জনজীবন-গর্বের অষ্টকথা by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
আমাদের দেশটি অন্য দেশগুলোর তুলনায় এগোতে পারছে না বলে আমরা হীনম্মন্যতায় ভুগি, এমনকি যে বিষয়গুলো নিয়ে গর্ববোধ করতে পারি, তা-ও অনেক সময় আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গুরুত্ব পায় না। এ রকম সংকোচের মধ্যে বাস করে সাফল্য অর্জন করা যায় না। আমাদের গর্ব করার মতো তো অনেক বিষয় রয়েছে, যা বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে, ছোট মানুষদের নিয়ে যারা বিত্তবৈভবশাসিত সমাজের দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যায়।
এ রকম কিছু খণ্ড খণ্ড কথা ও ঘটনাকে উপজীব্য করেই আজকের লেখা। এর প্রতিটি ঘটনাই আমার বুককে প্রসারিত করেছে, যা নিয়ে আমি নিজের মধ্যে গর্ব অনুভব করি।
আমি যখন আণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, তখন সাইয়ীদ নামের এক মেসেঞ্জারের সঙ্গে পরিচয় হয়। সুদর্শন, সদালাপী, মিতভাষী, বিনয়ী মানুষটির জন্য মেসেঞ্জারের চাকরিটা ছিল বড়ই বেমানান। উচ্চচাপ রোগে ভোগা মানুষটি কোনো কাজেই ‘না’ বলত না, শিক্ষিত লোকদের খুবই সম্মান করত। বাসায় খাওয়া-দাওয়ার বড় আয়োজনে আমরা তার সাহায্য নিতাম। তবে কোনোক্রমেই আমরা যাতে তার শ্রম ক্রয়ের চেষ্টায় সফল না হই, সে বিষয়ে সে খুবই সজাগ ছিল। ফলে কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চলে যেত। এ ছাড়া পতিত জমিতে সবজি চাষ করে আমাদের বাসায় দিয়ে যেত কোনো বিনিময়ের অপেক্ষা না করেই। তার কোনো কাজেই আন্তরিকতার অভাব দেখিনি। একদিন আমাদের মাত্রাতিরিক্ত ফরমায়েশ শুনতে গিয়ে উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে মারাই গেল আমাদের সবাইকে ঋণী রেখে, ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ না দিয়েই।
২. স্বামীর চিকিৎসা করাতে স্ত্রী আউলিয়া বেগম মানুষের কাছে হাত না পেতে ক্ষুদ্রঋণের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল এই মহিলার পক্ষে এই ঋণ পরিশোধ করার কোনো বিকল্প নেই, যদিও আমাদের দেশের ধনকুবেরেরা জনগণের সম্পদ, অর্থ নিজের ভেবে ইচ্ছামতো খরচ করে দেউলিয়া হওয়ার সার্টিফিকেট প্রদর্শন করে শুধু সুদ নয়, আসলটাও মওকুফ করিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হয়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরতে লজ্জা পায় না। কিন্তু আউলিয়া বেগম দরিদ্র হতে পারে, সুবিধাবঞ্চিত হতে পারে, মুমূর্ষু স্বামীর স্ত্রী হতে পারে, তাই বলে দু-দুটি কিডনি থাকতে ঋণগ্রস্ত থাকতে পারে না, যদিও একই রকম পরিস্থিতিতে সমাজের রাঘব বোয়ালেরা ঋণ পরিশোধে এমনকি তাদের সপ্তম বাড়িটি বিক্রয় করার চিন্তাও করতে পারবে না। যে দেশের সাধারণ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মান-সম্মানবোধ এত তীক্ষ, সে দেশের মানুষের মাথা নিচু করার কোনো কারণ নেই।
৩. আমার এক ছাত্র প্রাক-স্নাতক শ্রেণীতে আমার ছোটখাটো কোনো গবেষণায় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। পেপার তৈরির সব দায়িত্ব সে সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছে। তারপর পেপারটি যখন গৃহীত হলো, আমার এক সহকর্মী আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আমার কো-অথর গোলাম মোস্তফা কে। আমি তখন আমার প্রাক-স্নাতক ছাত্রের দিকে নির্দেশ করলাম। কিন্তু তখন জানলাম, তার নাম হলো মো. মোস্তফা আকবর। ছাত্রটিও জানত, সে এই পেপারের কো-অথর নয়, অন্য কেউ। ছাত্র হিসেবে এটা তার জন্য প্রশিক্ষণ মাত্র। অথচ গোটা পেপারটিই তার লেখা, যতটুকু অবদান তাতে আছে তার উল্লেখযোগ্য অংশ তারই প্রাপ্য। সবকিছু নিজে করলেও ভাবছে, নিশ্চয়ই বড় কেউ এই নামে আছে, যে হলো আসল মানুষ। কী অসাধারণ বিনয়, যা সম্ভবত কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব এবং যার জন্য আমরা সবাই গর্ববোধ করতে পারি।
৪. আমাদের ব্যাচের পুনর্মিলনীতে দুই বছর আগে মানিকগঞ্জে গিয়েছিলাম। আমার বইয়ের পোকা বন্ধু ড. আরিফুর রহমানের সঙ্গে এক বাসায় গেলাম। বাসাটি দেখতে খুবই সাধারণ কিন্তু ভেতরটি অসাধারণ, বইয়ে ঠাসা। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বই আর বই, হাঁটার পথে, শোবার ঘরে, খাবার ঘরে, বাসার ভেতরে পথে পথে, বাথরুমে যাওয়ার পথে। জায়গা ও আসবাবের অভাবে বইগুলো সংরক্ষণের জন্য অধিকতর গ্রহণযোগ্য সমাধান করা যাচ্ছে না সংগত আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। তবে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় থেকে নিজের দেহকে লুকাতে ব্যর্থ হলেও বই সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিকের অভাব হয়নি। অনেক বই আনতে প্রভিডেন্ট ফান্ড পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে। এমন মূল্যবান বই কিন্তু শুধু কেনা নয়, প্রতিটি বই কী প্রেক্ষাপটে লেখক লিখেছেন, তা-ও তার জানা, যা না জানলেও তার সরকারি চাকরি করতে কোনোই অসুবিধা হতো না। সম্ভবত চাকরি থেকে অবসরের সময়ও হয়ে এল মজিবর রহমানের। এত বই আর এত পড়া অন্তত একজন নিরীক্ষকের পার্থিব কোনো কাজে আসেনি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার পরও কেন এত পড়া আর কেন এত বই জোগানো। এ সম্ভবত কেবল বাংলাদেশের একজন মানুষের পক্ষেই এমন আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যেও সম্ভব!
৫. আমার অস্ট্রেলিয়া প্রবাস সময়ে বাংলাদেশ থেকে এক সরকারি চাকরিজীবী অ্যাডিলেড শহরে পড়তে গেলেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন উচ্চপদস্থ অস্ট্রেলীয় কর্মকর্তারা তাঁর বিস্ময়কর ভাষা-দক্ষতাকে সম্মান দেখাতে। এই ছাত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়সূচির পর বাকি সময়ের উল্লেখযোগ্য অংশ লাইব্রেরিতেই কাটাতেন এবং নিঃসন্দেহে এখনো কাটান। এমবিএ প্রোগ্রামের নানা বড় বড় রিপোর্ট লেখার জন্য এই বাংলাদেশের ছাত্রটিকেই গ্রুপের খোদ অস্ট্রেলিয়ান ছাত্ররা অধিকতর যোগ্য বলে মনে করতেন। সরকারি উচ্চ পদে কর্মরত হয়েও ব্রিটিশ কাউন্সিলসহ বইয়ের লোভনীয় সংরক্ষণাগার হলো তাঁর নিয়মিত গন্তব্য স্থান। অসাধারণ স্মৃতিধর এই মানুষটি এখনো পড়েই চলেছেন। যদিও পদোন্নতির জন্য কোনো পদ আর বাকি নেই। নানা দেশে পড়ার সুবাদে বহু মেধাবী ছাত্রের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের একসময়ের সচিব শাহ আলম সাহেবের মতো এমন জ্ঞানপিপাসু মানুষ আর দেখিনি। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শাহ আলমকে নিয়ে নিঃসন্দেহে আমরা গর্ববোধ করতে পারি।
৬. আমার পরিচিত একজন সজ্জন সম্পর্কে তাঁর পরিচিত কোনো জনই বলতে পারবে না কোনো মানুষের অপকার তাঁর মাধ্যমে হয়েছে। এ কিন্তু মোটেই সহজ নয়। সারা জীবনে শুধুই ভালো কাজ করেছেন। নিজের অর্জিত সামান্য অর্থও অকাতরে নিকটজনের জন্য ব্যয় করে জীবনসায়াহ্নে কোনোমতে চলছেন, তা-ও আবার হাসিমুখেই। নিজের ঢোল নিজে পেটানোর এই যুগে তাঁর পরিচিত আমরা অনেকেই স্মরণ করলাম জীবনে কখনো কোনো ভালো কাজ করেছেন এমন কথা তিনি উচ্চারণ করেননি। এ রকম চরিত্র সম্ভবত কেবল বাংলাদেশের মীর আবুল হোসেনরাই (জাবরাগ্রাম নিবাসী) হতে পারে।
৭. প্রবাদটি ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা কেউ বোঝে না’—এমনটি না হয়ে দাঁতের ব্যথা নিয়ে হলে মানানসই হতো। অন্তত আমার দাঁতের ব্যথার অল্প সময়ের অতি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাটি তাই বলে। এমনকি মাথাব্যথা হলে ডাক্তারের দ্বারস্থ না হলেও এক রাতের ব্যথায় সব কাজ ফাঁকি দিয়ে লালবাগের ঢাকা ডেন্টাল হোমে চলে গেলাম। স্বত্বাধিকারী ডা. মাহমুদুর রহমান সদা হাসিমুখ সদালাপী মানুষ। এই ক্লিনিক ভ্রমণ শুরু হয় একটি ছোট্ট মানুষের কাছে জুতা রাখা দিয়ে, রিসেপশনে হাসিমুখে একটি সিরিয়াল নম্বরের টোকেন দেওয়া হয়, ভেতরে দন্তচিকিৎসকেরা নিভৃতে আপনমনে একটি পরিবারের মতো কাজ করছে ঐক্যবদ্ধভাবে সহযোগিতায়, আনন্দে। আমার পরম সৌভাগ্য, পড়ে গেলাম এক তরুণ আত্মবিশ্বাসী ডাক্তারের হাতে, যিনি ছাত্রজীবনে গণিত অলিম্পিয়াড করেছেন। অলিম্পিয়াড করা সেই ছোট মানুষটি আমার দাঁতের চিকিৎসা করবে ভাবতেই বুক একবিঘত বেড়ে গেল, পড়ালেখার সহযোগী এই কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে জীবন থেকে তিনি হারিয়ে যাননি। খড়্গ করাত দিয়ে কত কিছুই যে আমার মুখগহ্বরে করলেন। আমি ভয় পেয়েছিলাম এত কাটাকাটি যখন চলছে, কখন না জানি কোনো ভুল হয়ে যায়। আমার ভয়কে মিথ্যা প্রমাণ করে ছোট ছোট বাচ্চা সহযোগীদের জোগালে আমার মুখগহ্বরে যে কর্মতৎপরতা চালালেন তাতে কখনো না পেলাম ব্যথা, না দেওয়া হলো খাওয়ার বিধিনিষেধ। রীতিমতো চমৎকার অভিজ্ঞতা।
৮. ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিসিআইটি সিরিজের প্রথম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। আমার খুবই আশা এর প্রসিডিংসগুলো যদি কোনোভাবে বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংরক্ষণ করা যেত। এক আমেরিকাগামী যাত্রীকে যথেষ্ট সংকোচে জিজ্ঞাসা করলাম, দু-এক কপি নেওয়া সম্ভব হবে কি না, যাঁর হ্যাঁ-সূচক উত্তরটি আমার ক্ষুদ্রতার জন্য নিশ্চয়তায় গ্রহণ করতে পারলাম না। তারপর অত্যন্ত ব্যস্ত এই যাত্রী যাত্রার প্রাক্কালে আমার বাসায় এসেছেন। যখন শুনলাম, তিনি প্রসিডিংসগুলো নিতে এসেছেন। আমি তো রীতিমতো অবাক। তারপর জিজ্ঞাসা করতে কয়টি দিতে পারি, উত্তর এল, যতগুলো খুশি। আমি তো হতবাক। এই ভারী বইয়ের যতগুলো খুশি তিনি বহন করতে রাজি আছেন! কারণ, এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি গড়ার প্রশ্ন রয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সেগুলো রেখেও এসেছেন। এই যাত্রী হলেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং এ রকম যাত্রী শুধু আমাদের দেশেই থাকতে পারে! আমরা অবশ্যই একটি গর্বিত জাতি।
ওপরের বেশির ভাগ ঘটনার মূল চরিত্র আমাদের দেশেরই সাধারণ মানুষ। তাদের এই অসাধারণত্বের বিষয়গুলোতে নিশ্চয়ই আমাদের মাটি, বায়ু, পানির একটি ভূমিকা আছে, যার ফলে গোটা এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার এসেছিল আমাদের মাটির সন্তান রবিঠাকুরের হাত ধরে, ভারতের শ্রেষ্ঠ দশজন বিজ্ঞানীর চারজনই হলো আমাদের মাটি থেকে। সুতরাং হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই। যে দেশ পৃথিবীর এক-সহস্রাংশ ভূখণ্ডে চব্বিশ সহস্রাংশ মানুষের অন্ন জোগায়, সে দেশে আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকা ঠিক নয়।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
আমি যখন আণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, তখন সাইয়ীদ নামের এক মেসেঞ্জারের সঙ্গে পরিচয় হয়। সুদর্শন, সদালাপী, মিতভাষী, বিনয়ী মানুষটির জন্য মেসেঞ্জারের চাকরিটা ছিল বড়ই বেমানান। উচ্চচাপ রোগে ভোগা মানুষটি কোনো কাজেই ‘না’ বলত না, শিক্ষিত লোকদের খুবই সম্মান করত। বাসায় খাওয়া-দাওয়ার বড় আয়োজনে আমরা তার সাহায্য নিতাম। তবে কোনোক্রমেই আমরা যাতে তার শ্রম ক্রয়ের চেষ্টায় সফল না হই, সে বিষয়ে সে খুবই সজাগ ছিল। ফলে কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চলে যেত। এ ছাড়া পতিত জমিতে সবজি চাষ করে আমাদের বাসায় দিয়ে যেত কোনো বিনিময়ের অপেক্ষা না করেই। তার কোনো কাজেই আন্তরিকতার অভাব দেখিনি। একদিন আমাদের মাত্রাতিরিক্ত ফরমায়েশ শুনতে গিয়ে উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে মারাই গেল আমাদের সবাইকে ঋণী রেখে, ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ না দিয়েই।
২. স্বামীর চিকিৎসা করাতে স্ত্রী আউলিয়া বেগম মানুষের কাছে হাত না পেতে ক্ষুদ্রঋণের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল এই মহিলার পক্ষে এই ঋণ পরিশোধ করার কোনো বিকল্প নেই, যদিও আমাদের দেশের ধনকুবেরেরা জনগণের সম্পদ, অর্থ নিজের ভেবে ইচ্ছামতো খরচ করে দেউলিয়া হওয়ার সার্টিফিকেট প্রদর্শন করে শুধু সুদ নয়, আসলটাও মওকুফ করিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হয়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরতে লজ্জা পায় না। কিন্তু আউলিয়া বেগম দরিদ্র হতে পারে, সুবিধাবঞ্চিত হতে পারে, মুমূর্ষু স্বামীর স্ত্রী হতে পারে, তাই বলে দু-দুটি কিডনি থাকতে ঋণগ্রস্ত থাকতে পারে না, যদিও একই রকম পরিস্থিতিতে সমাজের রাঘব বোয়ালেরা ঋণ পরিশোধে এমনকি তাদের সপ্তম বাড়িটি বিক্রয় করার চিন্তাও করতে পারবে না। যে দেশের সাধারণ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মান-সম্মানবোধ এত তীক্ষ, সে দেশের মানুষের মাথা নিচু করার কোনো কারণ নেই।
৩. আমার এক ছাত্র প্রাক-স্নাতক শ্রেণীতে আমার ছোটখাটো কোনো গবেষণায় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। পেপার তৈরির সব দায়িত্ব সে সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছে। তারপর পেপারটি যখন গৃহীত হলো, আমার এক সহকর্মী আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আমার কো-অথর গোলাম মোস্তফা কে। আমি তখন আমার প্রাক-স্নাতক ছাত্রের দিকে নির্দেশ করলাম। কিন্তু তখন জানলাম, তার নাম হলো মো. মোস্তফা আকবর। ছাত্রটিও জানত, সে এই পেপারের কো-অথর নয়, অন্য কেউ। ছাত্র হিসেবে এটা তার জন্য প্রশিক্ষণ মাত্র। অথচ গোটা পেপারটিই তার লেখা, যতটুকু অবদান তাতে আছে তার উল্লেখযোগ্য অংশ তারই প্রাপ্য। সবকিছু নিজে করলেও ভাবছে, নিশ্চয়ই বড় কেউ এই নামে আছে, যে হলো আসল মানুষ। কী অসাধারণ বিনয়, যা সম্ভবত কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব এবং যার জন্য আমরা সবাই গর্ববোধ করতে পারি।
৪. আমাদের ব্যাচের পুনর্মিলনীতে দুই বছর আগে মানিকগঞ্জে গিয়েছিলাম। আমার বইয়ের পোকা বন্ধু ড. আরিফুর রহমানের সঙ্গে এক বাসায় গেলাম। বাসাটি দেখতে খুবই সাধারণ কিন্তু ভেতরটি অসাধারণ, বইয়ে ঠাসা। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বই আর বই, হাঁটার পথে, শোবার ঘরে, খাবার ঘরে, বাসার ভেতরে পথে পথে, বাথরুমে যাওয়ার পথে। জায়গা ও আসবাবের অভাবে বইগুলো সংরক্ষণের জন্য অধিকতর গ্রহণযোগ্য সমাধান করা যাচ্ছে না সংগত আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। তবে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় থেকে নিজের দেহকে লুকাতে ব্যর্থ হলেও বই সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিকের অভাব হয়নি। অনেক বই আনতে প্রভিডেন্ট ফান্ড পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে। এমন মূল্যবান বই কিন্তু শুধু কেনা নয়, প্রতিটি বই কী প্রেক্ষাপটে লেখক লিখেছেন, তা-ও তার জানা, যা না জানলেও তার সরকারি চাকরি করতে কোনোই অসুবিধা হতো না। সম্ভবত চাকরি থেকে অবসরের সময়ও হয়ে এল মজিবর রহমানের। এত বই আর এত পড়া অন্তত একজন নিরীক্ষকের পার্থিব কোনো কাজে আসেনি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার পরও কেন এত পড়া আর কেন এত বই জোগানো। এ সম্ভবত কেবল বাংলাদেশের একজন মানুষের পক্ষেই এমন আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যেও সম্ভব!
৫. আমার অস্ট্রেলিয়া প্রবাস সময়ে বাংলাদেশ থেকে এক সরকারি চাকরিজীবী অ্যাডিলেড শহরে পড়তে গেলেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন উচ্চপদস্থ অস্ট্রেলীয় কর্মকর্তারা তাঁর বিস্ময়কর ভাষা-দক্ষতাকে সম্মান দেখাতে। এই ছাত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়সূচির পর বাকি সময়ের উল্লেখযোগ্য অংশ লাইব্রেরিতেই কাটাতেন এবং নিঃসন্দেহে এখনো কাটান। এমবিএ প্রোগ্রামের নানা বড় বড় রিপোর্ট লেখার জন্য এই বাংলাদেশের ছাত্রটিকেই গ্রুপের খোদ অস্ট্রেলিয়ান ছাত্ররা অধিকতর যোগ্য বলে মনে করতেন। সরকারি উচ্চ পদে কর্মরত হয়েও ব্রিটিশ কাউন্সিলসহ বইয়ের লোভনীয় সংরক্ষণাগার হলো তাঁর নিয়মিত গন্তব্য স্থান। অসাধারণ স্মৃতিধর এই মানুষটি এখনো পড়েই চলেছেন। যদিও পদোন্নতির জন্য কোনো পদ আর বাকি নেই। নানা দেশে পড়ার সুবাদে বহু মেধাবী ছাত্রের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের একসময়ের সচিব শাহ আলম সাহেবের মতো এমন জ্ঞানপিপাসু মানুষ আর দেখিনি। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শাহ আলমকে নিয়ে নিঃসন্দেহে আমরা গর্ববোধ করতে পারি।
৬. আমার পরিচিত একজন সজ্জন সম্পর্কে তাঁর পরিচিত কোনো জনই বলতে পারবে না কোনো মানুষের অপকার তাঁর মাধ্যমে হয়েছে। এ কিন্তু মোটেই সহজ নয়। সারা জীবনে শুধুই ভালো কাজ করেছেন। নিজের অর্জিত সামান্য অর্থও অকাতরে নিকটজনের জন্য ব্যয় করে জীবনসায়াহ্নে কোনোমতে চলছেন, তা-ও আবার হাসিমুখেই। নিজের ঢোল নিজে পেটানোর এই যুগে তাঁর পরিচিত আমরা অনেকেই স্মরণ করলাম জীবনে কখনো কোনো ভালো কাজ করেছেন এমন কথা তিনি উচ্চারণ করেননি। এ রকম চরিত্র সম্ভবত কেবল বাংলাদেশের মীর আবুল হোসেনরাই (জাবরাগ্রাম নিবাসী) হতে পারে।
৭. প্রবাদটি ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা কেউ বোঝে না’—এমনটি না হয়ে দাঁতের ব্যথা নিয়ে হলে মানানসই হতো। অন্তত আমার দাঁতের ব্যথার অল্প সময়ের অতি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাটি তাই বলে। এমনকি মাথাব্যথা হলে ডাক্তারের দ্বারস্থ না হলেও এক রাতের ব্যথায় সব কাজ ফাঁকি দিয়ে লালবাগের ঢাকা ডেন্টাল হোমে চলে গেলাম। স্বত্বাধিকারী ডা. মাহমুদুর রহমান সদা হাসিমুখ সদালাপী মানুষ। এই ক্লিনিক ভ্রমণ শুরু হয় একটি ছোট্ট মানুষের কাছে জুতা রাখা দিয়ে, রিসেপশনে হাসিমুখে একটি সিরিয়াল নম্বরের টোকেন দেওয়া হয়, ভেতরে দন্তচিকিৎসকেরা নিভৃতে আপনমনে একটি পরিবারের মতো কাজ করছে ঐক্যবদ্ধভাবে সহযোগিতায়, আনন্দে। আমার পরম সৌভাগ্য, পড়ে গেলাম এক তরুণ আত্মবিশ্বাসী ডাক্তারের হাতে, যিনি ছাত্রজীবনে গণিত অলিম্পিয়াড করেছেন। অলিম্পিয়াড করা সেই ছোট মানুষটি আমার দাঁতের চিকিৎসা করবে ভাবতেই বুক একবিঘত বেড়ে গেল, পড়ালেখার সহযোগী এই কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে জীবন থেকে তিনি হারিয়ে যাননি। খড়্গ করাত দিয়ে কত কিছুই যে আমার মুখগহ্বরে করলেন। আমি ভয় পেয়েছিলাম এত কাটাকাটি যখন চলছে, কখন না জানি কোনো ভুল হয়ে যায়। আমার ভয়কে মিথ্যা প্রমাণ করে ছোট ছোট বাচ্চা সহযোগীদের জোগালে আমার মুখগহ্বরে যে কর্মতৎপরতা চালালেন তাতে কখনো না পেলাম ব্যথা, না দেওয়া হলো খাওয়ার বিধিনিষেধ। রীতিমতো চমৎকার অভিজ্ঞতা।
৮. ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিসিআইটি সিরিজের প্রথম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। আমার খুবই আশা এর প্রসিডিংসগুলো যদি কোনোভাবে বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংরক্ষণ করা যেত। এক আমেরিকাগামী যাত্রীকে যথেষ্ট সংকোচে জিজ্ঞাসা করলাম, দু-এক কপি নেওয়া সম্ভব হবে কি না, যাঁর হ্যাঁ-সূচক উত্তরটি আমার ক্ষুদ্রতার জন্য নিশ্চয়তায় গ্রহণ করতে পারলাম না। তারপর অত্যন্ত ব্যস্ত এই যাত্রী যাত্রার প্রাক্কালে আমার বাসায় এসেছেন। যখন শুনলাম, তিনি প্রসিডিংসগুলো নিতে এসেছেন। আমি তো রীতিমতো অবাক। তারপর জিজ্ঞাসা করতে কয়টি দিতে পারি, উত্তর এল, যতগুলো খুশি। আমি তো হতবাক। এই ভারী বইয়ের যতগুলো খুশি তিনি বহন করতে রাজি আছেন! কারণ, এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি গড়ার প্রশ্ন রয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সেগুলো রেখেও এসেছেন। এই যাত্রী হলেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং এ রকম যাত্রী শুধু আমাদের দেশেই থাকতে পারে! আমরা অবশ্যই একটি গর্বিত জাতি।
ওপরের বেশির ভাগ ঘটনার মূল চরিত্র আমাদের দেশেরই সাধারণ মানুষ। তাদের এই অসাধারণত্বের বিষয়গুলোতে নিশ্চয়ই আমাদের মাটি, বায়ু, পানির একটি ভূমিকা আছে, যার ফলে গোটা এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার এসেছিল আমাদের মাটির সন্তান রবিঠাকুরের হাত ধরে, ভারতের শ্রেষ্ঠ দশজন বিজ্ঞানীর চারজনই হলো আমাদের মাটি থেকে। সুতরাং হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই। যে দেশ পৃথিবীর এক-সহস্রাংশ ভূখণ্ডে চব্বিশ সহস্রাংশ মানুষের অন্ন জোগায়, সে দেশে আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকা ঠিক নয়।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments