নাগরিক অধিকার-নিরপেক্ষতার দায় ও বিচারবহির্ভূত হত্যা by মোজাম্মেল খান

কয়েক বছর আগে আমি যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিককে টেলিফোন করেছিলাম, যাঁর লেখার বস্তুনিষ্ঠতা আমাকে খুবই আকৃষ্ট করত। জানতে চেয়েছিলাম কেন তিনি তাঁর বিশ্লেষণে দুই নেত্রীর মাঝে একজনের প্রতি খুবই দুর্বল, যেটা যেকোনো পাঠকের চোখে সহজভাবেই ধরা পড়ে।


তাঁর উত্তর আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। তিনি অন্যজনের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘উনি আমার প্রতি আঙুল উঁচিয়ে কথা বলেছিলেন, যেটা আমি কোনো দিন ভুলব না।’ তাঁর নিরপেক্ষতাহীনতার কারণ জেনে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার যে অবনতি ঘটেছিল, সেটা এখনো ফিরে আসেনি।
রাজনৈতিক নিবন্ধকার হিসেবে আমি নিজেও আমার নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেক পাঠকের প্রশ্নের সম্মুখীন হই। অনেকে মন্তব্য করেন, আমি প্রধান দুটি রাজনৈতিক স্রোতের একটির প্রতি দুর্বল। আমার উত্তর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একজন নিরবচ্ছিন্ন ধারক হিসেবে, যে চেতনা আমাকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়, আমার সহজাত মিত্র সেই রাজনৈতিক ধারা, যাঁরা এখনো সেই চেতনার প্রতি তাঁদের আনুগত্য ও বিশ্বাস প্রচার করে চলেছেন, তাঁদের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশে লজ্জার কিছু নেই। উপরন্তু দেশের রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ হিসেবে বিভক্ত। আশ্চর্যের ব্যাপার, এমন একটি কলঙ্কময় বিশেষণে আখ্যায়িত হওয়া সত্ত্বেও ওই ধারা থেকে গুরুতর কোনো প্রতিবাদ শোনা যায়নি।
প্রায় আটত্রিশ বছর দেশের বাইরে থাকা সত্ত্বেও দেশ নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে চলেছি। এ লেখালেখি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে ইন্টারনেটে দেশের পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে। আমার লেখার সিংহভাগেই বিএনপির সমালোচনা করেছি দুটো কারণে; প্রথমত, ওই দলটি বেশির ভাগ সময় ক্ষমতায় ছিল, আর দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ওই দলটি সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সেটা অপরিবর্তনীয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ধারাটি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আমার লেখায় তাদের কাজের সমালোচনা করেছি। যেহেতু তারা পঁচাত্তরের আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার পর দীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় এসেছিল এবং সংসদে তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল না, আমার সমালোচনা ছিল উপদেশমূলক, রুক্ষ নয়। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে যে অভূতপর্ব জনসমর্থন নিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রতি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিধি স্বাভাবিকভাবেই অনেক বিস্তৃত।
মহাজোট সরকার গঠনের পর যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, কবে দেশে ফিরে যাচ্ছি। প্রথম দিকে আমি এ ধরনের প্রশ্নের মর্ম বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছি, অনেকেই ধারণা করেছিল, আমার লেখনীর মাধ্যমে এবং বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে তৎপরতা চালিয়েছি, তাতে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে যে উপকার সাধিত হয়েছে, তার বিনিময়ে হয়তো বর্তমান সরকার কোনো পদ দিয়ে আমাকে পুরস্কৃত করবে, আমি সে আশা করছি। হয়তো অনেককেই বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে একজন অরাজনৈতিক, অসাংবাদিক এবং কানাডার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন প্রকৌশলবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে আমি যা করছি, তা সম্পূর্ণভাবেই আমার বিবেকের দায়বদ্ধতার কারণে আমার প্রিয় মাতৃভূমিতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অকৃত্রিম বাসনা নিয়ে।
গত দুই বছরে আমি অনেক নিবন্ধ লিখেছি, যেগুলোতে বর্তমান সরকারের কিছু কাজকর্মের ও নীতির সমালোচনা করেছি। আমার পাঠকদের কাছ থেকে আমি তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। প্রথমে গ্রুপে আছেন এমন সব পাঠক, যাঁরা আওয়ামী লীগের নিঃস্বার্থ শুভানুধ্যায়ী এবং চান সুশাসনের মাধ্যমে আবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসুক। দ্বিতীয় গ্রুপে আছেন তাঁদের ধারণা, আমি সরকারের কাছ থেকে কোনো পুরস্কার পায়নি বলেই তাদের সমালোচনা করছি, যদিও তাঁরা জানেন, আমি পৃথিবীর সেরা পেশায় (আমার বিশ্বাস) নিয়োজিত আছি। তৃতীয় গ্রুপে আছেন এমন সব মানুষ, যাঁরা আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক এবং যাঁদের অনেকের সঙ্গে আমি অতীতে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একসঙ্গে কাজ করেছি। আমার ইদানীংকার কয়েকটি লেখায় এবং গত মাসে টরন্টোয় অনুষ্ঠিত কয়েকটি বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় আমি সরকারের কিছু কাজের সমালোচনা করেছি। এতে তৃতীয় গ্রুপের পাঠকেরা উপসংহার টানছেন আমার সমালোচনা শুধু সরকারের বিরুদ্ধে যারা ‘ষড়যন্ত্র’ করছে, তাদের হাতকেই শক্তিশালী করছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে স্থানীয় (টরন্টো) আওয়ামী লীগ আয়োজিত এমনই একটা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে আমার বক্তৃতার শেষে একজন তরুণ আওয়ামী লীগ-সমর্থক আমার কাছে এসে অতীব দুঃখের সঙ্গে জানালেন যে আমি নাকি প্রধানমন্ত্রীর স্থানীয় আত্মীয়দের অপছন্দের তালিকায় স্থান করে নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়দের মধ্যে শুধু একজনকে আমি জানি (যাঁর ভাই বর্তমানে একজন মন্ত্রী), যাঁরা স্বামী-স্ত্রী আমাদের পারিবারিক বন্ধু এবং ত্রিশ বছরের বেশি সময় টরন্টোতে বসবাস করছেন। তাঁরা সম্পূর্ণভাবেই অরাজনৈতিক এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতি তাঁদের কোনো দুর্বলতা কোনো দিনও প্রকাশ পায়নি। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রীর কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে আমার কোনো দিন দেখা হয়নি কিংবা জনাব শামস কিবরিয়ার নৃশংস হত্যা, শেখ হাসিনাসহ রাজবন্দীদের মুক্তি বা বঙ্গবন্ধুর এক ঘাতকের কানাডায় প্রবেশে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদে শত শত প্রতিবাদকারীর সঙ্গে টরন্টোর রাস্তায় যখন প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম, তখন তাঁদের কাউকে সেখানে দেখতে পাইনি। তরুণ আওয়ামী লীগ-সমর্থক আরও জানালেন যে আমার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনেক অভিযোগ পাঠানো হয়েছে। আমি হেসে তাঁকে বললাম, আমি (বাংলাদেশ) প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী নই কিংবা আওয়ামী লীগের কোনো সদস্যও নই। তবে আমার বিরুদ্ধবাদীরা যদি আমি কোন ব্যাপারে সরকারের সমালোচনা করছি, সেটা যদি অবিকল প্রধানমন্ত্রীকে জানান, তাহলে তাঁর সরকার উপকৃত হতে পারে।
২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতশাসিত বাংলাদেশের অন্ধকার রাজত্বে মানবাধিকার; বিশেষ করে, ‘ক্রসফায়ার’-এর নামে যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছিল, সে ব্যাপারে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করার প্রয়াসে কানাডিয়ান কমিটি অব হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। ওই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার একপর্যায়ে উপস্থিত একজন দর্শক আমাকে প্রশ্ন করলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পরও যদি একই ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকে, তবে আমরা তার প্রতিবাদ করব কি না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য পূর্ববর্তী সরকারকে দোষারোপ করে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এটা বন্ধ করার সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। অপ্রতিহতভাবে চলছে এ হত্যাকাণ্ড। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ১৩৩ জন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা এটাকে সমর্থন করে আগের সরকারের মন্ত্রীদের দেওয়া যুক্তিরই প্রতিধ্বনি করে চলেছেন।
রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন বিএনপি-জামায়াত সরকার চালু করেছিল, যেটা বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আরও তীব্রতর হয়েছিল। বিগত বছরগুলোতে বিএনপি-জামায়াত সরকার এ নিষ্ঠুর প্রথা চালু করার পর থেকে আজ অবধি এমন কোনো প্রমাণ নেই যে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা স্বীকারোক্তির মাধ্যমে কোনো মামলা দাঁড় করানো হয়েছে, যে মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতের বিচারে দণ্ডিত হয়েছেন। আজকে যদি কেউ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এবং সংবিধানে রক্ষিত নাগরিকের আইনগত অধিকার সমুন্নত রাখায় বর্তমান সরকারের দুই বছরের কার্যক্রমকে বিগত নির্বাচিত সরকারের কার্যক্রমের সঙ্গে তুলনা করেন, তবে সেটা হবে এক আশাভঙ্গের খতিয়ান। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিনবদলের সনদ’-এ বদল খুব কমই প্রতীয়মান হবে।
ড. মোজাম্মেল খান: অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, শেরিডান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, টরন্টো, কানাডা।

No comments

Powered by Blogger.