বিচার বিভাগে নিয়োগ-বার কাউন্সিলের সনদ-বিড়ম্বনা

২০১১ সালের ২২ এপ্রিল তারিখে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় এ বছরের ৯ জানুয়ারি। বার কাউন্সিলের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর গত বছরের ১৪ জুলাই বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ পদে নিয়োগ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়।


এই বিজ্ঞপ্তিতে নজিরবিহীনভাবে আইন পেশার অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্রীয় একটি সার্ভিসের প্রবেশ-পদে প্রার্থিতার যোগ্যতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যেটি আইন শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আইন শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের হতাশার কথা জানান। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমেও তাঁদের ন্যায়সংগত দাবিদাওয়া ও আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এমনই পরিস্থিতিতে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখের অব্যবহিত পূর্বে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন তাদের শর্ত সামান্য শিথিল করে বার কাউন্সিলের লিখিত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সনদ জমা দিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমোদন দেয়। শিক্ষার্থীরা শর্ত পূরণ সাপেক্ষে পরীক্ষার ফরম পূরণ করেন। কিন্তু বার কাউন্সিল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার আট মাস অতিবাহিত হলেও ওই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় না। ফলাফল প্রকাশের বিলম্বের কারণ সম্পর্কে কোনো সন্তোষজনক উত্তর বার কাউন্সিলের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশিত হয়। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীরা ২৭ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে শুরু হওয়া জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষা যখন শেষ পর্যায়ে তখন গত ৯ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে আইনজীবী নিবন্ধন লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। ফলাফলে দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। যাঁদের অনেকেই সহকারী জজ নিয়োগ প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিলেন।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, সহকারী জজ পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অবতীর্ণ অনেক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন। দেশের শীর্ষ আইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় প্রথম দিকে স্থান করে নেওয়া অনেকেই বিস্ময়করভাবে আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছেন। নিবন্ধনের শর্তটি আরোপ করার সময় এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অন্যতম একটি যুক্তি ছিল, বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় চরম অব্যবস্থাপনা ও দীর্ঘসূত্রতা। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ নিয়োগের ফরম পূরণ থেকে শুরু করে লিখিত পরীক্ষা পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়েও কেন ফলাফল প্রকাশিত হয়নি, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন, সংশয়, সন্দেহ, গুঞ্জন ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যায় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় চল্লিশের অধিক প্রার্থী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় শতাধিক প্রার্থী ওই নিবন্ধন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন, যা নজিরবিহীন এক ঘটনা। ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শিক্ষার্থীরা তাঁদের উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য বার কাউন্সিল বরাবর আবেদন করেন। এরই মধ্যে ১ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে আইনজীবী নিবন্ধন মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ধার্য করা হলেও পুনর্মূল্যায়নের আবেদনের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয়নি।
এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা চরম অনিশ্চয়তা ও বিচারিক পদে তাঁদের অংশগ্রহণের বিষয়ে চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। যদি বিষয়টির যথাযথ সুরাহা না হয়, তবে ষষ্ঠ জুডিশিয়াল সার্ভিস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অনেক প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন না। তাতে লিখিত পরীক্ষা-উত্তর পর্যায়ে প্রার্থীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাবে এবং অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ও দুর্বল প্রার্থীরা কেবল মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েই সার্ভিসে নিয়োগ পাবেন, যা কিনা বিচার বিভাগের সার্বিক ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে সবার কাছেই বার কাউন্সিলের পরীক্ষা-পদ্ধতির নানা অসংগতির বিষয়টি স্পষ্ট। তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই সময়ে, যখন সব গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় উন্নত প্রযুক্তি (ওএমআর ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয়, তখনো বার কাউন্সিলের পরীক্ষাটি মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতেই চলছে। যেমন উত্তরপত্রের ওপর সামান্য আঠা দিয়ে লাগানো থাকে একটি ছোট কাগজ, যাতে প্রার্থীর নাম ও রোল নম্বর লিখতে হয়, যা যেকোনো সময় খুলে উত্তরপত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া খুবই সম্ভব। সে ক্ষেত্রে একজন মেধাবী প্রার্থী সন্তোষজনক উত্তর করেও অকৃতকার্য হতে পারেন। অপর দিকে বিগত সময়ে বার কাউন্সিল বছরে একাধিক পরীক্ষা নিলেও এখন বছরে একটিমাত্র পরীক্ষা নিচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা এ প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচার বিভাগে নিয়োগ লাভের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের প্রস্তাব থাকবে, অবিলম্বে বিষয়টির একটি সুষ্ঠু ও যৌক্তিক সুরাহা করুন।
বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক ও বিশেষত আইনের শিক্ষার্থী হিসেবে বিরাজমান অনিশ্চয়তায় আমরা উদ্বিগ্ন। আইন শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময়ের লালিত স্বপ্ন যেন দীর্ঘসূত্রতা, অস্বচ্ছতা ও অযৌক্তিক শর্ত আরোপের কারণে ভূলুণ্ঠিত না হয়, এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল সবার সুবিবেচনা কাম্য। বিষয়টিকে কোনোভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। কেননা, বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পর মেধাবীদের আইন শিক্ষার প্রতি যে বিশেষ আগ্রহ লক্ষ করা গেছে, আমরা চাইব না কোনো কারণেই তা ব্যাহত হোক। আমরা মনে করি, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আইন অঙ্গনে আসার মধ্য দিয়েই বিচারব্যবস্থা আরও আধুনিক ও গতিশীল হয়ে উঠবে। সে কারণে ষষ্ঠ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের প্রিলিমিনারি ও এক হাজার নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কোনো পরীক্ষার্থীই যেন মৌখিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অমূলক বিড়ম্বনার শিকার না হন, সে বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের সযত্ন দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী।

No comments

Powered by Blogger.