হরমুজেরই বিকল্প, যুদ্ধের নয়? by জামান সরদার
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল ও তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের হম্বিতম্বির জবাবে তেহরানও ছেড়ে কথা বলছে না। কিন্তু পশ্চিমারা খুব সম্ভবত দেশটির একটি অস্ত্রকেই অব্যর্থ মনে করে, তা হচ্ছে হরমুজ প্রণালি। দুনিয়া বিস্তৃত তেল বাণিজ্যের ২০ শতাংশই চলে ২৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং সর্বনিম্ন ৫০ কিলোমিটার প্রস্থ প্রণালিটি দিয়ে।
তেলের জাহাজ চলাচলযোগ্য নৌপথ আরও সংকীর্ণ, কমবেশি ১০ কিলোমিটার। এর মধ্য দিয়েই পারস্য উপসাগর থেকে ওমান উপসাগর হয়ে বাকি দুনিয়ায় তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে। ইরান যদি সেটা বন্ধ করে দেয়, তেলের বিশ্ববাজার স্বভাবতই অস্থির হয়ে পড়বে। তাতে কেবল ইউরোপ-আমেরিকা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের তেল বিক্রিনির্ভর অর্থনীতিগুলোও ঝামেলায় পড়বে। ঝামেলায় পড়বে বাংলাদেশও। কারণ, ওই প্রণালি দিয়ে যে অপরিশোধিত তেল বহন করা হয়, তার ৮৫ ভাগের গন্তব্য হচ্ছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ।
এসব বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো করে ইরান আক্রমণ করতে যাবে না বলে অনেকে মনে করেন। হরমুজ প্রণালি নিয়ে গত দুই দশকে বেশ কয়েক দফা দুই দেশ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, ছোটখাটো সংঘর্ষও হয়েছে; কিন্তু যুদ্ধ বলতে যা বোঝায়, তাতে জড়ায়নি ওয়াশিংটন। তাই বলে বছরের পর বছর বসেও থাকবে না। ওদিকে ইসরায়েল পারে তো আগামীকালই হামলা করে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসা দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী যেমনটি বলছেন_ আলোচনা, সংলাপ, পরিদর্শন করতে করতে যদি তেহরান পরমাণু অস্ত্র বানিয়েই ফেলে কিংবা কর্মসূচিটি অজ্ঞাত ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় সরিয়ে ফেলে, তাহলে মওকা আর আসবে না। এই পরিস্থিতিতে হরমুজ প্রণালি নিয়ে শুরু হয়েছে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানা হিসাব-নিকাশ।
ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে সেটা খুলতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কতদিন লাগবে? ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একদল বিশ্লেষক হিসাব করে দেখাচ্ছেন, কমবেশি এক সপ্তাহ জাহাজ চলাচল বন্ধ এবং পরবর্তী আরও দু'তিন সপ্তাহ তেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। কিন্তু অপর দল বলছে, বিষয়টি এত সহজ না-ও হতে পারে। কারণ, ইরান ইতিমধ্যে হরমুজ ঘিরে নানা ধরনের শক্তি সমাবেশ করেছে। তাদের এমন কিছু ছোট ও স্মার্ট সাবমেরিন রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে পানির নিচে বোমা পেতে আসা কঠিন নয়। কঠিন নয় ঘাতক টর্পেডো দিয়ে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ঘায়েল করা।
সব মিলিয়ে ভালো বিকল্প হতে পারে হরমুজ প্রণালির বিকল্প তেল পরিবহন পথ খোঁজা। কারণ, তেল 'ইজ নো প্রবলেম'। সৌদি আরব তেলের বাজারে বাড়তি সরবরাহে সদা প্রস্তুত। আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়, নব্বইয়ে ইরাকের কুয়েক আক্রমণের সময়, একুশ শতকের ঊষালগ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আগ্রাসনের সময় সৌদি আরবই তো বিশ্ববাজার ঠাণ্ডা রাখার দায়িত্ব পালন করে এসেছে। সমস্যা একটিই, দেশটির সরবরাহ লাইনের ৭৫ ভাগ হচ্ছে হরমুজ প্রণালিনির্ভর।
সৌদি আরবের আবকাইক থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত অবশ্য প্রায় ১২শ' কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পাইপলাইন রয়েছে। তাতে করে হরমুজের প্রয়োজনীয়তার এক-তৃতীয়াংশও মেটে না। চিন্তা-ভাবনা চলছে 'ড্রাগ রিডাকশন এজেন্ট' ব্যবহারের। তাতে করে পাইপলাইন দিয়ে আরও শক্তিশালী প্রবাহ তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু তাতেও খুব বেশি লাভ হয় না, খরচও কম নয়। বিকল্প পথ খোঁজা হচ্ছে আরব আমিরাতের মধ্য দিয়ে। সেখানে গত কয়েক বছর ধরে ৩৭০ কিলোমিটার পাইপলাইনের নির্মাণ কাজ চলছে। সেটা সম্পন্ন হলে হয়তো আরও এক-দশমাংশ চাহিদা মেটানো যাবে। বাকিটা? চলছে আরও বিকল্পের খোঁজ।
তার মানে, বিকল্প যত অবাস্তব আর ব্যয়বহুলই হোক, সেটাই চাই। যুদ্ধের বিকল্প? নৈবচ নৈবচ।
No comments