কালের পুরাণ-‘মিডিয়া এত হইচই করছে কেন’? by সোহরাব হাসান
বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের মতো বর্তমান মহাজোট সরকারও মনে করে, দেশে কোনো সমস্যা নেই, সংকট নেই। যেসব সংকটের কথা বলা হচ্ছে, তার সবই গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সৃষ্টি। এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর একটি উক্তি মনে পড়ছে।
সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই নামের এক জঙ্গি যখন গোটা রাজশাহী অঞ্চলে মানুষ হত্যা ও গুম করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাইয়ের অস্তিত্ব নেই, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি।’ পরবর্তীকালে বিএনপি-জামায়াত সরকারই বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তার করে প্রমাণ করে যে, তিনি মিডিয়ার সৃষ্টি নন।
কয়েক দিন আগে এক সামাজিক অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন বড় দলের কয়েকজন ছোট নেতার সঙ্গে দেখা হতেই জবাবদিহি চাওয়ার সুরে বললেন, ‘আপনারা পেয়েছেনটা কী? ইলিয়াস আলীর মতো একজন বিতর্কিত ও কালিমালিপ্ত নেতাকে নিয়ে মিডিয়া এত হইচই করছে কেন?’
ইলিয়াস আলী কতটা বিতর্কিত ও কালিমালিপ্ত, সেই বিতর্ক করার সময় এখন নয়। তিনি নিখোঁজ হয়েছেন, সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব তাঁকে খুঁজে বের করা। সাংবাদিকেরা যদি ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার খবর পত্রিকায় লিখে থাকেন কিংবা টিভির টক শোতে তাঁকে নিয়ে কিছু বলে থাকেন, তাতে দোষের কী আছে? সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার মামলায় জয়ী না হলে যেমন শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেওয়া যেত না, তেমনি ইলিয়াস আলী অপহূত না হলে সাংবাদিকেরা তাঁকে নিয়ে খবর লেখারও সুযোগ পেতেন না। সাংবাদিকেরা খবর তৈরি করেন না, তাঁরা কিছু ঘটলে মানুষকে জানান। কোন ঘটনার খবর কীভাবে লেখা হবে, সেই দায়িত্ব রাজনীতিকেরা নিলে দেশে সংবাদপত্র বলে কিছু থাকবে না, যা থাকবে তা হলো সরকারি প্রচারপত্র এবং তাতে কেবল সরকারের প্রশংসা থাকবে, সমালোচনা থাকবে না। সরকার ভুল করলেও বলতে হবে ‘আহ্ বেশ বেশ’।
আমরা বুঝতে অক্ষম, এ রকম একজন ‘বিতর্কিত ও কালিমালিপ্ত’ নেতাকে নিয়ে সরকারি মহল এত দিন নিশ্চুপ ছিল কেন; কেন তাঁর নামে একটি মামলা পর্যন্ত করল না; কেন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো না। আর এখন তাঁর নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, দলের সাধারণ সম্পাদক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে তাঁকে জীবিত বের করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছেন। দলের নেতারা, মন্ত্রীরা প্রায় প্রতিদিনই ইলিয়াস আলী সম্পর্কে কথা বলে যাচ্ছেন। বিরোধী দল একের পর এক হরতাল ডাকছে। কঠোর কর্মসূচির হুমকি দিচ্ছে। সেসব কিছুই না! সাংবাদিকেরা এ নিয়ে কিছু লিখলেই দোষ, কিছু বললেই মহা অপরাধ!
আওয়ামী লীগের ওই নেতারা দাবি করেছেন, সাংবাদিকেরা পত্রিকায় লিখে লিখে নাকি ইলিয়াস আলীকে ‘জাতীয় নেতা’ বানিয়ে দিয়েছেন। কীভাবে? সাংবাদিকেরা বড় নেতা বানাতে চাইলে তিন বছর ধরেই তাঁকে নিয়ে লেখালেখি করতেন। ইলিয়াস আলীকে তাঁরাই বড় নেতা বানিয়েছেন, যাঁরা তাঁকে রাতের অন্ধকারে চালকসহ গুম করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি অনুযায়ী এটি যদি সরকারের বিরুদ্ধে মহা ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে থাকে, তা উদ্ঘাটন করার দায়িত্বও সরকারের।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অতি বিজ্ঞ নেতারা কথায় কথায় বিএনপি আমলে কতজন খুন ও গুম হয়েছে, বোমা ও গ্রেনেড মেরে কতজন মানুষ হত্যা করা হয়েছে এবং বিরোধী দল ও সংখ্যালঘুদের ওপর কী অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে, সেই প্রসঙ্গ টানেন। তাঁরা এও বলতে চান যে, তখন সাংবাদিকেরা চুপ করে ছিলেন। তাঁদের এই অভিযোগ সত্য হলে আমরা কাঠগড়ায় দাঁড়াতে রাজি আছি। কিন্তু জোরালো কণ্ঠে বলছি, তাঁরা প্রমাণ দিতে পারবেন না। বিএনপি আমলে সাংবাদিকেরা চুপ থাকলে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় ‘জজ মিয়া কাহিনি’ প্রকাশিত হলো কীভাবে? জঙ্গিদের সঙ্গে বিএনপির মন্ত্রী-নেতাদের যোগসাজশের ঘটনাও প্রথম ফাঁস করেন সাংবাদিকেরা। এখন আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীরা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সম্পর্কে যেসব মনগড়া অভিযোগ করেন, বিএনপির আমলে তাঁদের নেতা-নেত্রীরাও অবিকল সেসব অভিযোগ করতেন। কে বলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো মিল নেই? বাংলাদেশে কোনো দলই জনমতকে তোয়াক্কা করে না। তারা তোয়াক্কা করে ক্ষমতাধর ‘বন্ধু দেশ’কে।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর আর সারা দেশে বিএনপির ক্যাডাররা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালালে, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিলে সাংবাদিকেরা কি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই খবর পত্রিকায় প্রকাশ করেননি? বিএনপি আমলে যখন চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা জামালউদ্দিন নিখোঁজ হন, তখন কি সংবাদপত্রে এ নিয়ে দিনের পর দিন লেখালেখি হয়নি? প্রেসক্লাবের সামনে জামালউদ্দিনের সন্তানদের অবস্থান কর্মসূচি যখন সরকারের পুলিশ বাহিনী পণ্ড করে দেয়, সচিত্র সেই খবরও কি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি? ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যখন দলীয় কর্মী ও আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের ‘ক্ষুধার্ত বাঘের’ মুখে রেখে আওয়ামী লীগের জাঁদরেল নেতারা নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন কিন্তু এই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরাই এগিয়ে এসেছিলেন। আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে ২০০২ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের পুস্তিকাগুলো তাঁরা একবার দেখে নিতে পারেন। সে সময় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরা আওয়ামী লীগের ‘পরম বন্ধু’ ছিলেন। এখন তাঁরা ‘চরম শত্রু’ হয়ে গেছেন। সমস্যা হলো, রাজনীতিকেরা পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসে আগের পাঁচ বছরের কথা বেমালুম ভুলে যান। কিন্তু সাংবাদিকদের সব আমলের কথাই মনে রাখতে হয়। তাঁরা সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতেই অভ্যস্ত।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে চাইছেন, ‘মিডিয়ার সৃষ্টি ইলিয়াস আলী সংকট’ ছাড়া দেশে আর কোনো সংকট নেই। তাঁদের এই দাবি সত্য হলে দেশের মানুষ নিশ্চিন্ত হতে পারত। কিন্তু সরকারের দাবি ও বাস্তব যে যোজন যোজন দূরে চলে যাচ্ছে, সে বিষয়টি ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা মনে রাখেন না।
এই সরকারের মেয়াদ তিন বছর চার মাস পার হতে চলেছে। সংবিধান অনুযায়ী পাঁচ বছর মেয়াদের তিন মাস বাকি থাকতেই তারা নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। কার অধীনে নির্বাচন হবে সেই বিতর্কে এখন যাচ্ছি না। আমরা বলতে চাইছি, এই তিন বছর চার মাসে সরকার কী করেছে, আর এক বছর দুই মাসে কী কী করবে। সে ক্ষেত্রে আমরা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রতি আরেকবার আলোকপাত করে নিই।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রথম পাঁচ অগ্রাধিকার ছিল: দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-সংকট দূর, দারিদ্র্য ঘোচানো ও বৈষম্য হ্রাস এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এখন সুশাসন দূরের কথা, সরকারের শাসনব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সব ক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ঘেরাও করছেন শিক্ষকেরা, ছাত্ররা চড়াও হচ্ছে শিক্ষকদের ওপর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সরকারি দলের সাংসদেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী লা-জবাব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মহাজোটের শরিক দলের একজন প্রভাবশালী সাংসদ নিজে গুম হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। একটার পর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা চলছে। বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানা অর্ধবেলা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কৃষির সেচ ব্যাহত হচ্ছে। জনজীবন অতিষ্ঠ। তাহলে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের সাফল্য গেল কোথায়?
মহা শোরগোল তুলে অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের কাছ থেকে যে ১০০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার কথা ছিল, তারও বেশ কিছু প্রকল্প আটকে গেছে। দিল্লির সঙ্গে তিন বছর দেনদরবার করেও সরকার তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি করতে পারেনি। সীমান্তবিরোধ নিষ্পত্তি ও ছিটমহল বিনিময়ে প্রটোকল সই করলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। দেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত উপাচার্য নেই। আড়াই মাসেও সাংবাদিক সাগর-রুনির ঘাতকদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এখন আদালত সেই দায়িত্ব র্যাবের হাতে ন্যস্ত করেছেন। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বরং কাউকে কাউকে পুরস্কৃত করেছে বলে অভিযোগ আছে।
সরকার জাতীয় সংসদকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু করার কথা বললেও গত তিন বছরে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সেখানে তেমন আলোচনা হয়নি। একজন প্রতিমন্ত্রী পাঁচ মাসের মাথায় পদত্যাগ করলেও বিষয়টি সরকার ঝুলিয়ে রেখেছিল। এখন তিনি সংসদ সদস্য পদ থেকেও পদত্যাগ করেছেন। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা সরকার ভর্তুকি দিলেও লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় মানুষ বিপর্যস্ত। সিভিল প্রশাসন এখন প্রায় দলীয় প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। সরকার সোল্লাসে ঘোষণা দিয়েছিল, তিন মাসের মধ্যে বিভক্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করবে। এখন ছয় মাস অতিক্রান্ত হলেও সেই নির্বাচনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সর্বশেষ বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে। এখন ঢাকার অধিকাংশ বাসিন্দা বিশ্বাস করে, সরকার নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখার জন্য যথাসময়ে ওয়ার্ডগুলোর সীমানা নির্ধারণ করেনি, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি।
ক্ষমতাসীন দলের মহাবিজ্ঞ নেতারা কি বলবেন, এসবও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরা আটকে রেখেছেন?
আওয়ামী লীগ দিনবদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু তিন বছর চার মাস পর দেশবাসীর দৃশ্যগ্রাহ্য দিনবদল হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের নেতাদের, মন্ত্রীদের দিন ঠিকই বদল হয়েছে। ক্ষমতায় আসার আগে কার কী অবস্থা ছিল, এখন তাঁরা কী অবস্থায় আছেন, তা কারও অজানা নয়। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের (বর্তমানে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী) এপিএসের গাড়িতে যে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে মন্ত্রী জড়িত কি না, সেটি প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু এই একটি ঘটনাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ ও দুর্নীতি কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের এখন আর জোর গলায় বলার উপায় নেই যে, ‘ওরা সব দুর্নীতিবাজ, আর আমরা ধোয়া তুলসীপাতা।’ এ ক্ষেত্রে ‘জনবিরোধী’ বিএনপি সরকারের সঙ্গে ‘জনদরদি’ আওয়ামী লীগ সরকারের ফারাক একেবারেই লোপ পেতে বসেছে।
হ্যাঁ, ফারাকটি নিশ্চিত করা যেত যদি প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সব মন্ত্রী ও সাংসদের আয় ও সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করতেন। কেন করলেন না?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
কয়েক দিন আগে এক সামাজিক অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন বড় দলের কয়েকজন ছোট নেতার সঙ্গে দেখা হতেই জবাবদিহি চাওয়ার সুরে বললেন, ‘আপনারা পেয়েছেনটা কী? ইলিয়াস আলীর মতো একজন বিতর্কিত ও কালিমালিপ্ত নেতাকে নিয়ে মিডিয়া এত হইচই করছে কেন?’
ইলিয়াস আলী কতটা বিতর্কিত ও কালিমালিপ্ত, সেই বিতর্ক করার সময় এখন নয়। তিনি নিখোঁজ হয়েছেন, সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব তাঁকে খুঁজে বের করা। সাংবাদিকেরা যদি ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার খবর পত্রিকায় লিখে থাকেন কিংবা টিভির টক শোতে তাঁকে নিয়ে কিছু বলে থাকেন, তাতে দোষের কী আছে? সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার মামলায় জয়ী না হলে যেমন শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেওয়া যেত না, তেমনি ইলিয়াস আলী অপহূত না হলে সাংবাদিকেরা তাঁকে নিয়ে খবর লেখারও সুযোগ পেতেন না। সাংবাদিকেরা খবর তৈরি করেন না, তাঁরা কিছু ঘটলে মানুষকে জানান। কোন ঘটনার খবর কীভাবে লেখা হবে, সেই দায়িত্ব রাজনীতিকেরা নিলে দেশে সংবাদপত্র বলে কিছু থাকবে না, যা থাকবে তা হলো সরকারি প্রচারপত্র এবং তাতে কেবল সরকারের প্রশংসা থাকবে, সমালোচনা থাকবে না। সরকার ভুল করলেও বলতে হবে ‘আহ্ বেশ বেশ’।
আমরা বুঝতে অক্ষম, এ রকম একজন ‘বিতর্কিত ও কালিমালিপ্ত’ নেতাকে নিয়ে সরকারি মহল এত দিন নিশ্চুপ ছিল কেন; কেন তাঁর নামে একটি মামলা পর্যন্ত করল না; কেন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো না। আর এখন তাঁর নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, দলের সাধারণ সম্পাদক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে তাঁকে জীবিত বের করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছেন। দলের নেতারা, মন্ত্রীরা প্রায় প্রতিদিনই ইলিয়াস আলী সম্পর্কে কথা বলে যাচ্ছেন। বিরোধী দল একের পর এক হরতাল ডাকছে। কঠোর কর্মসূচির হুমকি দিচ্ছে। সেসব কিছুই না! সাংবাদিকেরা এ নিয়ে কিছু লিখলেই দোষ, কিছু বললেই মহা অপরাধ!
আওয়ামী লীগের ওই নেতারা দাবি করেছেন, সাংবাদিকেরা পত্রিকায় লিখে লিখে নাকি ইলিয়াস আলীকে ‘জাতীয় নেতা’ বানিয়ে দিয়েছেন। কীভাবে? সাংবাদিকেরা বড় নেতা বানাতে চাইলে তিন বছর ধরেই তাঁকে নিয়ে লেখালেখি করতেন। ইলিয়াস আলীকে তাঁরাই বড় নেতা বানিয়েছেন, যাঁরা তাঁকে রাতের অন্ধকারে চালকসহ গুম করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি অনুযায়ী এটি যদি সরকারের বিরুদ্ধে মহা ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে থাকে, তা উদ্ঘাটন করার দায়িত্বও সরকারের।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অতি বিজ্ঞ নেতারা কথায় কথায় বিএনপি আমলে কতজন খুন ও গুম হয়েছে, বোমা ও গ্রেনেড মেরে কতজন মানুষ হত্যা করা হয়েছে এবং বিরোধী দল ও সংখ্যালঘুদের ওপর কী অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে, সেই প্রসঙ্গ টানেন। তাঁরা এও বলতে চান যে, তখন সাংবাদিকেরা চুপ করে ছিলেন। তাঁদের এই অভিযোগ সত্য হলে আমরা কাঠগড়ায় দাঁড়াতে রাজি আছি। কিন্তু জোরালো কণ্ঠে বলছি, তাঁরা প্রমাণ দিতে পারবেন না। বিএনপি আমলে সাংবাদিকেরা চুপ থাকলে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় ‘জজ মিয়া কাহিনি’ প্রকাশিত হলো কীভাবে? জঙ্গিদের সঙ্গে বিএনপির মন্ত্রী-নেতাদের যোগসাজশের ঘটনাও প্রথম ফাঁস করেন সাংবাদিকেরা। এখন আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীরা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সম্পর্কে যেসব মনগড়া অভিযোগ করেন, বিএনপির আমলে তাঁদের নেতা-নেত্রীরাও অবিকল সেসব অভিযোগ করতেন। কে বলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো মিল নেই? বাংলাদেশে কোনো দলই জনমতকে তোয়াক্কা করে না। তারা তোয়াক্কা করে ক্ষমতাধর ‘বন্ধু দেশ’কে।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর আর সারা দেশে বিএনপির ক্যাডাররা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালালে, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিলে সাংবাদিকেরা কি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই খবর পত্রিকায় প্রকাশ করেননি? বিএনপি আমলে যখন চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা জামালউদ্দিন নিখোঁজ হন, তখন কি সংবাদপত্রে এ নিয়ে দিনের পর দিন লেখালেখি হয়নি? প্রেসক্লাবের সামনে জামালউদ্দিনের সন্তানদের অবস্থান কর্মসূচি যখন সরকারের পুলিশ বাহিনী পণ্ড করে দেয়, সচিত্র সেই খবরও কি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি? ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যখন দলীয় কর্মী ও আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের ‘ক্ষুধার্ত বাঘের’ মুখে রেখে আওয়ামী লীগের জাঁদরেল নেতারা নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন কিন্তু এই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরাই এগিয়ে এসেছিলেন। আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে ২০০২ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের পুস্তিকাগুলো তাঁরা একবার দেখে নিতে পারেন। সে সময় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরা আওয়ামী লীগের ‘পরম বন্ধু’ ছিলেন। এখন তাঁরা ‘চরম শত্রু’ হয়ে গেছেন। সমস্যা হলো, রাজনীতিকেরা পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসে আগের পাঁচ বছরের কথা বেমালুম ভুলে যান। কিন্তু সাংবাদিকদের সব আমলের কথাই মনে রাখতে হয়। তাঁরা সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতেই অভ্যস্ত।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে চাইছেন, ‘মিডিয়ার সৃষ্টি ইলিয়াস আলী সংকট’ ছাড়া দেশে আর কোনো সংকট নেই। তাঁদের এই দাবি সত্য হলে দেশের মানুষ নিশ্চিন্ত হতে পারত। কিন্তু সরকারের দাবি ও বাস্তব যে যোজন যোজন দূরে চলে যাচ্ছে, সে বিষয়টি ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা মনে রাখেন না।
এই সরকারের মেয়াদ তিন বছর চার মাস পার হতে চলেছে। সংবিধান অনুযায়ী পাঁচ বছর মেয়াদের তিন মাস বাকি থাকতেই তারা নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। কার অধীনে নির্বাচন হবে সেই বিতর্কে এখন যাচ্ছি না। আমরা বলতে চাইছি, এই তিন বছর চার মাসে সরকার কী করেছে, আর এক বছর দুই মাসে কী কী করবে। সে ক্ষেত্রে আমরা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রতি আরেকবার আলোকপাত করে নিই।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রথম পাঁচ অগ্রাধিকার ছিল: দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-সংকট দূর, দারিদ্র্য ঘোচানো ও বৈষম্য হ্রাস এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এখন সুশাসন দূরের কথা, সরকারের শাসনব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সব ক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ঘেরাও করছেন শিক্ষকেরা, ছাত্ররা চড়াও হচ্ছে শিক্ষকদের ওপর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সরকারি দলের সাংসদেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী লা-জবাব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মহাজোটের শরিক দলের একজন প্রভাবশালী সাংসদ নিজে গুম হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। একটার পর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা চলছে। বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানা অর্ধবেলা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কৃষির সেচ ব্যাহত হচ্ছে। জনজীবন অতিষ্ঠ। তাহলে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের সাফল্য গেল কোথায়?
মহা শোরগোল তুলে অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের কাছ থেকে যে ১০০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার কথা ছিল, তারও বেশ কিছু প্রকল্প আটকে গেছে। দিল্লির সঙ্গে তিন বছর দেনদরবার করেও সরকার তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি করতে পারেনি। সীমান্তবিরোধ নিষ্পত্তি ও ছিটমহল বিনিময়ে প্রটোকল সই করলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। দেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত উপাচার্য নেই। আড়াই মাসেও সাংবাদিক সাগর-রুনির ঘাতকদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এখন আদালত সেই দায়িত্ব র্যাবের হাতে ন্যস্ত করেছেন। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বরং কাউকে কাউকে পুরস্কৃত করেছে বলে অভিযোগ আছে।
সরকার জাতীয় সংসদকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু করার কথা বললেও গত তিন বছরে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সেখানে তেমন আলোচনা হয়নি। একজন প্রতিমন্ত্রী পাঁচ মাসের মাথায় পদত্যাগ করলেও বিষয়টি সরকার ঝুলিয়ে রেখেছিল। এখন তিনি সংসদ সদস্য পদ থেকেও পদত্যাগ করেছেন। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা সরকার ভর্তুকি দিলেও লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় মানুষ বিপর্যস্ত। সিভিল প্রশাসন এখন প্রায় দলীয় প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। সরকার সোল্লাসে ঘোষণা দিয়েছিল, তিন মাসের মধ্যে বিভক্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করবে। এখন ছয় মাস অতিক্রান্ত হলেও সেই নির্বাচনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সর্বশেষ বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে। এখন ঢাকার অধিকাংশ বাসিন্দা বিশ্বাস করে, সরকার নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখার জন্য যথাসময়ে ওয়ার্ডগুলোর সীমানা নির্ধারণ করেনি, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি।
ক্ষমতাসীন দলের মহাবিজ্ঞ নেতারা কি বলবেন, এসবও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরা আটকে রেখেছেন?
আওয়ামী লীগ দিনবদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু তিন বছর চার মাস পর দেশবাসীর দৃশ্যগ্রাহ্য দিনবদল হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের নেতাদের, মন্ত্রীদের দিন ঠিকই বদল হয়েছে। ক্ষমতায় আসার আগে কার কী অবস্থা ছিল, এখন তাঁরা কী অবস্থায় আছেন, তা কারও অজানা নয়। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের (বর্তমানে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী) এপিএসের গাড়িতে যে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে মন্ত্রী জড়িত কি না, সেটি প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু এই একটি ঘটনাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ ও দুর্নীতি কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের এখন আর জোর গলায় বলার উপায় নেই যে, ‘ওরা সব দুর্নীতিবাজ, আর আমরা ধোয়া তুলসীপাতা।’ এ ক্ষেত্রে ‘জনবিরোধী’ বিএনপি সরকারের সঙ্গে ‘জনদরদি’ আওয়ামী লীগ সরকারের ফারাক একেবারেই লোপ পেতে বসেছে।
হ্যাঁ, ফারাকটি নিশ্চিত করা যেত যদি প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সব মন্ত্রী ও সাংসদের আয় ও সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করতেন। কেন করলেন না?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments