কল্পকথার গল্প-বদলে যেত যদি এভাবে জীবন! by আলী হাবিব
দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবন। দিন যেমন বদলে যাচ্ছে, তেমনি বদলে যাচ্ছে আমাদের প্রতিদিনের জীবনাচার। এই পরিবর্তনের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলছি। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও নাগরিক জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে অভিযোজন।
পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দিন পার করে দিচ্ছি আমরা। সব কিছুর সঙ্গে বিজ্ঞান আমাদের জীবন বদলে দিচ্ছে। একেবারে শুরুর দিককার কথাই যদি ধরা যায়, তাহলেই পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ে সহজেই।
একটা সময় ছিল, যখন মানুষের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ডাক। তারও আগে পাখির মুখে বা পায়ে বেঁধে চিঠি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। সেই চিঠি নিয়ে কত অঘটনই না ঘটেছে! এক রাজার গল্প আছে। রাজা মুকুট রায়। তিনি গিয়েছিলেন যুদ্ধে। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন একটা কবুতর। কথা ছিল, যুদ্ধে যদি তিনি পরাস্ত হন, তাহলে এই কবুতর ছেড়ে দেবেন। কবুতর উড়ে আসবে রাজবাড়িতে। কবুতর দেখে রাজবাড়ির লোকরা বুঝতে পারবে, রাজা যুদ্ধে পরাস্ত হয়েছেন। রাজা বলে গিয়েছিলেন, কবুতর উড়ে এলে রাজবাড়ির সদস্যরা দিঘিতে আত্মাহুতি দেবেন। রাজা যুদ্ধে জয়লাভ করলেও কেমন করে যেন কবুতর উড়ে গিয়েছিল। কবুতর উড়ে গিয়ে বসল রাজবাড়ির ছাদে। সবাই ধরে নিলেন রাজা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। রানি তাঁর কন্যাদের নিয়ে রাজবাড়ির বড় দিঘিতে আত্মাহুতি দিলেন। বিজয়ীর বেশে রাজা ফিরে এসে দেখেন, রানি ও রাজকন্যারা কেউ বেঁচে নেই। আজকের দিনে হলে এটা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল। আজকের দিনে মোবাইল ফোন নামের যন্ত্রটি চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। তাতে একান্ত ব্যক্তিগত সময়ের জন্য যন্ত্রণা কিছুটা বাড়লেও যোগাযোগ কত সহজ করে দিয়েছে। ছোট বার্তা কত সহজেই পাঠিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। যদিও আজকের দিনের সিনেমার নায়িকা ভেজা বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে গানে লিপ মেলাচ্ছে, 'যাও পাখি বলো/ হাওয়া ছল ছল...'। কিন্তু প্রিয়তমকে বলার জন্য তার আজ আর পাখির প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই 'যাও পাখি বলো তারে/সে যেন ভোলে না মোরে' লিখে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখার।
শের শাহ এই পোড়া দেশে ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেছিলেন। তার আগেও ঘোড়া ডাকত, কিন্তু ডাক ব্যবস্থায় এত উন্নতি হয়তো ছিল না। ডাক হরকরাদের নিয়ে কবি সুকান্তের তো একটা বিখ্যাত কবিতাই আছে। সূর্য ওঠার আগেই নির্দিষ্ট জায়গাতে চিঠির ব্যাগ পেঁৗছে দিতে হবে। সেই পোস্ট অফিসে যোগ হলো পোস্টাল কোড_দ্রুত চিঠি পেঁৗছে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো। ছিল 'মাদার সিরিয়াস, কাম শার্প' জাতীয় টেলিগ্রাম। আজকের প্রজন্মের কাছে ডাকঘরের প্রয়োজনীয়তা একেবারেই নেই। আজকের প্রজন্ম হয়তো বুঝতেই পারবে না, এক প্রজন্ম আগের মানুষের কাছে একটি চিঠির কি মূল্য ছিল। একটি চিঠির জন্য কি ব্যাকুল প্রতীক্ষায় কেটেছে আগের প্রজন্মের দিনের পর দিন। 'চিঠি দিও প্রতিদিন' জাতীয় গান হিট হয়ে গেছে। এক 'চিঠি দিও মোরে' গেয়ে জগন্ময় মিত্র তো মোহিত করে রাখলেন কয়েক প্রজন্ম। আজকের দিনে আগের মতো চিঠি নিয়ে মাতামাতি নেই। মোবাইল ফোন, ই-মেইল আমাদের দূরত্ব একেবারেই ঘুচিয়ে দিয়েছে। দূরকে নিকট করে দিয়েছে এই ই-মেইল, মোবাইল ফোন। ফেসবুকে ফেস-টু-ফেস, কথার পিঠে কথা চালাচালি চলছে। ফলে 'মাদার সিরিয়াস' জাতীয় টেলিগ্রামের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও চলে গেছে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক। ছোট এই যন্ত্রটি আমাদের জীবনধারা একেবারেই বদলে দিয়েছে। দিন আর রাতের তফাতটাও ঘুচে গেছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট সত্যিকার অর্থেই আমাদের পৃথিবী ছোট করে দিয়েছে। 'দূরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই' জাতীয় বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে ছোট ছোট কিছু যন্ত্র।
এমন আরো কিছু ছোট ছোট জিনিস যদি যোগ হতো আমাদের জীবনে, তাহলে অনেক সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে যেতে। এমন কিছু যন্ত্র যে আমাদের হাতে চলে আসতে যাচ্ছে, সেটা এখন অনুমান করে নেওয়া যেতেই পারে। কয়েকটি খবর পড়ে আশাবাদী হয়ে ওঠে মন। খবরগুলো কালের কণ্ঠেই প্রকাশ হয়েছে। যেমন একটি খবর হচ্ছে, গ্লুকোমা রোগের সহজ নিরাময় আসছে। খবরে বলা হয়েছে, গ্লুকোমা চোখের একটি জটিল রোগ। এ রোগের ফলে মানুষ ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানও পিছিয়ে নেই। গ্লুকোমা রোগ নিরাময়ে বিজ্ঞানীরা নিয়ে আসছেন অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতি। সম্প্রতি ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা জানান তাঁদের এ নতুন গবেষণার কথা। তাঁরা বলেন, আলট্রাসাউন্ডের আলোকরশ্মি সূক্ষ্ম ব্যবহারের মাধ্যমে গ্লুকোমার চিকিৎসা করা যাবে। মাত্র দুই মিনিটেই সারিয়ে তোলা যাবে গ্লুকোমা। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এ পদ্ধতি নিরাপদ, ব্যথাহীন, অধিক নির্ভরযোগ্য ও দ্রুত কার্যকর। দুই মিনিটেই কার্যকর করা যায়।
এর পাশাপাশি আরেকটি খবর হচ্ছে, এক আশ্চর্য চশমা আসছে, যা পরলে কারো সাহায্য ছাড়াই তারা পথ 'দেখে' চলতে পারবে। অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা অত্যাধুনিক এ চশমা তৈরি করছেন। ২০১৪ সালের মধ্যেই এ চশমা বাজারজাত করার উপযোগী হবে বলে তাঁরা আশা করছেন। বিশেষ এই চশমার বৈশিষ্ট্য অন্য চশমার চেয়ে আলাদা। আলাদা এর ব্যবহারের প্রক্রিয়ায়ও। খবরে বলা হয়েছে, এই চশমার ফ্রেমের সামনের দিকে কাচের ওপরের দুই পাশে পিন আকৃতির দুটি গোপন ক্যামেরা বসানো থাকবে। এর গ্লাস এলইডি মডেলের, যাতে অনেক বিন্দু (ডট) থাকবে এবং এ চশমা পরিধানকারীর বুক পকেটে থাকবে মোবাইল ফোন আকৃতির ছোট একটি কম্পিউটার। গোপন ক্যামেরা ও কাচের ডটগুলো প্রতিফলিত ব্যক্তি বা বস্তুর অবস্থান সম্পর্কে পকেটের কম্পিউটারে বার্তা পাঠাবে। পরে কম্পিউটার মুহূর্তেই তা বিশ্লেষণ করে পরিধানকারীর কানে কানে বিষয়টি জানিয়ে দেবে। গবেষকরা বলছেন, এ পদ্ধতির চশমা ব্যবহার করে অন্ধ ব্যক্তি একা একাই কেনাকাটা করতে যেতে পারবে। ব্যস্ততম রেলওয়ে স্টেশনে চলাচল করতে পারবে। বাসের নম্বর পড়তে পারবে এবং কম্পিউটার ব্যবহৃত মেশিনে টাকাও তুলতে পারবে।
আরেকটি খবর তো রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। এ খবরটিকে সুখবর তো বলতেই হবে। তাঁদের জন্য এটা সুখবর, নিয়ম করে ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া যাঁদের একদমই হয় না। বাজারে নাকি এসে গেছে এমন এক ধরনের 'বিস্ময় বড়ি', যা ফল জাতীয় এসব উপাদানের ঘাটতিপূরণে কার্যকর ফল। পিলটির নাম দেওয়া হয়েছে 'জুস প্লাস'। এর আবিষ্কর্তা যুক্তরাষ্ট্রের ভেষজ কম্পানি ন্যাচারাল অলটারনেটিভ ইন্টারন্যাশনাল। যুক্তরাষ্ট্রের সেলিব্রিটি মহলও নাকি এরই মধ্যে পিলটি সাদরে বরণ করে নিয়েছে। অভিযাত্রী দলগুলোর কাছে এটি জনপ্রিয় হয়েছে। জার্মানির অলিম্পিক খেলোয়াড়দের শারীরিক চাহিদার ঘাটতি পূরণে সেব্য তালিকায় রয়েছে পিলটির নাম। যুক্তরাষ্ট্র জয় করে এবার ইউরোপের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে 'জুস প্লাস'। প্রাথমিকভাবে যুক্তরাজ্যে শুরু হয়েছে পিলটির বাজারজাতকরণ। আর সব মাল্টিভিটামিন সাপ্লিমেন্টের মতো হলেও জুস প্লাসের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, টানা পাঁচ দিন ফলমূল ও শাকসবজি না খেলে শরীরে যে ঘাটতি তৈরি হয়, তা পূরণ হয়ে যাবে একটি মাত্র পিলে।
এই খবর থেকে আমাদের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়। নতুন আশায় নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারি আমরা। আরেক খবরে তো বলাই হচ্ছে মানুষের আয়ু বেড়ে যাচ্ছে। 'আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু' এখন মানুষের হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে প্রায়। আসুক। ভাবনা কি? আমরা চাই আরো পরিবর্তন আসুক। 'ছোট'র জগতে আপাতত আমাদের চমকে দেওয়া খবর হচ্ছে ওই চশমা ও পিল। এখন এই চশমা ও পিল থেকে আমরা নতুন কিছু স্বপ্ন কি দেখতে পারি? চশমা নিয়েই আগে পড়া যাক। 'চলি্লশ পেরোলেই চালশে' সুমনের গানের এ কথা না হয় মেনেই নিলাম। কিন্তু এমন চশমা আসুক, যে চশমা পরলে ভালো ও মন্দের তফাতটা আমরা বুঝতে পারব সহজেই। এমন চশমা আসুক, যে চশমা পরলে ভালোকে ভালো, কালোকে কালো দেখা যাবে। আমরা আমজনতা এই চশমা পরে ঘুরব। ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাহীন, যাঁরা আমাদের নানাবিধ বিষয়ে উপদেশ দিতে একটুও কুণ্ঠিত হন না, তাঁদের উপদেশ কোনটা জাতির জন্য কতটুকু মঙ্গল বয়ে আনবে, সেটা আমরা ওই চশমা পরেই সম্যক উপলব্ধি করতে পারব। আর ছোট যে পিল এসেছে, তার পরিবর্তে যদি এমন পিল আসত যে সাত দিন না খেয়ে থাকার পুষ্টিহীনতা দূর হয়ে যেত চার আনার একটি পিলে, তাহলে বেশ মজাই হতো। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে আমাদের কিছু আসত-যেত না। কে তাকাত তখন চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ-তেলের দিকে। হাতের মুঠোয় একটা সিকি নিয়ে কোনোমতে দোকানে যেতে পারলেই তো হয়ে গেল। পিল হজম, সিকি খতম। এক সিকিতে সপ্তাহ পার করে আবার একটা কিনতে যেতাম। এক বড়িতেই খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেলতাম। ডিনার পার্টির বদলে পিল পার্টির আয়োজন করা হতো। এক ঢোক পানিতে একটা বড়ি সেবন করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে অতিথিরা ফিরতেন যাঁর যাঁর ঘরে। এভাবে যদি বদলে যেত আমাদের জীবন, বেশ হতো।
কিন্তু 'ওসব কী আর আছে মোদের ভাগ্যে!'
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments