দূরের দূরবীনে-বিদেশযাত্রা ও অভিবাসনবিষয়ক সতর্কতা by অজয় দাশগুপ্ত
ভাগ্য অন্বেষণে মানুষের বিদেশযাত্রা বা দেশান্তরী হওয়ার বাসনা নতুন কিছু নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অভিবাসন হচ্ছে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রকৃতি প্রায় ঈশ্বরের ভূমিকায়। এমনকি এ ক্ষেত্রেও। শীতকালে উড়ে আসা অতিথি পাখির কথাই ধরা যাক। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এশিয়ার গাঙ্গেয় বদ্বীপ।
তার পরও অনিন্দ্যসুন্দর যাত্রায় প্রকৃতি ভরিয়ে তোলে অতিথি পাখি। এই যে আগমন, একি সত্যি আনন্দযাত্রা? মূলত জীবনের তাগিদে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দেওয়া। বরফ, শীত, মাইনাস উষ্ণতার জন্য সাইবেরিয়া থেকে প্রাণ বাঁচাতেই উড়ে আসে এরা। খুঁজে নেয় নাতিশীতোষ্ণ অথবা উষ্ণ দেশের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
প্রকৃতির সীমাবদ্ধতা ডিঙানোর জন্য সব প্রাণীর পাখা থাকে না। সে কারণে কিছু প্রাণী একেকটি দেশের বিশেষ আকর্ষণও বটে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙ্গারু বা কোয়েলা কেন পৃথিবীতে বিরল? কেন বিশ্ব-পর্যটকদের অন্যতম দর্শনীয় প্রাণী? কারণ এ দেশটি সমুদ্রবেষ্টিত। অনেক অনেক বছর আগে এশিয়ার সঙ্গে সংলগ্ন থাকার কারণে বলা হতো অস্ট্রেলেশিয়া। কালক্রমে সমুদ্র তাকে বিচ্ছিন্ন অথবা পৃথক করে একঘরে করেছে। আমাদের দেশটি ছোট হলেও অন্তত দুটি দেশে স্থলপথে যাওয়া সম্ভব_ভারত ও মিয়ানমার। এ দুই দেশকে করিডর ধরলে আরো অন্তত পাঁচটি দেশে স্থলভ্রমণ সম্ভব। কিন্তু হয় আকাশ, নয় সমুদ্র। এ ছাড়া বেরোনোর পথ নেই এ দেশে। ক্যাঙ্গারু না জানে উড়তে, না পারে সমুদ্র ডিঙাতে। ফলে সে অস্ট্রেলিয়ার একান্ত। অস্ট্রেলীয় প্রাণী হয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব তো মানুষ।
মানুষ পাখি বা ক্যাঙ্গারু নয়, তার ইচ্ছাশক্তির ডানা আছে। যখন ছিল না, তখনো তার ভ্রমণ-আকাঙ্ক্ষা থেমে থাকেনি। সমুদ্রপথে ঘুরে বেড়াত, আবিষ্কার করত নতুন ভূমি, নতুন দেশ, নব বসতি। বস্তুত সে আমলেই মানুষ পেয়েছিল আশ্চর্য সব ভূখণ্ডের ঠিকানা, আবিষ্কৃত হয়েছে আমেরিকা, ভারত, লাতিন আমেরিকার সভ্যতা ও সংস্কৃতি। কালক্রমে রাইট ব্রাদার্সের কল্পনা আকাশে ডানা মেলল। মানুষের পাখি হয়ে উঠতেও দেরি হলো না।
বলছিলাম অভিবাসনের কথা। প্রকৃতির নিয়মে মানুষ দেশান্তরী হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। বিশ্বায়নের কথা বলে দুনিয়াজুড়ে বাণিজ্য আর পণ্য বেচাকেনার দেশগুলো বিশ্বায়ন মানে, বিশ্বজনীনতা মানে না। ওয়ান প্লানেট বা একক ও অভিন্ন দুনিয়ার স্লোগান হচ্ছে স্বার্থবিষয়ক। সম্পদের সুষম বণ্টন, ন্যায্য হিসসা, প্রকৃতি সুরক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য বা এ-জাতীয় কোনো কিছুর বেলায় কিন্তু হিজ হিজ, হুজ হুজ অর্থাৎ যার যার তার তার। স্বার্থপরতার এই জঘন্য খেলায়ই গড়ে উঠেছে 'তৃতীয় বিশ্ব' নামের অগ্রহণযোগ্য, নিন্দনীয় এক পরিচয়বলয়। কেন এই থার্ড ক্লাস বা তৃতীয় বিশ্ব নাম? আদপে কি তা-ই? একমাত্র ধনসম্পদ, সচ্ছলতা বা বিত্তভৈবব বাদে অধ্যাত্মবাদ, ইতিহাস, সমাজ, আদর্শ পরিবার প্রথা_সব কিছুতে আদর্শ ও অনুকরণীয় দেশগুলোকে তৃতীয় মানে ফেলার কারণ আমার অন্তত বোধগম্য নয়। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর লুণ্ঠিত সম্পদ, তাদের খনি, বন, হীরা, মুক্তা বা জনশ্রমই প্রথম বিশ্বের শক্তির উৎস। আধুনিককালে এদের শ্রম আর মেধাই পহেলা বিশ্বের যাবতীয় কর্মোদ্যোগের চাবিকাঠি।
তবু নিয়তি বলে কথা, নিয়তি আক্রান্ত তৃতীয় বিশ্বের মানুষগুলোর দুর্ভাগ্য তাদের রাজনীতি। শাসক অথবা ক্ষমতাধরদের দোর্দণ্ড প্রতাপে দিশেহারা তারা। কোথাও জনবসতি, কোথাও যানবাহন, কোথাও দারিদ্র্য, কোথাও অশিক্ষা, কোথাও রোগব্যাধি, কোথাও সন্ত্রাস বা পরিবেশগত বিষময় জীবন। ফলে তারা পালাতে চায়। পালাতে চায় বলাটাও অন্যায়। যেসব দেশ অভিবাসনের, যেসব দেশে মানুষ স্থায়ী অথবা দীর্ঘকাল বসবাসের জন্য পাড়ি দেয়, সেসব দেশের শাসক বা কর্তৃপক্ষ বোকা নয়। কাউকে তারা বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসে না। যার যা সাধ্য, যতটুকু মেধা, ততটুকুই নিংড়ে নেওয়া হয়। কোনো কোনো দেশ বা ক্ষেত্রবিশেষে তারও অধিক। আমাদের মেধাবী স্বজনরা বিদেশে এসে করেন না হেন কোনো কাজ নেই। আক্ষরিক অর্থে মেধার অপচয় হলেও এঁরা বাঁচেন কঠোর পরিশ্রমে। এঁদের ট্যাঙ্রে টাকায়, কায়িক ও মানসিক শ্রমে অভিবাসী দেশ ও সমাজ যেমন ফেঁপে ওঠে, সচ্ছল হয়, তেমনি জন্মভূমিও পায় বাড়তি আয় বা উপার্জনের স্বাদ। বাংলাদেশে পাঠানো রেমিট্যান্স এখন বিশ্বব্যাপী নন্দিত, প্রশংসিত ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অভিবাসী দেশগুলোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা ভালো জানেন, দেশগুলো তাঁদের পৈতৃক বা পূর্বপুরুষের নয়। তাই অভিবাসনে কিছু নিয়ম বা আইনকানুন হলেও মূলত তাঁরা এ সুযোগ দিতে বাধ্য। তার পরও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত চলছে প্রাণান্ত চেষ্টা। প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া আইনে গরিব দেশের মানুষের আগমন ঠেকাতে ব্যস্ত তাঁরা। সে রকম একটি প্রাণঘাতী বিষয় নিয়ে লেখার জন্যই কলম ধরেছি। অস্ট্রেলিয়ায় আসতে চাওয়া শরণার্থী অথবা যেকোনো শ্রেণীবিন্যাসিত অভিবাসী বা আশ্রয়প্রার্থীর জন্য আছে নির্দিষ্ট নিয়ম। সেটা মানাটাই আইন। না মানলে কী হয়? যেহেতু নিয়মের দেশ, এ দেশের ভূখণ্ড বা জলসীমায় ঢুকে পড়লে এক ব্যবস্থা, ঢুকতে না পারলে আরেক। কথায় বলে দুর্জনের ছলের অভাব নেই। ঢুকতে না দেওয়ার জন্য একপায়ে খাড়া কর্তৃপক্ষও থেমে নেই। নিজস্ব জলসীমার অনতিদূরে ক্রিসমাস আইল্যান্ড নামের নির্জন দ্বীপে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ জাহাজ বা নৌকা ভর্তি মানুষগুলো তখন না ঘরকা না ঘাটকা, না আছে তাদের নিজস্ব দেশের ক্ষমতা, না স্বপ্ন ও খোয়াব দেখা দেশের সমর্থন। তখন তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অসুস্থতা, মানসিক বৈকল্যে প্রাণঘাতী কাজে ঝাঁপিয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় পেঁৗছতে চায় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। সেটাও কি সহজ? সহজ তো নয়ই, বরং পদে পদে থাকে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা। এযাবৎ অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে, যেটুকু দেখেছি তাতে একজন বাংলাদেশিও নেই। স্বস্তির বটে, কিন্তু ভয় যায় না। যা সমাজ আমাদের। চারদিকে ছোক ছোক করতে থাকা দালাল-ফড়িয়া। আছে প্রবাস থেকে পাঠানো লোভ আর লালসার লোলুপ আহ্বান। সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তি বা সামষ্টিক সর্বক্ষেত্রে শুধু অর্থের লোভ আর নগদ বাণিজ্য। ফলে প্ররোচিত হয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমার ছেলেটি এখন ইউরোপে। ইতালি থেকে কথা হচ্ছিল, বেদনার্ত কণ্ঠে জানাল বাংলাদেশিদের দুরবস্থার কথা, দিনভর ফেরিওয়ালার জীবন, রাতে রোম বা ফ্লোরেন্সের রাস্তায় শুয়ে থাকা। পুলিশের সতর্ক পাহারা, নজরদারিতে ভয়ার্ত এক দুর্বিষহ জীবন। এদের ৯৯ জন পারলেই দেশে ফিরে যায়। কিন্তু একদিকে লগি্ন করা শেষ সম্বল, অন্যদিকে জীবনের অবলম্বন। কষ্ট আর নির্যাতনের নিঃসঙ্গ এই প্রবাসী জীবনের ছবিটা সব দেশেই এক ধরনের।
যারা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড বা অন্য কোনো উন্নত দেশে পাড়ি দিতে চায়, তাদের জন্য ঘুরপথ বলে কিছু নেই। সোজাসাপ্টা পথে সঠিক ভিসায় আসতে পারলে অন্তত খেয়েপরে থাকা সম্ভব। তারপর মেধা ও শ্রমে উত্তীর্ণ হলে দুয়ার খুলতে শুরু করবে। অন্যথায় মানবেতর জীবন আর জীবনের ঝুঁকি ছাড়া কিছুই বাকি থাকবে না। বলে রাখা উচিত, না সরকার না রাষ্ট্রদূত না দূতাবাস_কেউই দাঁড়াবে না পাশে। প্রবাসী বাঙালিরা প্রথম দিকে সহায়তা দিলেও একসময় সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন না পারা যায় ফিরতে, না জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে।
ডিটেনশন সেন্টার নামের কয়েদখানায় যৌবন হারিয়ে নিঃসঙ্গ একা দেশে ফিরে মনসিক অসুস্থতা বাধানোর চেয়ে স্বদেশে পরিশ্রম করে জীবন কাটানোই মঙ্গল। আর যাঁরা আসবেন, তাঁরা যেন সঠিক পদ্ধতিতে নিয়ম মেনে আসেন। আমাদের রাজনীতি দেশটির মঙ্গল ও উন্নয়ন চাইলে দেশত্যাগের হিড়িক অবশ্যই কমানো যেত। তা যখন সম্ভব নয়, প্রকৃত পন্থায় অগ্রসর হওয়াটাই যৌক্তিক। কথায় বলে, ভাবিয়া করিয়ো কাজ করিয়া ভাবিয়ো না।
লেখক : সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com
প্রকৃতির সীমাবদ্ধতা ডিঙানোর জন্য সব প্রাণীর পাখা থাকে না। সে কারণে কিছু প্রাণী একেকটি দেশের বিশেষ আকর্ষণও বটে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙ্গারু বা কোয়েলা কেন পৃথিবীতে বিরল? কেন বিশ্ব-পর্যটকদের অন্যতম দর্শনীয় প্রাণী? কারণ এ দেশটি সমুদ্রবেষ্টিত। অনেক অনেক বছর আগে এশিয়ার সঙ্গে সংলগ্ন থাকার কারণে বলা হতো অস্ট্রেলেশিয়া। কালক্রমে সমুদ্র তাকে বিচ্ছিন্ন অথবা পৃথক করে একঘরে করেছে। আমাদের দেশটি ছোট হলেও অন্তত দুটি দেশে স্থলপথে যাওয়া সম্ভব_ভারত ও মিয়ানমার। এ দুই দেশকে করিডর ধরলে আরো অন্তত পাঁচটি দেশে স্থলভ্রমণ সম্ভব। কিন্তু হয় আকাশ, নয় সমুদ্র। এ ছাড়া বেরোনোর পথ নেই এ দেশে। ক্যাঙ্গারু না জানে উড়তে, না পারে সমুদ্র ডিঙাতে। ফলে সে অস্ট্রেলিয়ার একান্ত। অস্ট্রেলীয় প্রাণী হয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব তো মানুষ।
মানুষ পাখি বা ক্যাঙ্গারু নয়, তার ইচ্ছাশক্তির ডানা আছে। যখন ছিল না, তখনো তার ভ্রমণ-আকাঙ্ক্ষা থেমে থাকেনি। সমুদ্রপথে ঘুরে বেড়াত, আবিষ্কার করত নতুন ভূমি, নতুন দেশ, নব বসতি। বস্তুত সে আমলেই মানুষ পেয়েছিল আশ্চর্য সব ভূখণ্ডের ঠিকানা, আবিষ্কৃত হয়েছে আমেরিকা, ভারত, লাতিন আমেরিকার সভ্যতা ও সংস্কৃতি। কালক্রমে রাইট ব্রাদার্সের কল্পনা আকাশে ডানা মেলল। মানুষের পাখি হয়ে উঠতেও দেরি হলো না।
বলছিলাম অভিবাসনের কথা। প্রকৃতির নিয়মে মানুষ দেশান্তরী হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। বিশ্বায়নের কথা বলে দুনিয়াজুড়ে বাণিজ্য আর পণ্য বেচাকেনার দেশগুলো বিশ্বায়ন মানে, বিশ্বজনীনতা মানে না। ওয়ান প্লানেট বা একক ও অভিন্ন দুনিয়ার স্লোগান হচ্ছে স্বার্থবিষয়ক। সম্পদের সুষম বণ্টন, ন্যায্য হিসসা, প্রকৃতি সুরক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য বা এ-জাতীয় কোনো কিছুর বেলায় কিন্তু হিজ হিজ, হুজ হুজ অর্থাৎ যার যার তার তার। স্বার্থপরতার এই জঘন্য খেলায়ই গড়ে উঠেছে 'তৃতীয় বিশ্ব' নামের অগ্রহণযোগ্য, নিন্দনীয় এক পরিচয়বলয়। কেন এই থার্ড ক্লাস বা তৃতীয় বিশ্ব নাম? আদপে কি তা-ই? একমাত্র ধনসম্পদ, সচ্ছলতা বা বিত্তভৈবব বাদে অধ্যাত্মবাদ, ইতিহাস, সমাজ, আদর্শ পরিবার প্রথা_সব কিছুতে আদর্শ ও অনুকরণীয় দেশগুলোকে তৃতীয় মানে ফেলার কারণ আমার অন্তত বোধগম্য নয়। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর লুণ্ঠিত সম্পদ, তাদের খনি, বন, হীরা, মুক্তা বা জনশ্রমই প্রথম বিশ্বের শক্তির উৎস। আধুনিককালে এদের শ্রম আর মেধাই পহেলা বিশ্বের যাবতীয় কর্মোদ্যোগের চাবিকাঠি।
তবু নিয়তি বলে কথা, নিয়তি আক্রান্ত তৃতীয় বিশ্বের মানুষগুলোর দুর্ভাগ্য তাদের রাজনীতি। শাসক অথবা ক্ষমতাধরদের দোর্দণ্ড প্রতাপে দিশেহারা তারা। কোথাও জনবসতি, কোথাও যানবাহন, কোথাও দারিদ্র্য, কোথাও অশিক্ষা, কোথাও রোগব্যাধি, কোথাও সন্ত্রাস বা পরিবেশগত বিষময় জীবন। ফলে তারা পালাতে চায়। পালাতে চায় বলাটাও অন্যায়। যেসব দেশ অভিবাসনের, যেসব দেশে মানুষ স্থায়ী অথবা দীর্ঘকাল বসবাসের জন্য পাড়ি দেয়, সেসব দেশের শাসক বা কর্তৃপক্ষ বোকা নয়। কাউকে তারা বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসে না। যার যা সাধ্য, যতটুকু মেধা, ততটুকুই নিংড়ে নেওয়া হয়। কোনো কোনো দেশ বা ক্ষেত্রবিশেষে তারও অধিক। আমাদের মেধাবী স্বজনরা বিদেশে এসে করেন না হেন কোনো কাজ নেই। আক্ষরিক অর্থে মেধার অপচয় হলেও এঁরা বাঁচেন কঠোর পরিশ্রমে। এঁদের ট্যাঙ্রে টাকায়, কায়িক ও মানসিক শ্রমে অভিবাসী দেশ ও সমাজ যেমন ফেঁপে ওঠে, সচ্ছল হয়, তেমনি জন্মভূমিও পায় বাড়তি আয় বা উপার্জনের স্বাদ। বাংলাদেশে পাঠানো রেমিট্যান্স এখন বিশ্বব্যাপী নন্দিত, প্রশংসিত ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অভিবাসী দেশগুলোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা ভালো জানেন, দেশগুলো তাঁদের পৈতৃক বা পূর্বপুরুষের নয়। তাই অভিবাসনে কিছু নিয়ম বা আইনকানুন হলেও মূলত তাঁরা এ সুযোগ দিতে বাধ্য। তার পরও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত চলছে প্রাণান্ত চেষ্টা। প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া আইনে গরিব দেশের মানুষের আগমন ঠেকাতে ব্যস্ত তাঁরা। সে রকম একটি প্রাণঘাতী বিষয় নিয়ে লেখার জন্যই কলম ধরেছি। অস্ট্রেলিয়ায় আসতে চাওয়া শরণার্থী অথবা যেকোনো শ্রেণীবিন্যাসিত অভিবাসী বা আশ্রয়প্রার্থীর জন্য আছে নির্দিষ্ট নিয়ম। সেটা মানাটাই আইন। না মানলে কী হয়? যেহেতু নিয়মের দেশ, এ দেশের ভূখণ্ড বা জলসীমায় ঢুকে পড়লে এক ব্যবস্থা, ঢুকতে না পারলে আরেক। কথায় বলে দুর্জনের ছলের অভাব নেই। ঢুকতে না দেওয়ার জন্য একপায়ে খাড়া কর্তৃপক্ষও থেমে নেই। নিজস্ব জলসীমার অনতিদূরে ক্রিসমাস আইল্যান্ড নামের নির্জন দ্বীপে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ জাহাজ বা নৌকা ভর্তি মানুষগুলো তখন না ঘরকা না ঘাটকা, না আছে তাদের নিজস্ব দেশের ক্ষমতা, না স্বপ্ন ও খোয়াব দেখা দেশের সমর্থন। তখন তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অসুস্থতা, মানসিক বৈকল্যে প্রাণঘাতী কাজে ঝাঁপিয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় পেঁৗছতে চায় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। সেটাও কি সহজ? সহজ তো নয়ই, বরং পদে পদে থাকে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা। এযাবৎ অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে, যেটুকু দেখেছি তাতে একজন বাংলাদেশিও নেই। স্বস্তির বটে, কিন্তু ভয় যায় না। যা সমাজ আমাদের। চারদিকে ছোক ছোক করতে থাকা দালাল-ফড়িয়া। আছে প্রবাস থেকে পাঠানো লোভ আর লালসার লোলুপ আহ্বান। সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তি বা সামষ্টিক সর্বক্ষেত্রে শুধু অর্থের লোভ আর নগদ বাণিজ্য। ফলে প্ররোচিত হয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমার ছেলেটি এখন ইউরোপে। ইতালি থেকে কথা হচ্ছিল, বেদনার্ত কণ্ঠে জানাল বাংলাদেশিদের দুরবস্থার কথা, দিনভর ফেরিওয়ালার জীবন, রাতে রোম বা ফ্লোরেন্সের রাস্তায় শুয়ে থাকা। পুলিশের সতর্ক পাহারা, নজরদারিতে ভয়ার্ত এক দুর্বিষহ জীবন। এদের ৯৯ জন পারলেই দেশে ফিরে যায়। কিন্তু একদিকে লগি্ন করা শেষ সম্বল, অন্যদিকে জীবনের অবলম্বন। কষ্ট আর নির্যাতনের নিঃসঙ্গ এই প্রবাসী জীবনের ছবিটা সব দেশেই এক ধরনের।
যারা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড বা অন্য কোনো উন্নত দেশে পাড়ি দিতে চায়, তাদের জন্য ঘুরপথ বলে কিছু নেই। সোজাসাপ্টা পথে সঠিক ভিসায় আসতে পারলে অন্তত খেয়েপরে থাকা সম্ভব। তারপর মেধা ও শ্রমে উত্তীর্ণ হলে দুয়ার খুলতে শুরু করবে। অন্যথায় মানবেতর জীবন আর জীবনের ঝুঁকি ছাড়া কিছুই বাকি থাকবে না। বলে রাখা উচিত, না সরকার না রাষ্ট্রদূত না দূতাবাস_কেউই দাঁড়াবে না পাশে। প্রবাসী বাঙালিরা প্রথম দিকে সহায়তা দিলেও একসময় সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন না পারা যায় ফিরতে, না জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে।
ডিটেনশন সেন্টার নামের কয়েদখানায় যৌবন হারিয়ে নিঃসঙ্গ একা দেশে ফিরে মনসিক অসুস্থতা বাধানোর চেয়ে স্বদেশে পরিশ্রম করে জীবন কাটানোই মঙ্গল। আর যাঁরা আসবেন, তাঁরা যেন সঠিক পদ্ধতিতে নিয়ম মেনে আসেন। আমাদের রাজনীতি দেশটির মঙ্গল ও উন্নয়ন চাইলে দেশত্যাগের হিড়িক অবশ্যই কমানো যেত। তা যখন সম্ভব নয়, প্রকৃত পন্থায় অগ্রসর হওয়াটাই যৌক্তিক। কথায় বলে, ভাবিয়া করিয়ো কাজ করিয়া ভাবিয়ো না।
লেখক : সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com
No comments