চরাচর-শব্দের অত্যাচার, নিঃশব্দ ক্ষতি by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
শ্রবণশক্তির ওপর মানুষের কর্মক্ষমতা ও উৎকর্ষ নির্ভরশীল। আমাদের শ্রবণশক্তির নির্দিষ্ট একটি মাত্রা রয়েছে। এর অতিরিক্ত বা উচ্চ স্বরের শব্দ আমাদের শ্রবণযন্ত্রসহ অন্যান্য অভ্যন্তরীণ শারীরিক কার্যকলাপেরও মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে থাকে।
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, শব্দদূষণ বলতে মানুষের বা কোনো প্রাণীর শ্রুতিসীমা অতিক্রমকারী কোনো শব্দ সৃষ্টির কারণে শ্রবণশক্তি হারানোর সম্ভাবনাকে বোঝায়। মানুষ সাধারণত ২০-২০,০০০ ডেসিবেলের কম বা বেশি শব্দ শুনতে পায় না। তাই মানুষের জন্য শব্দদূষণ প্রকৃতপক্ষে এই সীমার মধ্যেই তীব্রতর শব্দ দ্বারা হয়ে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণ ধারণক্ষমতা ৪৫ থেকে ৪৪ ডেসিবল। কিন্তু আমরা প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ থেকে ৫০ গুণ বেশি শব্দ শুনে থাকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ও বিশ্বব্যাংকের একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে, ৩০টি কঠিন রোগের কারণ পরিবেশ দূষণ, যার মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। শ্রবণশক্তি লোপ পাওয়া, মাথা ধরা, উচ্চ রক্তচাপ, নিদ্রাহীনতা, বদমেজাজি ভাব বা মেজাজ খিটখিটে, বিরক্তিবোধ, প্রজনন ক্ষমতাহীনতা, মনোসংযোগ নষ্ট ও ঘুমের অসুবিধা প্রভৃতি। হৃদরোগী এবং গর্ভবতী মায়ের গর্ভের সন্তানের জন্য উচ্চমাত্রার শব্দ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ক্রমাগত শব্দদূষণের ফলে আমরা ধীরে ধীরে কার্যক্ষমতা হারাতে থাকি। যেসব যন্ত্র বা বস্তু দ্বারা শব্দদূষণ হয়ে থাকে, সেগুলো হচ্ছে- মাইক, অ্যাম্প্লিফায়ার, সাইরেন, হর্ন, হুইসেল, বোমাবাজি, তোপধ্বনি, গোলাগুলি প্রভৃতি। এ ছাড়া ড্রিল মেশিন, মিক্সার মেশিন, পাইলিং মেশিন বা কলকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি তো রয়েছেই। আবাসিক এলাকাগুলোয় বা তার আশপাশের এলাকায় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নামে অপ্রয়োজনীয়ভাবে যত্রতত্র অতি উচ্চ স্বরে মাইক বাজিয়ে পরিবেশের ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে। বিয়ের অনুষ্ঠান বা মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত লাইভ কনসার্টগুলো অথবা মেলার নামে সপ্তাহব্যাপী বা মাসব্যাপী দিনরাত গান-বাজনা, মাইকিং প্রভৃতিও শব্দদূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। যানবাহনগুলোতে ট্রাফিক নিয়মনীতি মেনে চলার প্রবণতা নেই বললেই চলে। স্থানীয় বা দূরপাল্লার বাস, মিনিবাস, ট্রাক, প্রাইভেট গাড়ি, এমনকি মোটরবাইকেও যে ধরনের 'দানবীয় হর্ন' আজকাল ব্যবহার করা হচ্ছে, তা মানুষ এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। চালকদের কাছে হর্ন যেন খেলনা! ইচ্ছা হলো পরিবেশ ও পরিস্থিতি না বুঝেই বাজিয়ে দেওয়া হলো। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বা মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হর্ন বাজানো উচিত নয়, সেটা বেমালুম ভুলে যাওয়াও একটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে আজকাল। মাইক ব্যবহার বা উচ্চ শব্দযন্ত্র ব্যবহারের সময় মিটার সংযোজন করার বিধান রাখা হোক। শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী উৎসগুলোকে ভালোভাবে চিহ্নিত করে প্রচারমাধ্যমে শব্দদূষণের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ মাঠ-ময়দান, শহর-গ্রাম কোথায় কত মাত্রায় (ডেসিবল) স্বরবর্ধন করা যাবে, তা বেতার-টিভিতে প্রচার করে সর্বস্তরের জনগণকে অবহিত করলে সবাই উপকৃত হবে। মাইক ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স রাখা বাধ্যতামূলক না করলে জনগণ কোনো ধরনের শব্দদূষণ-সংক্রান্ত সুফল কোনো দিন পাবে না। শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী প্রতিটি উৎস ভালোভাবে চিহ্নিত করে নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নিয়ম ভঙ্গকারীদের কঠোর সাজা দিতে হবে। আমাদের করণীয় বিষয়গুলো হতে পারে এই যে- প্রথমে আমরা যেন সচেতন হই, নিজেরা কোনোভাবেই আমাদের চারপাশের পরিবেশকে শব্দ দ্বারা দূষণের শিকার হতে দিই না এবং অন্যকেও শব্দদূষণ রোধে উৎসাহিত করি। আমাদের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতার জন্য শব্দদূষণের দানবীয় হুংকারে প্রাকৃতিক স্বাভাবিক ভারসাম্য আজ অনেকটাই বিনষ্ট হয়ে পড়ছে। তাই শব্দদূষণ বিষয়টিকে এখন আর অপরাধ না বলে ভাববার কোনো অবকাশ নেই।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
No comments