পাঠদান-উচ্চশিক্ষায়ভুলে যাওয়ার মহামারি by এ কে এম নওশাদ আলম

ইদানীং বেশ লক্ষ করা যাচ্ছে যে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ুয়া ছাত্ররা নিকট অতীতে পড়া বেশির ভাগ বিষয় খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাচ্ছে। গত সেমিস্টারে পড়া বিষয়ের বেশির ভাগ এখন আর মনে নেই। এর আগের বছরের বিষয়গুলো তো কোনোভাবেই স্মরণ করতে পারে না। অধীত বিষয় থেকে জিজ্ঞেস করলে প্রায়ই কোনো উত্তর আসে না।


কখনো কখনো চলমান সেমিস্টারের আগের পড়ানো, এমনকি নিকট-গত ক্লাসের বিষয়বস্তুও তারা মনে করতে পারে না। এই ভুলে যাওয়ায় তাদের কোনো বিকার নেই, অনুশোচনা বা দায়বদ্ধতা নেই। এর মধ্যেই ক্লাস চলছে, পরীক্ষার বৈতরণী পার হচ্ছে, ডিগ্রি বিতরণ হচ্ছে। অনুসন্ধান করে দেখেছি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অথবা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী এই ভুলে যাওয়ার ফাঁদে আটকা পড়েছে। বিভিন্ন কলেজের বিজ্ঞান বিষয়ের কয়েকজন শিক্ষক স্নাতক পরীক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় সঠিক উত্তর না পাওয়ার বহু বিব্রতকর ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। বুদ্ধিমানেরা সঠিক উত্তর দিতে না পারলে লজ্জায় লাল হয় বা দৃষ্টি আনত হয়। অন্যরা উদ্ভট উত্তর দেয় বা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে আনে। ভুলে যাওয়ার বিষয়টি যে আগেও ঘটত না তা কিন্তু নয়, শিক্ষণ-প্রক্রিয়ার সূচনালগ্ন থেকেই এর অস্তিত্ব রয়েছে। তবে ইদানীংকালের উচ্চশিক্ষায় এটা মহামারির আকারে ঘটছে। শিক্ষার মানের সামগ্রিক অধোগতিতে এটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ক্লাসে বা পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের এই গভীর নীরবতা শিক্ষক হিসেবে পীড়া দেয়, পাঠদানে অক্ষমতাকেও প্রকট করে। দেখা গেছে, প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরা অধীত বিষয়ের প্রায় সবটাই মনে রাখতে পারে, অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে তা পারে না। এতে প্রচলিত শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে আশঙ্কা আরও প্রবল হয়।
মানুষের ভুলে যাওয়াটা একটি নিয়মিত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নতুন জ্ঞান আহরিত হতে থাকলে পুরোনো জ্ঞান মস্তিষ্ক থেকে মুছে যাবে—এটাই নিয়ম। মানুষের পরিণত মস্তিষ্কে মোটামুটি ৫০০ থেকে ৮০০ কোটি সক্ষম মেমোরি সেল রয়েছে, সেগুলো ওই পরিমাণ শব্দ-তথ্য ধারণ করতে পারে। ভান্ডার পূর্ণ হয়ে গেলেও নতুন তথ্য ঢোকানোয় কোনো অসুবিধা হয় না। পুরোনো, দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহূত বলে অপ্রয়োজনীয় তথ্যকে ঠেলে বের করে দিয়ে নতুন তথ্য জায়গা করে নেয়। মস্তিষ্ক অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ছাঁটাই-বাছাই করে আমাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞানকে জীবনব্যাপী ধারণ করার ও নতুন প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করার পথ প্রশস্ত করে দেয়। তাই আরও শেখার প্রয়োজনে ভুলে যাওয়াটা দোষের নয়। কিন্তু মস্তিষ্ক কি এতই ছোট যে সংসারজীবনের দলনে পড়ার বহু আগেই কাঁচা মস্তিষ্কের ছাত্রছাত্রীরা এই মাত্র পঠিত বিষয় ভুলে যাবে? ১৬ বা ১৮ বছরের শিক্ষাজীবনের আহরিত জ্ঞানকে ধরে রাখতে পারবে না? প্রয়োজনের সময় তা মনে করতে পারবে না? কোর্সের বাইরে তারা কি আরও অনেক কিছু শিখছে, যা ধারণের জন্য মস্তিষ্ক তাদের পড়া বিষয়কেই বের করে দিচ্ছে? তারা কি অনেক মহৎ অর্জনের আশায় কোর্স-কারিকুলামের বাইরে নানা কাজে নিবিষ্ট আছে, যাতে লেখাপড়ায় চাপ পড়েছে? বাস্তবতা বলে—না, মোটেও তা নয়। তাদের কোর্স-বহির্ভূত অর্জন আজ বহুলাংশে নিম্নগামী। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধুলা শিকেয় উঠেছে, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তেমন প্রাণচাঞ্চল্য নেই, নানা স্বার্থের দ্বন্দ্বে মানবীয় গুণাবলি—সমমর্মিতা, মমত্ববোধ, ত্যাগ, অন্যের জন্য উৎকণ্ঠা, পরোপকার, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদিতে ধুলো জমেছে। কোর্স-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়ায় কোর্সকেন্দ্রিক লেখাপড়ার জন্য ছাত্ররা নিশ্চয় এখন অধিক সময় হাতে পাচ্ছে। তার পরও তারা পড়া মনে রাখতে পারছে না কেন?
নানা কারণে আমাদের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা আজ ধ্বংসের দোরগোড়ায়। দেশের উচ্চশিক্ষাকে বাঁচানোর স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এই ‘মহা ভুলে যাওয়া’ যজ্ঞের কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা দরকার। গত জানুয়ারি মাসে বিএইউ গ্র্যাজুয়েটদের শিক্ষার মানোন্নয়নের কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে একটি অংশগ্রহণমূলক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় শিক্ষক ও নীতিনির্ধারকেরা অনেক কথা বলেছেন, তবে ছাত্রছাত্রীদের দলগত পর্যালোচনায় যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তা বেশি প্রাসঙ্গিক। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাবলি চিহ্নিত করা বা এর সমাধানের জন্য সুপারিশ তৈরিতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিতান্তই জরুরি বিষয়, যা ওই কর্মশালার মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কোর্স বা ক্লাসের আধিক্য, পরীক্ষাপদ্ধতির দুর্বলতা বা ভৌত সুযোগ-সুবিধার অভাব ছাড়াও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বা বোঝাপড়া নিয়ে খোলাখুলি মতামত প্রদান করেছে। শিক্ষকদের যথেষ্ট প্রস্তুতি না নিয়ে ক্লাসে যাওয়া, লেকচারসূচিতে অনিয়ম, বিশেষ ছাত্রছাত্রীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, মৌখিক পরীক্ষায় কোর্সের বাইরে থেকে প্রশ্ন করা ইত্যাদির পাশাপাশি একটি গুরুতর বিষয় উঠে এসেছে। তা হলো ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে যোগাযোগ-ফাঁক। অর্থাৎ কার্যকরী বোঝাপড়ার অভাব। প্রচলিত শিক্ষাদান পদ্ধতির গ্যাঁড়াকলে শ্রেণীকক্ষে ছাত্র-শিক্ষক বিনিময়ের অভাব, শিক্ষকদের তরফ থেকে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা না করার প্রবণতা বা সময় কম দেওয়ার ব্যাপারটি ছাত্রছাত্রীদের তরফ থেকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শ্রেণীকক্ষে যে কার্যকরী অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা পরিপূর্ণভাবে চালু নেই, তা অনেক শিক্ষকও স্বীকার করেছেন। শিক্ষার্থীরাও যে এটা অনুধাবন করে ক্লাসে বেশি বেশি ছাত্র-শিক্ষক যোগাযোগের দাবি তুলেছে, তা নিতান্তই আশার কথা।
সমীক্ষায় দেখা গেছে: প্রথমত, উদ্দেশ্যহীনতা বা ভিশনের অভাব শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগী করে তুলছে। দ্বিতীয়ত, ফটোকপি করা পুরোনো নোটের অতি সহজপ্রাপ্তি তাকে নিয়মিত পড়াশোনা থেকে বিরত রাখছে। তৃতীয় কারণটি হচ্ছে, বর্তমান নম্বর প্রদান পদ্ধতি। পরীক্ষার খাতায় যেমন-তেমন লিখেও ফেল করার ভয় নেই বলে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় আরও অমনোযোগী হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি-চটকদার সংস্কৃতিও তাদের পড়াশোনা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে বলে অনেক ছাত্রছাত্রী মতামত দিয়েছে। তবে প্রধান কারণ, ছাত্রছাত্রীদের ভিশন সৃষ্টি করে দিতে পারছি না বলে আমরা শিক্ষকেরাও দায় এড়াতে পারি না। লক্ষ্য স্থির করতে না পারার ফলেই বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পড়াশোনা না করে অলস সময় পার করছে। এই সময়ে করণীয় হচ্ছে, শ্রেণীকক্ষকে পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীবান্ধব করা। ছাত্রদের কাছ থেকেও আজ একই দাবি উচ্চারিত হচ্ছে।
ড. এ কে এম নওশাদ আলম: অধ্যvcK, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
nowsad12@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.