লন্ডনের চ্যারিটিওয়ালারা by ফারুক যোশী

বাংলাদেশে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা আছে। এ আলোচনা চলবে। এখানেও হয়তো রাজনীতি আসবে। হয়তো এখানেও পাওয়া যাবে রাজনীতির নোংরা খেলা। বাংলাদেশে কিংবা পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান কোনো নতুন ঘটনা নয়। সময়ে সময়ে এ রকম ক্যু হয়েছে। বাংলাদেশের আজকের বড় দুটো দল বিএনপি আর জাতীয় পার্টি তো ওই সামরিক ছাউনির হত্যার রাজনীতির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা ক্যু-রাজনীতির ফসল।


সুতরাং সামরিক বাহিনীর প্রভাব কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশকে প্রভাবিত করে কিংবা করবে- এটাই তো স্বাভাবিক। এর আগে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি ক্যু কিংবা সামরিক অভ্যুত্থানে কোনো না কোনোভাবে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মদদের কথা চাউর হয়েছে এবং পৃথিবীর দেশে দেশে বিদেশিদের সহায়তায় যা সংঘটিত হয়, সেভাবেই ঘটেছে এই ক্যু কিংবা অভ্যুত্থানগুলো। কিন্তু এবারে বাংলাদেশের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে যা ঘটেছে, তা রীতিমতো আমাদের তাক লাগিয়েছে। ব্রিটেনে একজন অভিবাসী হিসেবে তা আমাকে কিছুটা হলেও অপরাধী করেছে। এই ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটি নিয়ে আমরা এখন গর্ব করি। অনেক ক্ষেত্রেই বাঙালিদের সফলতা চোখে লাগার মতো এবং এই সফলতা শুধু কমিউনিটির মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই। ব্রিটেনের রাজনীতিতে এখন বাঙালিরা প্রভাব বিস্তারকারী অংশ। এই সফলতার কারণেই আমরা দেখি দেশীয় নেতানেত্রীদেরও ব্রিটেনে এসে হাউস অব কমন্সে যাতায়াত, লর্ডসভা, বিশ্ব রাজনীতিতে লবিং ম্যানটেইন প্রভৃতি। এ সব কিছু আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু এই ভালো লাগায়ই আমরা মাঝে মাঝে ধাক্কাও খাই। আমাদের কমিউনিটির একটা গ্রুপের উগ্র মৌলবাদ সংশ্লিষ্টতা বিভিন্ন সময়েই মূল গণমাধ্যমগুলোতে আলোড়ন তুলেছে। গোটা কমিউনিটিকে হেয় করেছে এই ব্রিটেনে। কিন্তু তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে- এ খবরটি জেনেছে ব্রিটেনের বাঙালিরা মাত্র কদিন আগে। অনেকের কাছেই এ রকম খবর অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু এ রকম খবর আমার মতো অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ ব্রিটেনের টিভি চ্যানেলগুলোতে যেভাবে ধর্মের নাম নিয়ে চাঁদা তোলার হিড়িক পড়েছে, তাতে এ রকম কিছু ঘটতেই পারে, এ কথাগুলো এর আগে বিভিন্নভাবে আমরা বলার চেষ্টা করেছি। চাঁদা তোলায় কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ এখানে বাঙালিদের একটা শক্ত মুসলিম কমিউনিটি আছে। এখানে আছে নয়নাভিরাম মসজিদগুলো। মুসলমানদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের জন্য এখানে মানুষ চাঁদা দেয় মুক্ত হাতে। এই ব্রিটেনে তাদের পরের জেনারেশনকে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার প্রতি অন্তত মনোযোগী করে তুলতে এটা জরুরিও, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর ব্রিটেনে অভিবাসী মুসলিম জনগোষ্ঠীর এই অনুভূতিকে ব্যবহার করেই এখানে শুরু হয়েছে একটা শ্রেণীর ভিন্ন পাঁয়তারা। পবিত্র ধর্ম ইসলামের নাম করে গরিব-এতিম-কোরআন-সুন্নাহ-জাকাত-কোরবানির মাংস প্রভৃতির নাম নিয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর থেকেই টিভি চ্যানেলগুলোতে বিভিন্ন চ্যারিটি সংগঠনের নাম নিয়ে অর্থ সংগ্রহ চলছে। কখনো বাংলাদেশে সহযোগিতার কথা বলে, কখনো আফ্রিকায় পানির জন্য হাহাকার করা শিশুদের হাড্ডিসার দেহগুলো দেখিয়ে মানুষের মানবতা বোধটাকে ব্যবহার করছে তারা। কিন্তু এই অর্থগুলো এলেও যাচ্ছে কোথায়? এর কোনো খবর কেউ রাখে না। অথচ বাংলাদেশের স্থায়ী কোনো সমস্যা সমাধানে এ চ্যারিটিগুলো কোনো কাজই করছে না। দুই বছর আগে এনটিভিতে একটি চ্যারিটি দেখেছিলাম। ঢাকার ডায়াবেটিক হাসপাতালের জন্য অর্থ সহায়তা চেয়েছিলেন হাসপাতালের প্রধান মানুষগুলো, নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তাররা। কিন্তু মানুষের সাড়াটা সেখানে মোটেই আশাব্যঞ্জক ছিল না। কারণ অর্থ তোলার ধরনটা এমন এক জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, যেখানে ধর্মটাকে শুধু ব্যবহার করা হচ্ছে, ধর্মীয় কিছু টার্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে, অথচ ধর্মের যে প্রধান কথাটি 'মানবতার কল্যাণ' তা তুলে ধরার চেষ্টা নেই। আর তাই তো কল্যাণকামী একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে হাজারো মানুষ প্রতিদিন উপকৃত হয়, সেখানে অর্থ ওঠেনি আশানুরূপ। অর্থ ওঠে ওই ধর্মীয় টার্মগুলোর কারণে, অদৃশ্য প্রয়োজনে।
যেহেতু টিভি চ্যানেলগুলোই ওই তথাকথিত চ্যারিটি সংগঠনগুলোর চাঁদা তোলার প্রধান মাধ্যম, সেহেতু কিছু শাড়ি বিতরণের চিত্র কিংবা হাড্ডিসার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে পানির বোতল তুলে দেওয়ার ফুটেজ দিয়ে বিজ্ঞাপিত চিত্রে আকর্ষণ বাড়ায় দর্শকদের, দুখী হয়ে ওঠে মানুষ। তারপর রাতের লন্ডনের টিভি প্রোগ্রামগুলোতে আল্লাহর নামে উঠতে থাকে অঢেল পাউন্ড। এই অর্থে কেউ হেলিকপ্টারে করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘোরেন, কেউবা আবার নতুন মডেলের গাড়িতে লন্ডন শহর চষে বেড়ান। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এই লিল্লা (আল্লাহর ওয়াস্তে অর্থ সংগ্রহ) তুলে তুলে কেউ আবার সেলিব্রিটিও হয়ে গেছেন। এই সেলিব্রিটিদেরই কয়েকজনের নাম এসেছে ইদানীং ঢাকার কাগজগুলোতে। তাঁদের অর্থ সংগ্রহ ব্রিটেনের সব বাঙালিই দেখেছে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের নাম নিয়ে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে এদের অর্থ সংগ্রহও দেখেছে মানুষ। পাউন্ড দিয়েছে ধর্মভীরু মানুষগুলো। কিন্তু এই অর্থের ব্যবহার সবাইকে যেন বিস্মিত করেছে। এই খবরটি প্রকাশ হওয়ার পর ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে আছে নানা প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের মৌলবাদী রাজনীতি নিয়ে যে প্রবাসীরা উদ্বিগ্ন, তাদের অনেকেই ব্যাপারটাকে অবিশ্বাসও করতে পারছে না। আর বিশেষত সাধারণ মানুষ, যারা এসব প্রতিষ্ঠানকে নেহায়েত আল্লাহর নাম শুনে পাউন্ড দেয়, তারা রীতিমতো দুঃখ পেয়েছে, কেউ কেউ তো বিশ্বাসই করতে পারছে না। কারণ ওই সাধারণ সরলপ্রাণ মানুষেরা পৃথিবীর সব জায়গায়ই কিছুসংখ্যক ধর্ম ব্যবসায়ী দ্বারা বারবার ব্যবহৃত এবং প্রতারিত হয়েছে। এই ব্রিটেনেও এরা প্রতারিত হয়েছে। তবে এসব খবর সাধারণ মানুষের কাছে এদের মুখোশ উন্মোচনে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে বলে আমরা মনে করতে পারি। ব্রিটেনের বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো বাঙালিদের বাংলা অনুষ্ঠানমালা উপহার দিচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটা এ কমিউনিটির জন্য এক বড় ধরনের প্রাপ্তি। তাও আবার একদম বিনা পয়সায় (ফ্রি ভিউইং)। বাংলাদেশের অনুষ্ঠানগুলো পুঁজি করে এখানে ধর্মীয় নামাজ-কালাম কায়েমকারী একটা গ্রুপ সৃষ্টি হতেই পারে। এটা হবেও। আমরা প্রত্যাশাও করি এ রকম ইসলামী মূল্যবোধ নিয়ে একটা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এখানে বেড়ে উঠুক, যারা যুক্তি দিয়ে ইসলামকে পরিচিত করাবে এই ভিন্ন সংস্কৃতির দেশে। কিন্তু তা না করে কোনো কোনো চ্যানেলে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সুকৌশলে নিজেদের আসন শক্ত করে ফেলেছে এবং ওই গোষ্ঠীই চ্যানেল মালিকদের কোনো না কোনোভাবে ব্যবসায়িক লাভালাভ দেখিয়ে হয়তো তাদের অজান্তেই জঙ্গি তৎপরতায় বাংলাদেশের মতো দেশের জঙ্গিদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ওই মৌলবাদী জঙ্গিদের অর্থ সহায়তার জন্য সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে এরা। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ওই গোষ্ঠীরই অর্থ সহায়তায় একটি গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে একটি রক্তাক্ত অধ্যায় রচনা করতে চেয়েছিল তারা বাংলাদেশে। সে কারণেই আমাদের বিশ্বাস, ব্রিটেনের বাঙালিদের এখন থেকে অন্তত বুঝে নিতে কষ্ট হবে না যে ধর্মের নাম নিয়ে চাঁদা তোলার অর্থগুলো মূলত যায় কোথায়? ব্রিটেনের স্থানীয় মসজিদ ছাড়া যেকোনো ধরনের চ্যারিটির নাম নিয়ে আসা ধর্মীয় লেবাসের মানুষগুলোর মুখোশ অনেক আগেই উন্মোচিত হওয়া জরুরি ছিল। সেটা না হওয়ায় আজ এমনকি ওদের অর্থ সহায়তায় বাংলাদেশ ক্রমেই এগোচ্ছিল একটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের দিকে। আমরা ভাবতে বলি টিভির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। সঙ্গে সঙ্গে সচেতনতা জাগাতে উদ্যোগী হতে আহ্বান জানাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের কথা বলে যারা ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে মঞ্চ তোলপাড় করে তাদের। বাংলাদেশ সরকারও এখন থেকে বিশেষত বিদেশি চ্যারিটি সংগঠনগুলোর চ্যারিটি কাজগুলো মনিটর করতে সচেষ্ট হোক।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক
Faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.