কুনওয়ার ইদ্রিস-অপরিবর্তিত বেদনা
আমেরিকার লাইফ ম্যাগাজিনের ১৯৪৮ সালের ৫ জানুয়ারি সংখ্যার প্রধান সংবাদের শিরোনাম ছিল, 'পাকিস্তানের টিকে থাকার সংগ্রাম (পাকিস্তানস স্ট্রাগল ফর সারভাইবাল)। এই কাহিনীর উপশিরোনাম ছিল, 'ধর্মীয় সংঘাত ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা নতুন জন্ম নেওয়া সাত কোটি মানুষের এই জাতির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।' ৬০ বছরেরও অধিক সময় পর যদি এখন লেখা হতো, তাহলে সাত কোটির বদলে লিখতে হতো ১৮ কোটি মানুষের দেশ।
বাংলাদেশও (তৎকালীন পাকিস্তান) ছিল অন্তর্ভুক্ত। এখন একসঙ্গে থাকলে লোকসংখ্যা হতো ৩৫ কোটি। গত ৬৪ বছরে এই দেশটির লোকসংখ্যাও লাফিয়ে তিন কোটি থেকে ১৮ কোটিতে পেঁৗছেছে।
আজ এই দ্রুত পরিবর্তনের এই যুগে পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য এবং পাকিস্তান সম্পর্কে ধারণা অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। ধর্মীয় সংঘাত তখন ছিল কাশ্মীরের সীমান্ত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। আজ তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং দেশটিকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। লাইফ পত্রিকা তখন পাকিস্তান সম্পর্কে বলেছিল, দেশটি অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের বিরুদ্ধে নিবিড় যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সে যুদ্ধে এখনো পরাজিত না হওয়ার কারণ বিদেশি সাহায্য এবং ঋণের নিয়মিত রিশিডিউল করা।
তখন লাইফ ম্যাগাজিন উল্লেখ করেছিল, 'অসুস্থ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছাড়া পাকিস্তানের খুব কম জাতীয় পর্যায়ের নেতা আছেন।' ম্যাগাজিনের মতে, তখন উল্লেখ করার মতো আর পাবলিক ফিগার ছিলেন নুসরাত হারুন, খয়েরপুর এস্টেটের শাসক মীর 'জর্জ' আলী মুরাদ খান তালপুর এবং প্রায় অন্ধ, দন্তহীন এবং প্রায় অশিক্ষিত সোয়াতের ওয়ালী, যিনি তাঁর 'অ্যাফিসিয়েন্ট ফিল্ড টেলিফোন সিস্টেম' বিষয় নিয়ে সোচ্চার ছিলেন।
রাজ্যটি বিলুপ্তির পর মালাকান্দোর কোনো এক সন্ধ্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠাতা ওয়ালীর অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত, শক্তিশালী পুত্র জাহানজইব খান তৎকালীন রাজনৈতিক প্রতিনিধির কাছে বলেছিলেন, আইয়ুব খান তাঁর রাজ্য নিয়ে গেছেন; আজ হোক আর কাল হোক, তা সেসব যোদ্ধার হাতে হস্তান্তর করবেন যাদের তাঁর বাবা ধূর্ততা ও নিষ্ঠুরতা দিয়ে পোষ মানিয়েছিলেন। এক প্রজন্ম পর, তাঁর সে কথা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। মরুভূমির প্রশান্ত মীর, যোদ্ধা ওয়ালী এবং পাহাড়ের মেহতার তখন থেকেই আঞ্চলিক এবং সন্ত্রাসীর পরিচয়ে পরিচিত হন। জাতীয় নেতার জায়গাটি ১৯৪৮ সালের চেয়েও আরো শূন্য হয়ে পড়ে। সেই বিলুপ্ত নওয়াব এবং উপজাতীয় সর্দাররা আজকের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়ে অনেক বেশি জনগণের কাছাকাছি ছিলেন। এখন চারপাশে যে অসন্তোষ বেড়ে চলেছে তার কারণ যদি খতিয়ে দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে, প্রশাসনে দুর্নীতি, অপরাধীদের শাস্তি প্রদানে বিচার বিভাগের বিলম্ব, সিভিল ডিসপুট এবং দরিদ্রদের অধিকার খর্ব প্রধানত দায়ী। আগে সব ধরনের বিতর্ক সীমান্ত এলাকাতেই যুবরাজ, রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং জিরগার দ্বারা কয়েক ঘণ্টায় বা কয়েক দিনে অথবা বড়জোর কয়েক সপ্তাহে সমাধান হয়ে যেত। এখন তা বছরের পর বছর বিলম্ব হয় এবং জনগণ ভাগ্যাহত হয়। ১৯৪৭-৪৮ সালের অর্থনীতি এবং অবকাঠামোর সঙ্গে এখনকার সময়ের তুলনা চলে না। কিন্তু তার পরও অবমাননাকর কিছু তুলনা উল্লেখ না করে পারা যায় না। রেলপথ যে মাইলের হিসাবে হয়তো এখনো একই পরিমাণ আছে, অথবা কিছু কমেছে। কিন্তু রেলওয়ের সম্প্রসারণ এবং সার্ভিসের মান একসময়ে গর্বের বিষয় ছিল, এখন তা লজ্জার বিষয়।
কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা এখন সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত। রেলওয়ের ধ্বংস এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শিক্ষায় বাজেটের নিম্ন শতাংশ বরাদ্দ হলো আরেকটি উদাহরণ। আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কয়েক বছরে পাকিস্তানে প্রাইভেট কার উৎপাদন ৩৩ হাজার থেকে বেড়ে এক লাখ ৭৬ হাজারে উন্নীত হয়েছে (পাঁচ গুণেরও বেশি)। কিন্তু বাসের উৎপাদন নেমে এসেছে দেড় হাজার থেকে মাত্র ৫০০তে। কিছুদিন আগে পাঞ্জাবের চিফ মিনিস্টার সরকারের কার-ট্যাঙ্ িসার্ভিসের উদ্বোধন করেছেন। ট্যাঙ্ ি ভাড়া এক কিলোমিটারে কমপক্ষে ১০ রুপি। কিন্তু যে আট হাজার বাস কেন্দ্রীয় সরকার ভাড়ার ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে বড় বড় শহরের রাস্তায় নামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার একটি বাসও গত তিন বছরে রাস্তায় নামেনি। ধর্মীয় সংঘাত, আইনশৃঙ্খলাহীনতা এবং অর্থনৈতিক ব্যর্থতার দায় অতীত এবং বর্তমান রাজনীতিবিদদের। কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রশ্ন যে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান হয়েছিল তা আজ সংবিধান থেকে শুরু করে জনজীবন ও প্রতিষ্ঠানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনীর জন্য জিয়াউল হকের স্লোগান ছিল 'জিহাদ ফিসাবিলিল্লাহ'। যদি সেনাবাহিনী শুধু সীমান্তের পাহারা না দিয়ে দেশের মানুষের বিশ্বাসকে রক্ষা করতে চায়, তাহলে সেটা করার একমাত্র উপায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তগত করা। বাস্তবে তারা সেটাই অতীতে করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু রাজনৈতিক নেতার বিবেচনা সেনাবাহিনীর শাসন ক্ষমতা গ্রহণের জন্য সহায়ক হয়ে উঠেছে। কর্তব্যের হিসেবে সেনাবাহিনীর সীমান্ত রক্ষা করা হলো দায়িত্ব এবং রাষ্ট্র জনগণের কল্যাণে কাজ করবে। জনগণ তাদের নিজেদের বিশ্বাস যার যার মতো গ্রহণ করবে। বর্তমানে যে আরবের আন্দোলন শুরু হয়েছে তা ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রশ্নে নয়, বরং গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার এবং দমন-পীড়নের প্রশ্নে। এখান থেকে পাকিস্তানের শিক্ষা নেওয়ার বিষয় আছে।
লেখক : পাকিস্তানের সাবেক আমলা। দি ডন থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
আজ এই দ্রুত পরিবর্তনের এই যুগে পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য এবং পাকিস্তান সম্পর্কে ধারণা অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। ধর্মীয় সংঘাত তখন ছিল কাশ্মীরের সীমান্ত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। আজ তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং দেশটিকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। লাইফ পত্রিকা তখন পাকিস্তান সম্পর্কে বলেছিল, দেশটি অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের বিরুদ্ধে নিবিড় যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সে যুদ্ধে এখনো পরাজিত না হওয়ার কারণ বিদেশি সাহায্য এবং ঋণের নিয়মিত রিশিডিউল করা।
তখন লাইফ ম্যাগাজিন উল্লেখ করেছিল, 'অসুস্থ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছাড়া পাকিস্তানের খুব কম জাতীয় পর্যায়ের নেতা আছেন।' ম্যাগাজিনের মতে, তখন উল্লেখ করার মতো আর পাবলিক ফিগার ছিলেন নুসরাত হারুন, খয়েরপুর এস্টেটের শাসক মীর 'জর্জ' আলী মুরাদ খান তালপুর এবং প্রায় অন্ধ, দন্তহীন এবং প্রায় অশিক্ষিত সোয়াতের ওয়ালী, যিনি তাঁর 'অ্যাফিসিয়েন্ট ফিল্ড টেলিফোন সিস্টেম' বিষয় নিয়ে সোচ্চার ছিলেন।
রাজ্যটি বিলুপ্তির পর মালাকান্দোর কোনো এক সন্ধ্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠাতা ওয়ালীর অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত, শক্তিশালী পুত্র জাহানজইব খান তৎকালীন রাজনৈতিক প্রতিনিধির কাছে বলেছিলেন, আইয়ুব খান তাঁর রাজ্য নিয়ে গেছেন; আজ হোক আর কাল হোক, তা সেসব যোদ্ধার হাতে হস্তান্তর করবেন যাদের তাঁর বাবা ধূর্ততা ও নিষ্ঠুরতা দিয়ে পোষ মানিয়েছিলেন। এক প্রজন্ম পর, তাঁর সে কথা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। মরুভূমির প্রশান্ত মীর, যোদ্ধা ওয়ালী এবং পাহাড়ের মেহতার তখন থেকেই আঞ্চলিক এবং সন্ত্রাসীর পরিচয়ে পরিচিত হন। জাতীয় নেতার জায়গাটি ১৯৪৮ সালের চেয়েও আরো শূন্য হয়ে পড়ে। সেই বিলুপ্ত নওয়াব এবং উপজাতীয় সর্দাররা আজকের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়ে অনেক বেশি জনগণের কাছাকাছি ছিলেন। এখন চারপাশে যে অসন্তোষ বেড়ে চলেছে তার কারণ যদি খতিয়ে দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে, প্রশাসনে দুর্নীতি, অপরাধীদের শাস্তি প্রদানে বিচার বিভাগের বিলম্ব, সিভিল ডিসপুট এবং দরিদ্রদের অধিকার খর্ব প্রধানত দায়ী। আগে সব ধরনের বিতর্ক সীমান্ত এলাকাতেই যুবরাজ, রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং জিরগার দ্বারা কয়েক ঘণ্টায় বা কয়েক দিনে অথবা বড়জোর কয়েক সপ্তাহে সমাধান হয়ে যেত। এখন তা বছরের পর বছর বিলম্ব হয় এবং জনগণ ভাগ্যাহত হয়। ১৯৪৭-৪৮ সালের অর্থনীতি এবং অবকাঠামোর সঙ্গে এখনকার সময়ের তুলনা চলে না। কিন্তু তার পরও অবমাননাকর কিছু তুলনা উল্লেখ না করে পারা যায় না। রেলপথ যে মাইলের হিসাবে হয়তো এখনো একই পরিমাণ আছে, অথবা কিছু কমেছে। কিন্তু রেলওয়ের সম্প্রসারণ এবং সার্ভিসের মান একসময়ে গর্বের বিষয় ছিল, এখন তা লজ্জার বিষয়।
কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা এখন সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত। রেলওয়ের ধ্বংস এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শিক্ষায় বাজেটের নিম্ন শতাংশ বরাদ্দ হলো আরেকটি উদাহরণ। আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কয়েক বছরে পাকিস্তানে প্রাইভেট কার উৎপাদন ৩৩ হাজার থেকে বেড়ে এক লাখ ৭৬ হাজারে উন্নীত হয়েছে (পাঁচ গুণেরও বেশি)। কিন্তু বাসের উৎপাদন নেমে এসেছে দেড় হাজার থেকে মাত্র ৫০০তে। কিছুদিন আগে পাঞ্জাবের চিফ মিনিস্টার সরকারের কার-ট্যাঙ্ িসার্ভিসের উদ্বোধন করেছেন। ট্যাঙ্ ি ভাড়া এক কিলোমিটারে কমপক্ষে ১০ রুপি। কিন্তু যে আট হাজার বাস কেন্দ্রীয় সরকার ভাড়ার ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে বড় বড় শহরের রাস্তায় নামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার একটি বাসও গত তিন বছরে রাস্তায় নামেনি। ধর্মীয় সংঘাত, আইনশৃঙ্খলাহীনতা এবং অর্থনৈতিক ব্যর্থতার দায় অতীত এবং বর্তমান রাজনীতিবিদদের। কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রশ্ন যে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান হয়েছিল তা আজ সংবিধান থেকে শুরু করে জনজীবন ও প্রতিষ্ঠানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনীর জন্য জিয়াউল হকের স্লোগান ছিল 'জিহাদ ফিসাবিলিল্লাহ'। যদি সেনাবাহিনী শুধু সীমান্তের পাহারা না দিয়ে দেশের মানুষের বিশ্বাসকে রক্ষা করতে চায়, তাহলে সেটা করার একমাত্র উপায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তগত করা। বাস্তবে তারা সেটাই অতীতে করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু রাজনৈতিক নেতার বিবেচনা সেনাবাহিনীর শাসন ক্ষমতা গ্রহণের জন্য সহায়ক হয়ে উঠেছে। কর্তব্যের হিসেবে সেনাবাহিনীর সীমান্ত রক্ষা করা হলো দায়িত্ব এবং রাষ্ট্র জনগণের কল্যাণে কাজ করবে। জনগণ তাদের নিজেদের বিশ্বাস যার যার মতো গ্রহণ করবে। বর্তমানে যে আরবের আন্দোলন শুরু হয়েছে তা ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রশ্নে নয়, বরং গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার এবং দমন-পীড়নের প্রশ্নে। এখান থেকে পাকিস্তানের শিক্ষা নেওয়ার বিষয় আছে।
লেখক : পাকিস্তানের সাবেক আমলা। দি ডন থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
No comments