ছিটমহল-শূন্যের অধিবাসীরা মাটির কাছে আসতে চায় by শান্ত নূরুননবী
অক্সফাম (ইন্ডিয়া) জিবির কর্মী ও পার্টনারদের নিউজলেটার লিংকস-এর এপ্রিল ২০০২ সংখ্যায় পরেশ মাতলা ও অরিন্দম সেনের রচনা ডিসপ্লেসড ফ্যামিলিস ইন ইন্ডিয়ায় বলা হচ্ছে, ‘বাংলাদেশের ভেতরের ভারতীয় ছিটমহলের অধিবাসীরা ১৯৫০ সাল থেকেই নানা সুযোগে সীমানা অতিক্রম করে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা শুরু করেছে। তাদের মধ্যে (২০০২ অবধি) ১৪৫০ পরিবার দার্জিলিং জেলার দুটি কলোনিতে বসবাসরত।
ভারতীয় ছিটমহল থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আসা এই মানুষগুলো ভারতের নাগরিক হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশাসন তাদের (বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ) অভিবাসী গণ্য করে। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ন্যূনতম রাস্তাঘাট দিয়ে চলাচলের অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পানীয় জল, স্যানিটেশন সবকিছু থেকে তারা বঞ্চিত।’ কিন্তু কেন মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার এই ঝুঁকি নেওয়া?
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অভ্যন্তরে ভারতের দাসিয়ারছড়া ছিটমহল। দাসিয়ারছড়ার পেটে আবার বাংলাদেশের ছিট চন্দ্রখানা। দূরে ভারতের ভেতরেই বাংলাদেশের মশালডাঙ্গা, করলা। ছিটমহলগুলোতে নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। কখনো ছিল না কোনো শুমারির ব্যবস্থাও। কোনো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় আইনশৃঙ্খলার বালাইও নেই। দাসিয়ারছড়ার কোনো কোনো শিশু মিথ্যা পরিচয় ব্যবহার করে বাংলাদেশের স্কুলে পড়তে আসে। অসুস্থরা আসে চিকিৎসা নিতে। কিন্তু নিজেদের দেশের পরিচয় তারা দিতে পারে না। নাগরিকত্ব বলে কোনো কিছু আছে কি না, জানে না ওরা। এই পরিচয় সংকট থেকে মুক্তি পেতেই একটি দেশের মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া। নৈরাজ্যকর নেই-রাজ্যের পরিচয়হীনতার চেয়ে অভিবাসী হওয়াটা মন্দ কী!
একইভাবে ভারতের ভেতর বাংলাদেশের ছিটের মানুষেরাও দেশহীনতার অমানবিক পরিস্থিতির জাঁতাকলে নিষ্পেষিত। সেখানকার শিশুদের সাধ্য নেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর চোখ ফাঁকি দিয়ে স্কুলে যায়। ছিট করলার ৩০০ পরিবারের অনেকেই বিদেশের (ভারত) বাজারে মাছ বিক্রি করতে যাওয়ার অপরাধে জেল খেটেছেন। ফলে তাঁদের জীবিকার একমাত্র উৎস ছিট করলার বিল ইজারা দিতে হয় ভারতীয় নাগরিকের কাছে!
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ছিট শিব প্রসাদের পরিস্থিতি রূপকথার সহিংসতাকেও হার মানায়। ৯০০ একরের এই ছিট প্রসাদ মুস্তফি নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন ভূমি হলেও বাস্তবে এর ভোগদখল করছেন ভারতের চ্যাটার্জি পরিবারের লোকজন। ভারতের বৈদ্যনাথ চ্যাটার্জি এবং বিশ্বেশ্বর চ্যাটার্জি উত্তরাধিকার সূত্রে এখন এই ছিটের দৃশ্যমান মালিক। তাঁরা এখানকার দেড় শ পরিবারের কাছে রাজাবাবু নামে অভিষিক্ত। রাজাবাবুরা দিনহাটা শহর থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে এখানে আসতে পারলেও কোনো শিব প্রসাদবাসীর সাধ্য নেই প্রকাশ্যে দিনহাটা যায়। অন্যদিকে চিকিৎসা কিংবা জরুরি প্রয়োজনে ভারতের জমির ওপর দিয়ে ফুলবাড়ীতে আসাও দুঃসাধ্য। তার ওপর অন্যান্য ছিটের মতোই আইনবিরোধীরা জবরদস্তি করেই আশ্রয় নিয়ে থাকে এই ছিটে।
ওদিকে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীঝাড় সীমান্ত থেকে চার কিলোমিটার দূরে আড়াই হাজার মানুষের ছিটমহল পোয়াতুরকুঠি। ৬০০ একরের এই ছিটমহলের ভেতর দিয়ে ভারতের দুই বাজার চৌধুরীহাট ও বামনহাটকে সংযুক্ত করে সড়ক নির্মিত হয়েছে ছিটের বাইরের ভারতীয়দের যাতায়াত সুবিধার জন্য। এখানকার কোনো কোনো শিশু মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ভারতের স্কুলে যায়, ভারতের জাতীয় সংগীত গায়। এই ছিটের আবদুল কাদের, ফয়েজ উদ্দীন, মনসুর আলী, নবীবর, জামদুলসহ অনেকেই ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। তাঁরা মনে করেন, ‘তিনবিঘা সমস্যার সমাধান করে কেবলমাত্র দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষের মুখে হাসি ফোটালেই চলবে না। ভারত-বাংলাদেশের চিহ্নিত সব ছিটমহলের মানুষকে দেশহীনতা, নাগরিকত্বহীনতার নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হবে।’
ভারত-বাংলাদেশের প্রতিটি ছিটমহলের অধিবাসীরা ছিটমহল বিনিময় চুক্তি সম্পাদন ও বাস্তবায়নের দাবিতে জোর আন্দোলন শুরু করেছেন। সম্প্রতি ১০ দিনব্যাপী অনশন, স্বাক্ষর সংগ্রহ (৫০ হাজার বাংলাদেশি ও ৭০ হাজার ভারতীয় স্বতঃস্ফূর্ত স্বাক্ষর দেন), সাইকেল মিছিল, মশাল মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে দুই দেশে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ, ভোটাধিকারের মতো মৌলিক অধিকারবঞ্চিত ছিটমহলবাসীরা মনে করেন, ১৯৫৮-এর নেহরু-নুন চুক্তি কিংবা ১৯৭৪-এর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মতো হাসিনা-মনমোহন চুক্তি বাক্সবন্দী চুক্তি হলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তার জন্য দুই দেশের সরকারই দায়ী হবে।
ছিটমহলগুলো যেন জেলের ভেতরের এক একটি সেল। ভারতের ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার ভেতর বাংলাদেশের ছিট চন্দ্রখানার মতো জটিল ভৌগোলিক বন্দিত্বকে ছিটমহল বিনিময় ছাড়া আর কোনো পন্থায় সমাধানের উপায় আছে বলে মনে হয় না। তিনবিঘা করিডর উন্মুক্ত হওয়ায় দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার জীবনযাপনে নিঃসন্দেহে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করবে। কিন্তু বাদবাকি ১৬১টি ছিটমহলের বাসিন্দারা কি এই একবিংশ শতকেও পৃথিবীর অধিবাসী হয়ে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করবেন?
এখানকার শিশুরা কি নিরক্ষর থাকাটাই নিয়তি বলে মেনে নিতে বাধ্য হবে? ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবাও কি এরা পাবেন না? এরা কি প্রজন্ম পরম্পরায় নিজ দেশে অনুপ্রবেশের অপরাধ করে যাবেন? যেকোনো দেশের সন্ত্রাসীরা ছিটগুলোকে গায়ের জোরে নিজেদের অভয়ারণ্য হিসেবে কি ব্যবহার করতেই থাকবে? ছিটমহলের বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়েদের কি ছিটমহলের বাইরে বিয়ে করার অধিকারও থাকবে না?
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমরা আর চুপ করে থাকব না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরেও এই ৬৪ বছরের সমস্যা সমাধান না হওয়ায় আমরা দুঃখিত।’
পরিচয় গোপন করে লেখাপড়া শেখা কুড়িগ্রাম জজকোর্টের আইনজীবী আনোয়ার হোসেন গণির গ্রামের বাড়ি একটি ছিটমহলে। তিনি মনে করেন, ‘দুই দেশের ছিটমহলে বসবাসকারী বাঙালিরা যেভাবে অবরুদ্ধতা ও নাগরিকত্বহীনতার অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে জোটবদ্ধ হয়েছে, এই আন্দোলন আরও বেগবান হবে। দেশের মূল ভূখণ্ডের মানুষেরাও এই আন্দোলনে শামিল হবে।’
শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।
No comments