রঙ্গব্যঙ্গ-নতুন সিইসির সঙ্গে কাল্পনিক কথাবার্তা by মোস্তফা কামাল

প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক সচিব কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ। কর্মজীবনে তিনি খুবই যোগ্য, দক্ষ এবং সৎ কর্মকর্তা ছিলেন বলে আমরা শুনেছি। হয়তো সে কারণেই আবার তাঁর ডাক পড়েছে। কথায় বলে না, 'পুরনো চাল ভাতে বাড়ে!' তাই প্রশাসনের পুরনো মানুষদের কদর বড্ড বেশি।


সাবেক সিইসি এ টি এম শামসুল হুদাও যোগ্য কর্মকর্তাদের একজন ছিলেন। যে যাই বলুক, তিনি নির্বাচন কমিশনকে একটা বিশ্বাসযোগ্য অবস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। নবনিযুক্ত সিইসি সম্পর্কেও একই ধারণা করা যেতে পারে। অবশ্য সবাই বলছে, অতীতে কাজী রকিব নাকি নিয়মের বাইরে কিছুই করেননি। এখনো নিশ্চয়ই তিনি সেই নিয়ম মেনে চলবেন। আমরা তাঁর কাল্পনিক কথাবার্তা পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরছি।
প্রশ্ন : দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরোধপূর্ণ। এ সময় আপনাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আপনার অনুভূতি কী?
সিইসি : ঠিকই বলেছেন। রাজনীতি এখন বিরোধপূর্ণ। এ সময় সিইসি হিসেবে ফেরেস্তা নিয়োগ দিলেও আরেকপক্ষ না-ই বলবে। প্রধান বিরোধী দল আমার নিয়োগকে অবৈধ বলছে। তাদের এই প্রতিক্রিয়ায় বড়ই দুঃখ পেলাম। আমি আশা করেছিলাম, আমার নিয়োগটিকে সব দল স্বাগত জানাবে। আমি তো জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ সব সরকারের আমলেই কাজ করেছি। সবাই আমার সম্পর্কে জানেন। বিএনপির আমলে আমি সচিব ছিলাম। প্রশাসনের শীর্ষপদে থেকে দায়িত্ব পালন করেছি। নিশ্চয়ই তখন বেগম জিয়া আমার কোনো ত্রুটি পাননি! পেলে তো আর সচিব পদে থাকতে পারতাম না! সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আমার নিয়োগ চূড়ান্ত করেছেন রাষ্ট্রপতি। এতে আপত্তি না জানালে আমি খুশি হতাম। তবে আমি এখনো আশাবাদী। বিএনপি না বলার অভ্যাস পরিত্যাগ করবে। তাদের ভুল নিশ্চয়ই ভাঙবে।
প্রশ্ন : আপনি কী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে মনে করেন?
সিইসি : কেন পারব না, অবশ্যই পারব। আমি এটা খুব ভালো করেই বুঝি, নির্বাচন কমিশনকে ভালোভাবে চালাতে হলে একজন ভালো প্রশাসক দরকার। আমি নিজের ব্যাপারে বলতে পারি, আমি প্রশাসনটাকে বুঝি। আমি শক্ত হাতে কমিশনকে পরিচালনা করতে সক্ষম হবো। আর নিরপেক্ষ নির্বাচন! আমি সবার সহযোগিতা পেলে এ কাজে নিশ্চয়ই সফল হব।
প্রশ্ন : বিএনপি যদি নির্বাচন বয়কট করে?
সিইসি : বিএনপি বুদ্ধিমান হলে নির্বাচন বয়কট করবে না। তারা কিছুতেই ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেবে না।
প্রশ্ন : তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল না করলে নির্বাচনে যাবে না।
সিইসি : সেটা তাদের দলীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সরকারকে চাপে রাখার একটা পলিসি হতে পারে। তারা তাদের দাবি-দাওয়া তুলতেই পারে। কিন্তু নির্বাচন বয়কট করবে বলে মনে হয় না।
প্রশ্ন : বিদায়ী সিইসি বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা কঠিন। আপনি কী এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত?
সিইসি : উঁনি ওঁনার অভিজ্ঞতার আলোকে কথাটি বলেছেন। আমি তাঁর বক্তব্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে এটা ঠিক, যে ব্যবস্থায়ই নির্বাচন হোক, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা দরকার। এর কোনো বিকল্প নেই। আপনারা জানেন, নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্ব থাকে নির্বাচন কমিশনের ওপর। নির্বাচন কমিশন যদি স্বাধীন ও শক্তিশালী হয়, তাহলে আর কোনো কিছুরই প্রয়োজন হয় না। ব্রিটেন, আমেরিকা এমনকি ভারতের দিকে তাকিয়ে দেখেন! সেখানে নির্বাচন চলাকালীন সরকার ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা পালন করে। নির্বাচন কমিশন যেভাবে চায় প্রশাসন সেভাবে পরিচালিত হয়। আমাদের এখানে সেটাই নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্ন : নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে করণীয় কী?
সিইসি : আমি মনে করি, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। অথচ এ বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। সবাই তত্ত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। অথচ নির্বাচন কমিশনই হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে কোনো ব্যবস্থা দিয়েই কাজ হবে না। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় গলদ থেকেই যাবে। এখন তহবিলের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সরকারের কাছে ধরনা দিতে হয়। ইচ্ছা করলেই কমিশন সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনকে নির্বাচনী কাজে নিয়োগ দিতে পারে না। এজন্য সরকারের কাছে চিঠি লিখতে হয়। সেখানে আবার আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে হয়। (আমি নিজেও সাবেক আমলা) এ বিষয়গুলোর ফয়সালা হওয়া দরকার। তাই আমি মনে করি, কিভাবে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করা যায়, সে বিষয়ে এখনই সব রাজনৈতিক দলের সংলাপ হওয়া উচিত।
প্রশ্ন : বিএনপি তো বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো আলোচনাও করবে না।
সিইসি : তা তো দেখছিই। কিন্তু সব কিছুতে না না করা মানে তো নিজেদের পায়ে কুড়াল মারা। বিএনপি এমন আচরণ কেন করছে বুঝতে পারছি না। গণতান্ত্রিক রাজনীতির অর্থই হচ্ছে, পরমতসহিষ্ণুতা, আলোচনা, সংলাপ এবং সমঝোতা। আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনের গণতন্ত্রেও সংকট আছে। সেই সংকট কাটানোর জন্য তারা কিন্তু আলোচনা-সংলাপ করে। এর কোনো বিকল্প নেই। ইস্যুভিত্তিক আলোচনায় রাজপথ উত্তপ্ত হতে পারে। তবে তা কোনোভাবেই সংসদকে অকার্যকর করে নয়। বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে হবে।
প্রশ্ন : আপনি ব্যক্তিগতভাবে কি নিরপেক্ষ?
সিইসি : যেকোনো প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষই কাউকে না কাউকে ভোট দেয়। কোনো না কোনো পক্ষ করে। সেটা দোষের বিষয় নয়। দেখতে হবে লোকটির কাজ। কাজটা নিরপেক্ষ কি না সেটাই বড় ব্যাপার। আমি সারা জীবন সরকারি চাকরি করেছি। সব সরকারের আমলেই কাজ করেছি। কই, তখন তো কেউ আমার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করেনি! আমি আসলে জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করেছি। তবে এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমি কোনো দিনই দলবাজি করিনি। এখন যেমনটি দেখছি, প্রশাসনে কেউ কেউ পদ পদবির জন্য বড় বেশি দলবাজি করে থাকেন।
প্রশ্ন : আপনি বুকে হাত দিয়ে বলুন, দায়িত্ব পালনে আপনি শতভাগ নিরপেক্ষ থাকবেন।
সিইসি : এই আমি বুকে হাত দিয়ে বলছি, দায়িত্ব পালনে আমি শতভাগ নিরপেক্ষ থাকব।
প্রশ্ন : আমরা আপনার সাফল্য কামনা করছি।
সিইসি : এই কথাটা যদি বিএনপি বলত তাহলে খুব ভালো লাগত। আমি আবারও বলি, যেদিন দেখব, আমি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছি না, সেদিন আর সিইসি পদে থাকব না। কথা দিলাম। আল্লাহ হাফেজ।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.