মেঘ সকালে ফোন করে বলে নানু, বাবা-মা মারা গেছে
পাঁচ বছর কী তার চেয়ে একটু বেশি হবে। রাতে মায়ের আদরে ঘুমিয়ে পড়ল। আর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল সেই মায়ের নাড়িভুঁড়ি বের হওয়া রক্তাক্ত লাশ। পাশেই পা বাঁধা বাবার নিথর লাশ। অবুঝ মেঘ কি কখনও ভেবেছে এই বয়সে তার মা-বাবার লাশ এক সঙ্গে দেখতে হবে।
ছোট্ট মেঘ। মায়াময় মিষ্টি চেহারা। বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ, সেই চোখে চঞ্চলতার আভাস। মা মেহেরুন রুনির সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে নানির ইন্দিরার রোডের বাসার চার তলায় ওঠা, আবার নেমে যাওয়া ছিল তার নিত্যদিনের খেলা।
আবার কখনও বাবা সাগর সারওয়ারকে রিকশায় রেখেই দৌড় নানির বাসার দিকে। নানির ফ্ল্যাটের আশপাশের বাসার বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব, খেলাধুলা। সব সময় ব্যস্ত, প্রাণশক্তিতে ভরা একটি শিশু।
কিন্তু মা-হীন সারওয়ার মেঘ নামের এই নিষ্পাপ শিশুটি আজ সত্যিই মা-হীন! একই সঙ্গে পিতৃহীনও হয়ে পড়ল। তার জীবনে এবার নেমে এসেছে মেঘের কালো ছায়া। মেঘ গতকাল সকালে মা-বাবাকে রক্তাক্ত অবস্থায় শোয়ার ঘরে দেখে সে নিজেই নানিকে ফোন করেছে। তার নানি নুরুন নাহার মির্জা বলেন, ‘মেঘ আজ সকাল ৭টার দিকে আমাকে ফোন করে। বলে, মা-বাবা মরে গেছে।’
তখন কি সে একবারও ভাবতে পেরেছে, সে কী হারিয়েছে? সেটা ভাবার মতো বয়স কি তার হয়েছে? খবর পেয়ে সকালে সবাই যখন সাগর-রুনি দম্পতির বাসায় ভিড় করে, তখন মেঘ অনেকটাই শান্ত হয়ে তাকিয়ে ছিল। পরে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এটিএন বাংলা মেঘের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। মেঘ তাদের বলেছে, ‘তাদের (দুর্বৃত্ত) হাতে ছুরি ছিল, পিস্তল ছিল। আমাকে গুলি করতে চেয়েছিল।’
এই সাংবাদিক দম্পতি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে নিজেদের ভাড়া বাসায় রহস্যজনকভাবে খুন হয়েছেন। মোবাইল ফোনে ৭ বছরের মেঘ নানির কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এই ভয়াবহ সংবাদটি দেয়। নাতির কাছে এই সংবাদ শোনা মাত্র পাগলপারা হয়ে নানি তার ইন্দিরা রোডের বাসা থেকে ছুটে আসেন রাজাবাজারে মেয়ে-জামাইয়ের বাসায়। ৭ বছরের মেঘ নিজেই দরজা খুলে দেয় তার নানিকে। বাসার শোবার ঘরে গিয়েই দেখলেন সেই বীভত্স দৃশ্য—বিছানার পাশে পড়ে আছে জামাই সাংবাদিক সাগর সারওয়ার ও মেয়ে সাংবাদিক মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত মৃতদেহ।
কী নিষ্ঠুরতা! সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবা-মায়ের লাশ দেখে ছোট শিশু মেঘকেই ফোনে জানাতে হলো সেই খবর। বাবা-মায়ের অকাল প্রয়াণের পর মেঘের আকাশ চিরদিনের জন্য ঢেকে গেছে কালো মেঘে। অপত্য স্নেহের সুখস্বর্গ থেকে হঠাত্ই নৃশংস খুনিরা ছোট্ট মেঘকে ছুড়ে ফেলল স্নেহহীনতার করুণ অন্ধকারে। তার সামনে এখন কেবল ঝড় আর অন্ধকার। সামনে কেবল অন্তহীন দুঃখের পারাবার। মেঘের পৃথিবী আজ নিমেষেই হয়ে গেছে ওলটপালট।
গগনবিদারী চিত্কারে মেঘের নানি বলছেন, তোরা যা আছে সব নিয়ে যাতি, মারলি কেন? আমি কেন বাসায় থাকলাম না, সবাই খুঁজে বের করেন, সবাই এর বিচার করেন, আপনারা এতগুলো মানুষ বিচার করেন। ওরা তো কারও ক্ষতি করেনি।
গতকাল রাতে মেয়ে-জামাইয়ের এই নৃশংস খুনের পর মেঘের নানি এভাবেই কাঁদছেন আর বিভিন্ন কথা বলছেন। মেয়ের বাসার ড্রইং রুমে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আত্মীয়স্বজন এখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তিনি আবার বলছেন, ‘আমি যাব না। আমার মেয়ে-জামাই কোনো অপরাধ করেনি। ওরা কারো ক্ষতি করেনি। বরং উপকার করেছে। তোরা যা আছে সব নিয়ে যাতি, মারলি কেন?’
মেঘের নানির কান্না যেন থামছেই না। সবাই তাকে চুপ থাকতে বলছেন। সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আবারও নিজের বুক চাপড়ে বলছেন, ‘আমি কীভাবে বাঁচব। আমি মেঘের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। ও দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। আজ সকাল ৭টায় উঠেছে।’
শুক্রবার রাত ৯টার দিকে মেয়ে রুনির সঙ্গে শেষ কথা হয় তার। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার ওরা পিকনিকে যায়। ছেলেকে আমার কাছে রেখে যায়। অন্য সময় মেঘকে খাইয়ে দিতে হয়। কিন্তু কাল ও নিজেই হাত দিয়ে খাবার খেয়েছে।’
মেঘের নানি যখন ড্রইং রুমে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন, তখনই সাগর সারওয়ারের মা ‘আমার বাবা কই, আমার বাবা কই’ বলে চিত্কার করছেন।
No comments