বিশেষ সাক্ষাৎকার-অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমেই নতুন নির্বাচন কমিশন by মোহাম্মদ আবু হেনা
মোহাম্মদ আবু হেনার জন্ম ১৯৩৭ সালে, রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন হাবাসপুর হাইস্কুল, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করতেন।
মুন্সিগঞ্জের এসডিও হিসেবে সরকারি চাকরি শুরু করে মোহাম্মদ আবু হেনা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্থানীয় সরকার বিভাগ, বেসামরিক বিমান চলাচল, পাট, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পরিকল্পনা কমিশনের জ্যেষ্ঠ সদস্য পদ গ্রহণ। ১৯৯১-৯৩ সালে তিনি জাপান ও ফিলিপাইনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এ ছাড়া মোহাম্মদ আবু হেনা ২০০৮-১০ মেয়াদে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ন্যায়পাল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল কাইয়ুম ও সোহরাব হাসান
প্রথম আলো নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন? আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে জানতে চাইছি।
মোহাম্মদ আবু হেনা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকালে নির্বাচনী কাজে আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর যখন প্রস্তাবটি এল, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। কিন্তু আমার ঘনিষ্ঠজন ও শুভানুধ্যায়ীরা বললেন, এ চ্যালেঞ্জ তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানও আশ্বস্ত করলেন যে, আমার প্রতি প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলেরই আস্থা আছে। তখন আমি চ্যালেঞ্জটি নিলাম। সে সময় দ্বিতীয় কোনো কমিশনারও ছিলেন না। কমিশনের পুরো কাঠামোটি নতুন করে সাজাতে হয়েছে। প্রথমেই আমি নির্বাচন কমিশন আইন, বিধিমালা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করলাম। তারপর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মনোভাব জানতে তাদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করলাম। দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্বিতীয় দিন থেকেই আলোচনা শুরু করি। এর পাশাপাশি নির্বাচন-প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে কী কী করণীয়, তার একটি তালিকা করলাম। সাংবিধানিক পদের দায়িত্ব পালন করতে হলে সবার আস্থা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি বিষয়টি গভীরভাবে জানা। আমার হাতে সময় ছিল মাত্র দুই মাস। ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব নিই এবং ১২ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমি খোলা মন নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের অভিযোগ শুনেছি। যেসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছি।
প্রথম আলো জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা একটি বিরাট দায়িত্ব, যা কেবল কমিশনের মুষ্টিমেয় লোক দ্বারা প্রতিপালন করা সম্ভব নয়। সে কারণে জনপ্রশাসন থেকে লোকবল আনতে হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যায় পড়েছেন কি না?
মোহাম্মদ আবু হেনা যেকোনো কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে প্রয়োজন প্রশাসনিক দক্ষতা, সততা ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। যেন কেউ মনে না করেন, তাঁকে প্রভাবিত করা যাবে। এই আস্থা খুবই জরুরি। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে হয় রিটার্নিং অফিসার ও প্রিসাইডিং অফিসারদের নিয়ে। তাঁরা আসেন জনপ্রশাসন থেকে। আমার পূর্বসূরিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও বলব, এ ক্ষেত্রে বিচারপতিদের চেয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অনেক বেশি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন বলে সিইসি পদে বিচার বিভাগ থেকে কাউকে নেননি। হতে পারে তিনি বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করতে চাননি।
প্রথম আলো আপনি দক্ষ, সৎ ও শক্ত লোকের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলছেন। এই দক্ষ, সৎ ও শক্ত চরিত্রের লোক কী করে বাছাই করা যায়?
মোহাম্মদ আবু হেনা দক্ষ, সৎ ও শক্ত চরিত্রের লোক বাছাইয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি (সার্চ কমিটি) গঠন করা যেতে পারে। কমিটির প্রধান হতে পারেন সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতি, সদস্যরা আসতে পারেন প্রশাসনিক কাজে দক্ষ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে। আসতে পারেন পেশাজীবীদের মধ্য থেকেও। তবে কমিটির সদস্যসংখ্যা পাঁচজনের বেশি হওয়া উচিত নয়।
প্রথম আলো এ ধরনের কমিটি কি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে?
মোহাম্মদ আবু হেনা না মানার কারণ দেখি না। সার্চ কমিটির সিদ্ধান্তই তো চূড়ান্ত নয়। তারা সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে প্রস্তাব পাঠাবে, যেখানে সংসদ নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতা আছেন, তাঁরা কমিটির বৈঠকে না থাকলেও তাঁদের প্রতিনিধিরা যান। প্রস্তাবিত নামগুলো নিয়ে সেখানে আলোচনা হবে এবং সেখান থেকে চূড়ান্ত তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হবে। রাষ্ট্রপতি সেই তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ দেবেন।
প্রথম আলো বর্তমান কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে সরকারি দলের সদস্যসংখ্যা অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের বক্তব্য আমলে নেওয়ার সুযোগ কতটুকু?
মোহাম্মদ আবু হেনা কিন্তু এর বিকল্প কী? অনেকে দুই দলের মধ্যে আলোচনার কথা বলেছেন। কেউ কেউ মধ্যস্থতাকারী নিয়োগের কথা বলছেন। তাতে জটিলতা আরও বাড়বে। কার্য উপদেষ্টা কমিটি তো বহাল আছে, নতুন কাঠামো তৈরি না করে সেখানে আলোচনাই যুক্তিসংগত। আর আলোচনার উদ্দেশ্যই হবে মতৈক্যে পৌঁছানো। দুই পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা। সমঝোতা তো আলোচনার মাধ্যমেই হতে হবে।
প্রথম আলো যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নিই যে সমঝোতার মাধ্যমে কমিশন গঠিত হলো। কিন্তু সেই কমিশন জাতীয় নির্বাচন করার সময় সরকার তথা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কি? বিশেষ করে, সরকারের যেসব মন্ত্রণালয় নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত, যেমন—স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইত্যাদি?
মোহাম্মদ আবু হেনা এ কারণেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে যেমন সৎ ও দক্ষ হতে হবে, তেমনি শক্ত হতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও দলগুলো নির্বাচনের রায় নিজের পক্ষে নিতে প্রশাসনকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে চাইবে। নির্বাচন কমিশনের প্রথম কাজ হবে তা প্রতিহত করা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর কঠোর নজরদারির মাধ্যমে অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে তাদের সজাগ করে দিয়ে তা করা যায়। তারপরও যদি কেউ নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করে, তবে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও দলগুলোও কঠিন বার্তা পেয়ে যাবে। তারা যখন বুঝবেন, কমিশন বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কোনোভাবে প্রভাবিত করা যাবে না, তখন সেই চেষ্টা থেকে বিরত থাকবেন। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি যাঁদের দিয়ে কমিশনের কাজ সুষ্ঠুভাবে করাতে পারব বলে মনে করেছি, তাঁদেরই নিয়ে এসেছি। উপনির্বাচনের সময় আমরা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে বলেছি, তফসিল ঘোষণার পর যেন তিনি বা তাঁর সরকারের কোনো মন্ত্রী নির্বাচনী এলাকায় না যান। তাঁরা সেটি মেনেছেন।
প্রথম আলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সময় সরকার বলেছিল, নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা হবে। নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব প্রতিষ্ঠান তাদের নির্দেশে কাজ করবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা কতটা সম্ভব?
মোহাম্মদ আবু হেনা নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবেই স্বীকৃত। এটি দেওয়া-নেওয়ার বিষয় নয়। কিন্তু বাস্তব সমস্যা হলো, অর্থ ও লোকবলের অভাব। দুদিক থেকেই কমিশনের সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। অর্থ বরাদ্দ থাকলেও ছাড় করতে অনেক সময় লেগে যায়। আমার প্রস্তাব হলো, আগেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে বাজেটের অর্থ বরাদ্দ ও ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দ বাজেটের টাকা ব্যয়ের জন্য যেন আলাদাভাবে মন্ত্রণালয়ের অনুমতির দরকার না হয়। এই আর্থিক স্বাধীনতা দরকার। কমিশনের কেন্দ্রীয় সচিবালয় থেকে উপজেলা পর্যন্ত কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা আছেন, কিন্তু নির্বাচন পরিচালনার জন্য তা যথেষ্ট নয়। বাইরে থেকে রিটার্নিং অফিসার বা প্রিসাইডিং অফিসারদের নিয়োগ করা হয়। তাঁরা সরকারি কর্মকর্তা। তা ছাড়া শিক্ষক ও বেসরকারি কর্মকর্তারাও নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেন। কমিশন তার কাজের জন্য যাদের চাইবে, সরকার তাদের দিতে বাধ্য থাকবে। সমস্যা হলো, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভাবেন, এক মাস বা দুই মাসের জন্য কমিশনে এলাম। আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে হবে। অতএব সেই সংস্থা বা সংস্থাপ্রধানের প্রতিই তাঁদের আনুগত্য থাকে। এরপরও তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ করতে হবে। বোঝাতে হবে, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বেআইনি কিছু করতে পারেন না। আমার প্রস্তাব ছিল, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী সব কর্মকর্তার এসিআর লেখার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়ার। অধ্যাদেশ ১৩, ১৯৯১-এ বলা আছে, কোনো কর্মকর্তা আইনবহির্ভূত কিছু করলে নির্বাচন কমিশন তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারবে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এটি করে গিয়েছিলেন। আমি মনে করি, শাস্তিটা আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। কেউ সাময়িক বরখাস্ত হলে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা যেন প্রত্যাহার করা না হয়। তাতে দায়িত্বপ্রাপ্তরা সমঝে চলতে বাধ্য হবেন।
প্রথম আলো অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অন্যায় করলেও তাঁরা শাস্তি পান না; বরং ক্ষমতার পালাবদলের পর পুরস্কৃত হন।
মোহাম্মদ আবু হেনা আমার সর্বশেষ নির্বাচন ছিল টাঙ্গাইলের উপনির্বাচন। সেই নির্বাচনে দায়িত্বে অবহেলার কারণে আমি চার-পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেটকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলাম। সেখানে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে একজন কমিশনারের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলাম। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া আমি যে পদক্ষেপটি নিয়েছিলাম, তা হলো ফলাফল স্থগিত করা। আমার ধারণা হয়েছিল, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। অতএব বিষয়টি তদন্ত না করে ফলাফল ঘোষণা করা ঠিক হবে না। আমি মে মাসে (২০০০) পদত্যাগ করার পরই উপনির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশও তুলে নেওয়া হয়।
প্রথম আলো নির্বাচন কমিশনকে যদি আর্থিকভাবে ও লোকবল দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হয়, তাহলে কি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব?
মোহাম্মদ আবু হেনা অনেকটাই সম্ভব। নির্বাচন কমিশনকে যদি সত্যিকারভাবে শক্তিশালী করা হয়, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপস্থিতিতেও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা অসম্ভব নয়।
প্রথম আলো গণতান্ত্রিক-ব্যবস্থার উন্নয়নে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, সেসব সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মোহাম্মদ আবু হেনা বর্তমান নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইন সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। তবে কাজটি শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। নির্বাচন কমিশনকে শুধু কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী করলে হবে না। আইনে যেসব সীমাবদ্ধতা আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। আচরণবিধি সংস্কারের লক্ষ্যে আমরা একটি প্রশ্নমালা তৈরি করে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তেমন সাড়া পাইনি। কমিউনিস্ট পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি বাম দল সাড়া দিয়েছিল। সে সময় ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং (ফেমা) বেশ কিছু সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সে সময় আমরা বেশ কিছু সুপারিশ তৈরি করে আইন কমিশনের কাছে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কমিশন সেটি ফাইলবন্দী করে রাখে। সেখানে পাঠানোই সম্ভবত আমাদের ভুল ছিল। বর্তমান কমিশন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বিষয়গুলো আইনে পরিণত করতে পেরেছে, এটি তাদের সাফল্য। নির্বাচনী আচরণবিধিও অনেক কঠোর করা হয়েছে। যেমন, নির্বাচনী প্রচার তথা সভা-সমাবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ। এখন ইচ্ছেমতো কেউ নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারে না। নির্বাচনী প্রচার নিয়েই সংঘর্ষ হয়, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা চরমে পৌঁছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শোডাউনও বন্ধ করা হয়েছে। আমরা নির্বাচনী আচরণবিধি জারি করে বললাম, এ কাজগুলো করা যাবে, এগুলো করা যাবে না। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে একজন সাব-জজের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচনী তদন্ত কমিটি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিত। তারা অনেক জাঁদরেল নেতাকেও নোটিশ দিয়েছে।
প্রথম আলো নির্বাচনী আইন সংস্কারে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কিছু সুপারিশ করেছে। সেগুলো সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? এর বাইরে আপনার কোনো সুপারিশ আছে কি না?
মোহাম্মদ আবু হেনা তাদের অধিকাংশ সুপারিশের সঙ্গে আমি একমত হলেও রাষ্ট্রীয় খরচে প্রার্থীদের প্রচারণা কিংবা নির্বাচনী ব্যয়নির্বাহকে যুক্তিযুক্ত মনে করি না। তাতে প্রার্থীদের নিজস্ব খরচ বন্ধ করা যাবে না; বরং রাষ্ট্রের অপচয় হবে। নির্বাচনী আইন সংস্কারের দুটি উদ্যোগের সঙ্গে আমার নিজেকে সংযুক্ত রাখার সুযোগ হয়েছিল। প্রথমটি হলো: সাবেক সচিব মতিউল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিটি, দ্বিতীয়টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিবেদন তৈরি। প্রার্থীদের ব্যয়নির্বাহের ক্ষেত্রে এখন তদারকির ব্যবস্থা নেই। নির্বাচন কমিশন প্রতিটি এলাকায় একজন করে নির্বাচনী ব্যয় পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা নিয়োগ করতে পারে। প্রত্যেক প্রার্থী তাঁদের খরচ রেজিস্টার বইয়ে লিপিবদ্ধ করবেন এবং উল্লিখিত কর্মকর্তা প্রতি সপ্তাহে সেই বই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কমিশনে রিপোর্ট পাঠাবেন, এতে প্রার্থীরা বাড়তি খরচের ব্যাপারে সতর্ক হবেন। ফলে কোনো প্রার্থী এক কোটি টাকা ব্যয় করে কাগজপত্রে ১৫ লাখ টাকা দেখাতে পারবেন না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে আগে থেকে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া। বিশেষ করে, নারী ও সংখ্যালঘু ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন, নির্বাচন কমিশনকে সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ আবু হেনা ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল কাইয়ুম ও সোহরাব হাসান
প্রথম আলো নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন? আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে জানতে চাইছি।
মোহাম্মদ আবু হেনা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকালে নির্বাচনী কাজে আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর যখন প্রস্তাবটি এল, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। কিন্তু আমার ঘনিষ্ঠজন ও শুভানুধ্যায়ীরা বললেন, এ চ্যালেঞ্জ তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানও আশ্বস্ত করলেন যে, আমার প্রতি প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলেরই আস্থা আছে। তখন আমি চ্যালেঞ্জটি নিলাম। সে সময় দ্বিতীয় কোনো কমিশনারও ছিলেন না। কমিশনের পুরো কাঠামোটি নতুন করে সাজাতে হয়েছে। প্রথমেই আমি নির্বাচন কমিশন আইন, বিধিমালা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করলাম। তারপর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মনোভাব জানতে তাদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করলাম। দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্বিতীয় দিন থেকেই আলোচনা শুরু করি। এর পাশাপাশি নির্বাচন-প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে কী কী করণীয়, তার একটি তালিকা করলাম। সাংবিধানিক পদের দায়িত্ব পালন করতে হলে সবার আস্থা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি বিষয়টি গভীরভাবে জানা। আমার হাতে সময় ছিল মাত্র দুই মাস। ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব নিই এবং ১২ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমি খোলা মন নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের অভিযোগ শুনেছি। যেসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছি।
প্রথম আলো জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা একটি বিরাট দায়িত্ব, যা কেবল কমিশনের মুষ্টিমেয় লোক দ্বারা প্রতিপালন করা সম্ভব নয়। সে কারণে জনপ্রশাসন থেকে লোকবল আনতে হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যায় পড়েছেন কি না?
মোহাম্মদ আবু হেনা যেকোনো কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে প্রয়োজন প্রশাসনিক দক্ষতা, সততা ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। যেন কেউ মনে না করেন, তাঁকে প্রভাবিত করা যাবে। এই আস্থা খুবই জরুরি। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে হয় রিটার্নিং অফিসার ও প্রিসাইডিং অফিসারদের নিয়ে। তাঁরা আসেন জনপ্রশাসন থেকে। আমার পূর্বসূরিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও বলব, এ ক্ষেত্রে বিচারপতিদের চেয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অনেক বেশি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন বলে সিইসি পদে বিচার বিভাগ থেকে কাউকে নেননি। হতে পারে তিনি বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করতে চাননি।
প্রথম আলো আপনি দক্ষ, সৎ ও শক্ত লোকের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলছেন। এই দক্ষ, সৎ ও শক্ত চরিত্রের লোক কী করে বাছাই করা যায়?
মোহাম্মদ আবু হেনা দক্ষ, সৎ ও শক্ত চরিত্রের লোক বাছাইয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি (সার্চ কমিটি) গঠন করা যেতে পারে। কমিটির প্রধান হতে পারেন সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতি, সদস্যরা আসতে পারেন প্রশাসনিক কাজে দক্ষ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে। আসতে পারেন পেশাজীবীদের মধ্য থেকেও। তবে কমিটির সদস্যসংখ্যা পাঁচজনের বেশি হওয়া উচিত নয়।
প্রথম আলো এ ধরনের কমিটি কি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে?
মোহাম্মদ আবু হেনা না মানার কারণ দেখি না। সার্চ কমিটির সিদ্ধান্তই তো চূড়ান্ত নয়। তারা সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে প্রস্তাব পাঠাবে, যেখানে সংসদ নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতা আছেন, তাঁরা কমিটির বৈঠকে না থাকলেও তাঁদের প্রতিনিধিরা যান। প্রস্তাবিত নামগুলো নিয়ে সেখানে আলোচনা হবে এবং সেখান থেকে চূড়ান্ত তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হবে। রাষ্ট্রপতি সেই তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ দেবেন।
প্রথম আলো বর্তমান কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে সরকারি দলের সদস্যসংখ্যা অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের বক্তব্য আমলে নেওয়ার সুযোগ কতটুকু?
মোহাম্মদ আবু হেনা কিন্তু এর বিকল্প কী? অনেকে দুই দলের মধ্যে আলোচনার কথা বলেছেন। কেউ কেউ মধ্যস্থতাকারী নিয়োগের কথা বলছেন। তাতে জটিলতা আরও বাড়বে। কার্য উপদেষ্টা কমিটি তো বহাল আছে, নতুন কাঠামো তৈরি না করে সেখানে আলোচনাই যুক্তিসংগত। আর আলোচনার উদ্দেশ্যই হবে মতৈক্যে পৌঁছানো। দুই পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা। সমঝোতা তো আলোচনার মাধ্যমেই হতে হবে।
প্রথম আলো যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নিই যে সমঝোতার মাধ্যমে কমিশন গঠিত হলো। কিন্তু সেই কমিশন জাতীয় নির্বাচন করার সময় সরকার তথা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কি? বিশেষ করে, সরকারের যেসব মন্ত্রণালয় নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত, যেমন—স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইত্যাদি?
মোহাম্মদ আবু হেনা এ কারণেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে যেমন সৎ ও দক্ষ হতে হবে, তেমনি শক্ত হতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও দলগুলো নির্বাচনের রায় নিজের পক্ষে নিতে প্রশাসনকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে চাইবে। নির্বাচন কমিশনের প্রথম কাজ হবে তা প্রতিহত করা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর কঠোর নজরদারির মাধ্যমে অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে তাদের সজাগ করে দিয়ে তা করা যায়। তারপরও যদি কেউ নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করে, তবে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও দলগুলোও কঠিন বার্তা পেয়ে যাবে। তারা যখন বুঝবেন, কমিশন বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কোনোভাবে প্রভাবিত করা যাবে না, তখন সেই চেষ্টা থেকে বিরত থাকবেন। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি যাঁদের দিয়ে কমিশনের কাজ সুষ্ঠুভাবে করাতে পারব বলে মনে করেছি, তাঁদেরই নিয়ে এসেছি। উপনির্বাচনের সময় আমরা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে বলেছি, তফসিল ঘোষণার পর যেন তিনি বা তাঁর সরকারের কোনো মন্ত্রী নির্বাচনী এলাকায় না যান। তাঁরা সেটি মেনেছেন।
প্রথম আলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সময় সরকার বলেছিল, নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা হবে। নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব প্রতিষ্ঠান তাদের নির্দেশে কাজ করবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা কতটা সম্ভব?
মোহাম্মদ আবু হেনা নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবেই স্বীকৃত। এটি দেওয়া-নেওয়ার বিষয় নয়। কিন্তু বাস্তব সমস্যা হলো, অর্থ ও লোকবলের অভাব। দুদিক থেকেই কমিশনের সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। অর্থ বরাদ্দ থাকলেও ছাড় করতে অনেক সময় লেগে যায়। আমার প্রস্তাব হলো, আগেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে বাজেটের অর্থ বরাদ্দ ও ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দ বাজেটের টাকা ব্যয়ের জন্য যেন আলাদাভাবে মন্ত্রণালয়ের অনুমতির দরকার না হয়। এই আর্থিক স্বাধীনতা দরকার। কমিশনের কেন্দ্রীয় সচিবালয় থেকে উপজেলা পর্যন্ত কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা আছেন, কিন্তু নির্বাচন পরিচালনার জন্য তা যথেষ্ট নয়। বাইরে থেকে রিটার্নিং অফিসার বা প্রিসাইডিং অফিসারদের নিয়োগ করা হয়। তাঁরা সরকারি কর্মকর্তা। তা ছাড়া শিক্ষক ও বেসরকারি কর্মকর্তারাও নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেন। কমিশন তার কাজের জন্য যাদের চাইবে, সরকার তাদের দিতে বাধ্য থাকবে। সমস্যা হলো, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভাবেন, এক মাস বা দুই মাসের জন্য কমিশনে এলাম। আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে হবে। অতএব সেই সংস্থা বা সংস্থাপ্রধানের প্রতিই তাঁদের আনুগত্য থাকে। এরপরও তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ করতে হবে। বোঝাতে হবে, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বেআইনি কিছু করতে পারেন না। আমার প্রস্তাব ছিল, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী সব কর্মকর্তার এসিআর লেখার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়ার। অধ্যাদেশ ১৩, ১৯৯১-এ বলা আছে, কোনো কর্মকর্তা আইনবহির্ভূত কিছু করলে নির্বাচন কমিশন তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারবে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এটি করে গিয়েছিলেন। আমি মনে করি, শাস্তিটা আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। কেউ সাময়িক বরখাস্ত হলে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা যেন প্রত্যাহার করা না হয়। তাতে দায়িত্বপ্রাপ্তরা সমঝে চলতে বাধ্য হবেন।
প্রথম আলো অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অন্যায় করলেও তাঁরা শাস্তি পান না; বরং ক্ষমতার পালাবদলের পর পুরস্কৃত হন।
মোহাম্মদ আবু হেনা আমার সর্বশেষ নির্বাচন ছিল টাঙ্গাইলের উপনির্বাচন। সেই নির্বাচনে দায়িত্বে অবহেলার কারণে আমি চার-পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেটকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলাম। সেখানে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে একজন কমিশনারের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলাম। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া আমি যে পদক্ষেপটি নিয়েছিলাম, তা হলো ফলাফল স্থগিত করা। আমার ধারণা হয়েছিল, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। অতএব বিষয়টি তদন্ত না করে ফলাফল ঘোষণা করা ঠিক হবে না। আমি মে মাসে (২০০০) পদত্যাগ করার পরই উপনির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশও তুলে নেওয়া হয়।
প্রথম আলো নির্বাচন কমিশনকে যদি আর্থিকভাবে ও লোকবল দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হয়, তাহলে কি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব?
মোহাম্মদ আবু হেনা অনেকটাই সম্ভব। নির্বাচন কমিশনকে যদি সত্যিকারভাবে শক্তিশালী করা হয়, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপস্থিতিতেও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা অসম্ভব নয়।
প্রথম আলো গণতান্ত্রিক-ব্যবস্থার উন্নয়নে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, সেসব সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মোহাম্মদ আবু হেনা বর্তমান নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইন সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। তবে কাজটি শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। নির্বাচন কমিশনকে শুধু কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী করলে হবে না। আইনে যেসব সীমাবদ্ধতা আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। আচরণবিধি সংস্কারের লক্ষ্যে আমরা একটি প্রশ্নমালা তৈরি করে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তেমন সাড়া পাইনি। কমিউনিস্ট পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি বাম দল সাড়া দিয়েছিল। সে সময় ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং (ফেমা) বেশ কিছু সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সে সময় আমরা বেশ কিছু সুপারিশ তৈরি করে আইন কমিশনের কাছে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কমিশন সেটি ফাইলবন্দী করে রাখে। সেখানে পাঠানোই সম্ভবত আমাদের ভুল ছিল। বর্তমান কমিশন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বিষয়গুলো আইনে পরিণত করতে পেরেছে, এটি তাদের সাফল্য। নির্বাচনী আচরণবিধিও অনেক কঠোর করা হয়েছে। যেমন, নির্বাচনী প্রচার তথা সভা-সমাবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ। এখন ইচ্ছেমতো কেউ নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারে না। নির্বাচনী প্রচার নিয়েই সংঘর্ষ হয়, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা চরমে পৌঁছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শোডাউনও বন্ধ করা হয়েছে। আমরা নির্বাচনী আচরণবিধি জারি করে বললাম, এ কাজগুলো করা যাবে, এগুলো করা যাবে না। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে একজন সাব-জজের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচনী তদন্ত কমিটি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিত। তারা অনেক জাঁদরেল নেতাকেও নোটিশ দিয়েছে।
প্রথম আলো নির্বাচনী আইন সংস্কারে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কিছু সুপারিশ করেছে। সেগুলো সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? এর বাইরে আপনার কোনো সুপারিশ আছে কি না?
মোহাম্মদ আবু হেনা তাদের অধিকাংশ সুপারিশের সঙ্গে আমি একমত হলেও রাষ্ট্রীয় খরচে প্রার্থীদের প্রচারণা কিংবা নির্বাচনী ব্যয়নির্বাহকে যুক্তিযুক্ত মনে করি না। তাতে প্রার্থীদের নিজস্ব খরচ বন্ধ করা যাবে না; বরং রাষ্ট্রের অপচয় হবে। নির্বাচনী আইন সংস্কারের দুটি উদ্যোগের সঙ্গে আমার নিজেকে সংযুক্ত রাখার সুযোগ হয়েছিল। প্রথমটি হলো: সাবেক সচিব মতিউল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিটি, দ্বিতীয়টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিবেদন তৈরি। প্রার্থীদের ব্যয়নির্বাহের ক্ষেত্রে এখন তদারকির ব্যবস্থা নেই। নির্বাচন কমিশন প্রতিটি এলাকায় একজন করে নির্বাচনী ব্যয় পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা নিয়োগ করতে পারে। প্রত্যেক প্রার্থী তাঁদের খরচ রেজিস্টার বইয়ে লিপিবদ্ধ করবেন এবং উল্লিখিত কর্মকর্তা প্রতি সপ্তাহে সেই বই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কমিশনে রিপোর্ট পাঠাবেন, এতে প্রার্থীরা বাড়তি খরচের ব্যাপারে সতর্ক হবেন। ফলে কোনো প্রার্থী এক কোটি টাকা ব্যয় করে কাগজপত্রে ১৫ লাখ টাকা দেখাতে পারবেন না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে আগে থেকে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া। বিশেষ করে, নারী ও সংখ্যালঘু ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন, নির্বাচন কমিশনকে সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ আবু হেনা ধন্যবাদ।
No comments