ্টা করেছিলেন স্কুলটির নামকরণ মহারানি ভিক্টোরিয়ার নাম অনুসারে করার অনুমতি পেতে, কিন্তু সেই অনুমতি তিনি পাননি। আগস্ট ১৮৫১ নতুন স্কুলভবন নির্মাণের কাজ শেষের পথে, তখন বেথুন সাহেব স্কুল পরিদর্শনের কাজে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে শয্যা নেন। সেই শয্যা ছিল তাঁর শেষশয্যা। ১২ আগস্ট ১৮৫১ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু স্কুলটির নামকরণ-সমস্যা দূর করে দেয়। স্কুলটির নাম হলো বেথুন স্কুল। সেপ্টেম্বর ১৮৫১ স্কুলটির নিজস্ব ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়। মৃত্যুর আগে বেথুন তাঁর সব সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন মেয়েদের স্কুলটির জন্য, আর মৃত্যুবরণ করে দিয়ে গেলেন নিজ নামটি। আজ বেথুন কলেজ তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত, কিন্তু এর জনক বেথুন সাহেব যেন হারিয়ে গেছেন ইতিহাস বইয়ের পাতায় আর বেথুন কলেজ প্রাঙ্গণে তাঁর আবক্ষ মূর্তির মধ্যে।
No comments