অটিজম-ওরা সব বোঝে by আবিদা সুলতানা
সে মুহূর্তে আমি আমার ব্যথা ভুলে গেলাম এবং আমার মনে হলো 'অটিজম' শিশুরা সবকিছু বোঝে; কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। আর প্রকাশ করতে পারে না বলেই হয়তো অটিজম শিশুরা রাগকেও দমন করতে পারে না। আমরাই বুঝি না যে ওরা সবকিছু বোঝে।
অনেক সময় আমরা ওদের সামনে সবকিছু বলি এবং ওদের খারাপ দিকগুলো অন্যের সঙ্গে আলোচনা করি তখন ওদের কতটা খারাপ লাগে তা ওরাই জানে, যেমন আমাকে যদি কেউ আমার সামনে সব সময় আমার দুর্বল দিক নিয়ে আলোচনা করে, তাহলে আমার যেমন খারাপ লাগবে ওদেরও তেমন লাগে। এরপর এলাম সিনিয়র-৩-এ। সিনিয়র-৩-এ এসে আমি মুগ্ধ, কারণ এখানকার বাচ্চাদের এত গুণ
২০০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি 'সোয়াকে' যেদিন প্রথম গেলাম সেদিন একটু ধাক্কা খেলাম। কারণ নতুন একটি বিষয় সম্পর্কে জানলাম। আর তা হলো 'অটিজম'। এর আগে আমার এক দূরসম্পর্কের খালাকে দেখতাম, তার অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। ছোটবেলা থেকে তাকে দেখলেই আমার মনের ভেতর কোথায় যেন এক অনুভূতি কাজ করত। যা হোক, সোয়াকে গিয়ে 'অটিজম' সম্পর্কে জানলাম। বিশেষ শিশুদের কীভাবে শিক্ষাদান করতে হয়, কীভাবে তাদের ম্যানেজ করতে হয়, কীভাবে শান্ত করতে হয়। আমাকে দেওয়া হলো সিনিয়র ১ সেকশনে। সিনিয়র-১-এ ছিল সাতজন ছাত্র_ ১. নাফি ২. অয়ন ৩. সজল ৪ ফারাজ ৫ দীপন ৬. সামীন ও ৭. ত্বাহা। এদের মধ্যে নাফি বেশ অস্থির। আমি নাফিকে নিয়ে কাজ শুরু করলাম। নাফির কাজই হলো ক্লাস থেকে বের হয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে চা খাওয়া। আমাদের নিয়ম থাকত একবারের বেশি চা খেতে না দেওয়া। কিন্তু নাফি সুযোগ খুঁজত কীভাবে ক্যান্টিনে যাবে। একদিনের কথা বলি, আমি নাফির হাত দুটি ব্লক করে নাফির সামনে বসে আছি, হঠাৎ নাফি জোরে খামচি দিল এবং অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। নাফি বোঝাতে চাইছে সে অন্যায় করেছে। নাফি অনুতপ্ত। আমার হাতে রক্ত পড়া দেখে নাফি তাতে 'ফুঁ' দিচ্ছে। সে মুহূর্তে আমি আমার ব্যথা ভুলে গেলাম এবং আমার মনে হলো 'অটিজম' শিশুরা সবকিছু বোঝে; কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। আর প্রকাশ করতে পারে না বলেই হয়তো অটিজম শিশুরা রাগকেও দমন করতে পারে না। আমরাই বুঝি না যে ওরা সবকিছু বোঝে। অনেক সময় আমরা ওদের সামনে সবকিছু বলি এবং ওদের খারাপ দিকগুলো অন্যের সঙ্গে আলোচনা করি তখন ওদের কতটা খারাপ লাগে তা ওরাই জানে, যেমন আমাকে যদি কেউ আমার সামনে সব সময় আমার দুর্বল দিক নিয়ে আলোচনা করে, তাহলে আমার যেমন খারাপ লাগবে ওদেরও তেমন লাগে। এরপর এলাম সিনিয়র-৩-এ। সিনিয়র-৩-এ এসে আমি মুগ্ধ, কারণ এখানকার বাচ্চাদের এত গুণ! আনন্দের কথা, ওদের হাতের লেখা এত সুন্দর। আর আদিত তো যে কোনো দিন কী বার তা বলে দিতে পারে, এদের প্রত্যেকের একাডেমিক লেবেল ভালো। ওদের কথা এত সুন্দর, এত গোছানো, ওরা এত বেশি জানে সত্যিই ওরা 'দেব' শিশু। এরপর ২০০৯ সালে 'প্রয়াস'-এ এলাম। এসেই ডালিয়া ক্লাসে নামিরাকে পেলাম। নামিরা ছিল অস্থির প্রকৃতির, নামিরার অস্থিরতার পরও আমরা নামিরাকে বলতাম নামিরা ভালো মেয়ে, এ কথায় নামিরা চোখ তুলে তাকাত এবং মুখের কোণে মিষ্টি এক হাসি থাকত। এতে বোঝা যায় নামিরা আনন্দিত হতো। একদিনের ঘটনা বলি_ ছুটির পর নামিরার মা আসতে দেরি করছে। নামিরা অপেক্ষা করতে পছন্দ করে না, তাই তার রাগের বহিঃপ্রকাশ করল আমার চুলের ওপর। অন্য শিক্ষকরা মিলে নামিরার হাত চুল থেকে সরালেন। যখন নামিরাকে ছাড়ানো হলো তখন লক্ষ্য করলাম, নামিরা লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে আছে। আসলে বিশেষ শিশুদের মধ্যে যারা কথা বলতে পারে না বা তাদের চাহিদা প্রকাশ করতে পারে অথবা তাদের মনের কথা বলতে পারে অথবা তাদের চাহিদা প্রকাশ করতে পারে অথবা তাদের মনের কথা বোঝাতে পারে না তখন তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়, এটা আমাদের বুঝতে হবে। তারা যে আচরণটি করছে, কেন তারা সে আচরণটি করছে_ তা আমাদের বুঝতে হবে। এরপর এলাম শিমুল ক্লাসে। শিমুল ক্লাসে পেলাম নিহাল, শাফীন, আরিয়ান, আরিয়ানা, রিদি ও তাহমিদ। রিদি ছাড়া এদের কারও ঝঢ়ববপয ছিল না অথচ সোমবার সকাল ১০টা হলেই নিহাল সাঁতারের জন্য ব্যাগ গোছাত এবং কোনো কারণে না যাওয়া হলে খুব মন খারাপ করত। এটা চোখে দেখে আমার কাছে অবাক লাগত, এরা কত কিছুই না বোঝে। আমরা ভাবি, এরা কিছু বুঝে না অথচ ওরা যেসব বোঝে সেটাই আমরা বুঝি না। এরপর এলাম গন্ধরাজ ক্লাসে, পেলাম রাহীম, রাশিক, রাফি, রাব্বী, অনিন্দ্য, সামীন ও শান্তকে। এই ক্লাসে এসে রাহীমের মেধা দেখে আমি মুগ্ধ। রাহীম এত বেশি বোঝে। সবচেয়ে মজা লেগেছে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কেক নিয়ে। ক্লাসের সব বাচ্চার জন্য কেক নিয়ে আসার পর রাহীম বেছে বেছে সবচেয়ে বড় টুকরাটা নিলো। কে বলে এরা কিছু বোঝে না। একদিন রাহীমকে পড়ানোর সময় আমি একটা বানান ভুল করলাম, তখন রাহীম আমার হাত ধরে সেই বানানটা ঠিক করে দিলো, সেদিন আমার এত ভালো লেগেছিল। রাশিকের বুদ্ধি দেখলে অবাক লাগে। রাশিকের যখন মন ভালো থাকে তখন এত মিষ্টি করে হেসে মাথা দুলিয়ে গান গায়! এই দৃশ্যটা মন ভরিয়ে দেয়। রাশিক এমনিতে কাজ করতে চায় না; কিন্তু যখন ছুটির সময় হয় তখন নিজ থেকে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়। কারণ ডায়েরি আর খাতা নিলে তো বাড়ি যাওয়া যাবে। ডায়েরি-খাতা নিয়ে ব্যাগে ঢোকায়, চেয়ার-টেবিল গুছিয়ে রাখে। ফ্যান বন্ধ করে। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়ায়। এ কাজগুলো সে একা করে। কে বলে ওরা কিছু বোঝে না? ওরা দেব শিশু। ওরা সৎ, ওরা ভালোবাসর কাঙাল, ওরা সব বোঝে। আমরাই ওদের বুঝতে পারি না।
আবিদা সুলতানা : সহকারী শিক্ষিকা, প্রয়াস
২০০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি 'সোয়াকে' যেদিন প্রথম গেলাম সেদিন একটু ধাক্কা খেলাম। কারণ নতুন একটি বিষয় সম্পর্কে জানলাম। আর তা হলো 'অটিজম'। এর আগে আমার এক দূরসম্পর্কের খালাকে দেখতাম, তার অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। ছোটবেলা থেকে তাকে দেখলেই আমার মনের ভেতর কোথায় যেন এক অনুভূতি কাজ করত। যা হোক, সোয়াকে গিয়ে 'অটিজম' সম্পর্কে জানলাম। বিশেষ শিশুদের কীভাবে শিক্ষাদান করতে হয়, কীভাবে তাদের ম্যানেজ করতে হয়, কীভাবে শান্ত করতে হয়। আমাকে দেওয়া হলো সিনিয়র ১ সেকশনে। সিনিয়র-১-এ ছিল সাতজন ছাত্র_ ১. নাফি ২. অয়ন ৩. সজল ৪ ফারাজ ৫ দীপন ৬. সামীন ও ৭. ত্বাহা। এদের মধ্যে নাফি বেশ অস্থির। আমি নাফিকে নিয়ে কাজ শুরু করলাম। নাফির কাজই হলো ক্লাস থেকে বের হয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে চা খাওয়া। আমাদের নিয়ম থাকত একবারের বেশি চা খেতে না দেওয়া। কিন্তু নাফি সুযোগ খুঁজত কীভাবে ক্যান্টিনে যাবে। একদিনের কথা বলি, আমি নাফির হাত দুটি ব্লক করে নাফির সামনে বসে আছি, হঠাৎ নাফি জোরে খামচি দিল এবং অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। নাফি বোঝাতে চাইছে সে অন্যায় করেছে। নাফি অনুতপ্ত। আমার হাতে রক্ত পড়া দেখে নাফি তাতে 'ফুঁ' দিচ্ছে। সে মুহূর্তে আমি আমার ব্যথা ভুলে গেলাম এবং আমার মনে হলো 'অটিজম' শিশুরা সবকিছু বোঝে; কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। আর প্রকাশ করতে পারে না বলেই হয়তো অটিজম শিশুরা রাগকেও দমন করতে পারে না। আমরাই বুঝি না যে ওরা সবকিছু বোঝে। অনেক সময় আমরা ওদের সামনে সবকিছু বলি এবং ওদের খারাপ দিকগুলো অন্যের সঙ্গে আলোচনা করি তখন ওদের কতটা খারাপ লাগে তা ওরাই জানে, যেমন আমাকে যদি কেউ আমার সামনে সব সময় আমার দুর্বল দিক নিয়ে আলোচনা করে, তাহলে আমার যেমন খারাপ লাগবে ওদেরও তেমন লাগে। এরপর এলাম সিনিয়র-৩-এ। সিনিয়র-৩-এ এসে আমি মুগ্ধ, কারণ এখানকার বাচ্চাদের এত গুণ! আনন্দের কথা, ওদের হাতের লেখা এত সুন্দর। আর আদিত তো যে কোনো দিন কী বার তা বলে দিতে পারে, এদের প্রত্যেকের একাডেমিক লেবেল ভালো। ওদের কথা এত সুন্দর, এত গোছানো, ওরা এত বেশি জানে সত্যিই ওরা 'দেব' শিশু। এরপর ২০০৯ সালে 'প্রয়াস'-এ এলাম। এসেই ডালিয়া ক্লাসে নামিরাকে পেলাম। নামিরা ছিল অস্থির প্রকৃতির, নামিরার অস্থিরতার পরও আমরা নামিরাকে বলতাম নামিরা ভালো মেয়ে, এ কথায় নামিরা চোখ তুলে তাকাত এবং মুখের কোণে মিষ্টি এক হাসি থাকত। এতে বোঝা যায় নামিরা আনন্দিত হতো। একদিনের ঘটনা বলি_ ছুটির পর নামিরার মা আসতে দেরি করছে। নামিরা অপেক্ষা করতে পছন্দ করে না, তাই তার রাগের বহিঃপ্রকাশ করল আমার চুলের ওপর। অন্য শিক্ষকরা মিলে নামিরার হাত চুল থেকে সরালেন। যখন নামিরাকে ছাড়ানো হলো তখন লক্ষ্য করলাম, নামিরা লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে আছে। আসলে বিশেষ শিশুদের মধ্যে যারা কথা বলতে পারে না বা তাদের চাহিদা প্রকাশ করতে পারে অথবা তাদের মনের কথা বলতে পারে অথবা তাদের চাহিদা প্রকাশ করতে পারে অথবা তাদের মনের কথা বোঝাতে পারে না তখন তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়, এটা আমাদের বুঝতে হবে। তারা যে আচরণটি করছে, কেন তারা সে আচরণটি করছে_ তা আমাদের বুঝতে হবে। এরপর এলাম শিমুল ক্লাসে। শিমুল ক্লাসে পেলাম নিহাল, শাফীন, আরিয়ান, আরিয়ানা, রিদি ও তাহমিদ। রিদি ছাড়া এদের কারও ঝঢ়ববপয ছিল না অথচ সোমবার সকাল ১০টা হলেই নিহাল সাঁতারের জন্য ব্যাগ গোছাত এবং কোনো কারণে না যাওয়া হলে খুব মন খারাপ করত। এটা চোখে দেখে আমার কাছে অবাক লাগত, এরা কত কিছুই না বোঝে। আমরা ভাবি, এরা কিছু বুঝে না অথচ ওরা যেসব বোঝে সেটাই আমরা বুঝি না। এরপর এলাম গন্ধরাজ ক্লাসে, পেলাম রাহীম, রাশিক, রাফি, রাব্বী, অনিন্দ্য, সামীন ও শান্তকে। এই ক্লাসে এসে রাহীমের মেধা দেখে আমি মুগ্ধ। রাহীম এত বেশি বোঝে। সবচেয়ে মজা লেগেছে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কেক নিয়ে। ক্লাসের সব বাচ্চার জন্য কেক নিয়ে আসার পর রাহীম বেছে বেছে সবচেয়ে বড় টুকরাটা নিলো। কে বলে এরা কিছু বোঝে না। একদিন রাহীমকে পড়ানোর সময় আমি একটা বানান ভুল করলাম, তখন রাহীম আমার হাত ধরে সেই বানানটা ঠিক করে দিলো, সেদিন আমার এত ভালো লেগেছিল। রাশিকের বুদ্ধি দেখলে অবাক লাগে। রাশিকের যখন মন ভালো থাকে তখন এত মিষ্টি করে হেসে মাথা দুলিয়ে গান গায়! এই দৃশ্যটা মন ভরিয়ে দেয়। রাশিক এমনিতে কাজ করতে চায় না; কিন্তু যখন ছুটির সময় হয় তখন নিজ থেকে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়। কারণ ডায়েরি আর খাতা নিলে তো বাড়ি যাওয়া যাবে। ডায়েরি-খাতা নিয়ে ব্যাগে ঢোকায়, চেয়ার-টেবিল গুছিয়ে রাখে। ফ্যান বন্ধ করে। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়ায়। এ কাজগুলো সে একা করে। কে বলে ওরা কিছু বোঝে না? ওরা দেব শিশু। ওরা সৎ, ওরা ভালোবাসর কাঙাল, ওরা সব বোঝে। আমরাই ওদের বুঝতে পারি না।
আবিদা সুলতানা : সহকারী শিক্ষিকা, প্রয়াস
No comments