স্থানীয় প্রজাতির শস্যবীজের বিলুপ্তি by এ এম এম শওকত আলী

২১ জানুয়ারি একটি ইংরেজি দৈনিকের খবর। গত ১০০ বছরে প্রায় সাত হাজার শস্যবীজ বিলুপ্ত হয়েছে। এর কারণ হিসেবে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবকে চিহ্নিত করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের আশঙ্কার বিষয়টি শত বছরের নয়, সাম্প্রতিককালের। ধরে নেওয়া যেতে পারে, গত এক দশক ধরে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এ বিতর্কে লিপ্ত। দুই বছর ধরে এটি একটি স্বীকৃত বিষয়।


তবে স্থানীয়ভাবে চাষকৃত বহু ধরনের এবং বিভিন্ন নামের শস্যবীজ, বিশেষ করে, ধান ও শস্যের বিলুপ্তির প্রধান কারণ উচ্চ ফলনশীল (উফশী) বা আধুনিক বীজের অধিকতর ব্যবহার। উফশী বীজের আবির্ভাব ষাট দশকের সবুজ বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত। এর ব্যবহারের ফলে স্থানীয় প্রজাতির বীজের ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটে। এ যেমন ছিল, এখনো আছে, একটি অপ্রতিরোধ্য বিষয়। স্থানীয় প্রজাতির বিলুপ্তি প্রক্রিয়া নিয়ে সময় সময় উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও, এ নিয়ে তথ্যবহুল আলোচনা অত্যন্ত অপ্রতুল। বিলুপ্তি অপ্রতিরোধ্য হওয়ার প্রধান কারণ উফশী বীজ স্থানীয় প্রজাতির তুলনায় অধিক ফলনশীল।
প্রবীণ কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, ষাট দশকের শেষার্ধেও এ বীজ ব্যবহারে কৃষকরা তেমন আগ্রহী ছিল না। এর কারণ ছিল উফশী বীজ, রাসায়নিক সার ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। কৃষকদের বদ্ধ ধারণা কিছুটা সত্যি ছিল, রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে ফসলি জমিতে পোকার আক্রমণ বেশি হয়। এ ধারণা ছিল অভিজ্ঞতালব্ধ। অন্যদিকে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত বিএডিসির প্রধান দায়িত্ব ছিল উফশী বীজ, সার ও সেচের ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে এ কাজ বিএডিসি করত। বিএডিসির প্রবীণ কর্মকর্তাদের মতে, সার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে তাঁরা ওই সময় রাতের অন্ধকারে নিজেরাই জমিতে সার প্রয়োগ করতেন কৃষকদের অজ্ঞাতে। কৃষকরা যখন ভালো ফলন অর্জনে সক্ষম হয়, তারপর এ কারণটি কর্মকর্তারা তাদের জানাতেন। এ প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে কৃষকরা সার ব্যবহারে রাজি হয়। সঙ্গে উফশী বীজও।
সবুজ বিপ্লবের সময়ে উফশী বীজের প্রসার বহুলাংশে অপেক্ষাকৃত ভালো জমিতেই ব্যবহার করা হয়। সবুজ বিপ্লবের নীতি বাস্তবায়নের স্বপক্ষে কাজ করেছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ধারণা। এর সঙ্গে জড়িত ছিল স্বাস্থ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা অর্জনের বিষয়। অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের জমি উফশী বীজের আওতাবহির্ভূত ছিল। সবুজ বিপ্লব অর্জনের জন্য সব সরকার সার ও সেচ ব্যবহার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রচুর বিনিয়োগও করেছিল। এখনো করা হচ্ছে। সুফলও অর্জিত হয়। একফসলি জমি, দুফসলি এবং ক্ষেত্রভেদে তিনফসলি জমিতে রূপান্তরিত হয়। প্রাক ১৯৪৭ সময়ে অবিভক্ত বরিশাল জেলা বাংলার শস্যভাণ্ডার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করে। পরবর্তী সময় এ জেলা খাদ্যঘাটতি জেলায় পর্যবসিত হয়। এ এলাকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকারি নজরও ছিল কম। লবণাক্ততাসহ সাইক্লোন অধ্যুষিত উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় এটা হতে পারে। বর্তমানে দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলেই সর্বাধিক খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। এর কারণ আশির দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ওই সব অঞ্চলেই সেচব্যবস্থা চালুর জন্য সরকার সর্বাধিক বিনিয়োগ করে। ওই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিই সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। মূলত গভীর ও অগভীর নলকূপের পানি। এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। কারণ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নমুখী। সার্বিক পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এ অবস্থার জন্য বর্তমানে গৃহীত কৌশল হলো, বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমন ধান উৎপাদন বৃদ্ধি। একই সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলসহ অন্যান্য অনুন্নত অঞ্চলে বোরোসহ আউশ ও আমনের উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বোরো ধান বর্তমানে মোট আবাদযোগ্য এলাকা ও হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের সিংহভাগ। উফশী বীজ ব্যবহারের দিক দিয়েও এ ধানে সর্বাধিক বীজ ব্যবহৃত হয়। জানা যায়, মোট এলাকার প্রায় ৯৫ ভাগ। আমনের ক্ষেত্রে এ জাতের বীজের ব্যবহারের মাত্রা প্রায় ৬০ ভাগ। আউশ ধানে সবচেয়ে কম। বোরো ধান চাষের এলাকা বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হলো আউশ ও আমনের তুলনায় বোরো একটি নিরাপদ ফসল। অর্থাৎ এ ধান উৎপাদনের মৌসুম হলো শীতকাল। ওই সময় ঝড়-বৃষ্টি বা বন্যার আশঙ্কা থাকে না। ধান উৎপাদনের জন্য সর্বাধিক পানি ও সারের প্রয়োজন হয়।
২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করি সিডর সাইক্লোনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মূলত বরিশাল বিভাগের জেলাগুলো। তবে খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলাও এর ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা পায়নি। এ কারণে সরকার ২০০৮ সাল থেকেই উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হয়। এ অঞ্চলে সারভিত্তিক প্রযুক্তিসহ লবণাক্তসহিষ্ণু উফশী বীজ ও অন্যান্য উফশী বীজ ব্যবহার সম্প্রসারণের চেষ্টার ফলে প্রথমে ইলশাফার্ম এবং বর্তমানে চলমান আপি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। সারভিত্তিক প্রযুক্তির জনপ্রিয় নাম গুটি ইউরিয়া। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে হেক্টরপ্রতি ফলন শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ উদ্যোগের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় বিশেষ করে কৃষিমন্ত্রী প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। মন্ত্রণালয়ের অভিপ্রায় ও অগ্রাধিকার ছিল দৃঢ়ভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে। ফলে অপেক্ষাকৃত উন্নত এলাকা থেকে উৎপাদন কৌশল এ অঞ্চলেই নিবদ্ধ হয়। গৃহীত উদ্যোগ ফলপসূ হয়েছে।
ফলপ্রসূ হওয়ার প্রমাণ ইতিমধ্যে মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। একটি ইংরেজি দৈনিকে বলা হয় যে বরিশাল বিভাগের সব কয়টি জেলায় এ বছর আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অধিকতর হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের গৃহীত উদ্যোগের অবদানের মাত্রা সম্পর্কে এখনো কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকালেও সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে এ মন্ত্রণালয়ের উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন কৌশল বাস্তবায়নের ফলেই এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। এখন মুখ্য প্রশ্নটি হলো, ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে কি না। এটাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এ চ্যালেঞ্জের মধ্যে সুযোগও রয়েছে। সুযোগটি হলো, উপযুক্ত উফশী বীজ, সার প্রযুক্তি (গুটি ইউরিয়া) এবং সেচব্যবস্থা উন্নয়নের চেষ্টা অব্যাহত রাখা সম্ভব হলো উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদনও অব্যাহত থাকবে।
সুখবরটি হলো, আপি প্রকল্প এলাকায় মিশ্র সারের গুটি ব্যবহৃত হবে। গত বছর কৃষিমন্ত্রী বিএআরসির এক সভায় এ বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন। মিশ্র গুটিতে ইউরিয়া ও ডিএপি ব্যবহার করা হবে। ফলে ফলন বৃদ্ধি ছাড়াও কৃষকের শ্রম বাবদ ব্যয় হ্রাস সম্ভব হবে। তবে এর সঙ্গে কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত করতে হবে। বরিশাল অঞ্চলের কৃষকরা এ বিষয়টিই মিডিয়াকে বলেছে। অতীতেও মাঝেমধ্যে কৃষকদের এমন প্রতিক্রিয়া শোনা গেছে। গত বছর ও বর্তমান বছরে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া শোনা যাচ্ছে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে এ বছর প্রকাশিত সংবাদে আলু, পাট ও পেঁয়াজ চাষিরাও একই অভিযোগ করেছে। এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। এর কারণও বহুবিধ।
এক. বাজার কাঠামোর মূল নিয়ন্ত্রক বেসরকারি ব্যবসায়ীরা। তাদের মধ্যে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে বহু ধরনের স্তর রয়েছে। দুই. সরকার তথা খাদ্য মন্ত্রণালয় শুধু ধান-চালই সংগ্রহ করে। উৎপাদিত চাল দুই থেকে তিন কোটি টন হলে সরকার ১০ লাখ টন চালের বেশি সংগ্রহ করতে অপারগ। কারণ এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা অনেক ধরনের। সরকারি মজুদের মধ্যে আমদানিকৃত চালের পরিমাণও কম নয়। তৃতীয়. সব ক্ষমতাসীন দলই চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়। কারণ বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো এটাকেই কেন্দ্র করে সমালোচনা বা আন্দোলন করে।
ফেরা যাক, দেশি প্রজাতির বীজের বিলুপ্তির প্রসঙ্গে। উলি্লখিত সাত হাজার প্রজাতির বিলুপ্তির সংবাদ নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। তবে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এসব বীজ বিএআরসির জিনব্যাংকে সংরক্ষিত। তবে বাস্তবতা হলো, জিনব্যাংক সরকারি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোই সংরক্ষণ করে থাকে। যেমন- ব্রী, বারি ও বিনা। এসব প্রতিষ্ঠানের কৃষি বিজ্ঞানীরা উপযুক্ত ক্ষেত্রে নতুন উফশীজাত উদ্ভাবনের জন্য সংরক্ষিত জিনও ব্যবহার করে। এ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত দেশীয় প্রজাতি জিন নতুন বীজে দেওয়া হয়। এসব প্রজাতির বেশির ভাগ স্বল্পকালীন সময়ে উৎপাদন করা সম্ভব। কিছু প্রজাতি বন্যা বা খরাসহিষ্ণু। যদি দেশীয় প্রজাতির বীজ সযত্নে সংরক্ষিত ও ক্ষেত্রভেদে ব্যবহৃত হয়, তাহলে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। বিলুপ্তির বিতর্কে এখন যে বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, তা হলো জিনব্যাংকগুলো কত সতর্কতার সঙ্গে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় পরিবেশসহ দক্ষ বিজ্ঞানী আছে কি না। এর জন্য প্রয়োজন সম্পূর্ণ বিষয়টি নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা। প্রয়োজনে উপযুক্ত নির্দেশিকা প্রণয়নসহ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.