যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বিদ্যমান বাস্তবতা by ডা. এম এ হাসান
সংসদ ও রাজপথ একই সঙ্গে যেমন উত্তপ্ত যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে, তেমনি উত্তপ্ত শেয়ার মার্কেট লুণ্ঠন এবং জনদুর্ভোগ নিয়ে। প্রতিটি বিবেকবান মানুষ এ ইস্যুগুলোর প্রতি সরকারের যথাযথ মনোযোগ দাবি করে দেশের নানামুখী সমস্যার প্রতিকার চাইছে এবং প্রকৃতার্থে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধীগোষ্ঠীর বিচার চাইছে।
প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যাসংক্রান্ত অপরাধের বিচারের বিষয়টি সরকারের জন্য রাজনৈতিক বা নির্বাচিত কোনো ইস্যু নয়, জনগণের আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এ বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য একটি অবশ্য করণীয় বাধ্যবাধকতার বিষয়। যাঁরা এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটিকে একসময় মীমাংসিত বিষয়, তথা অপ্রয়োজনীয় অতীত বলে প্রচার করেছেন, তাঁরা এখন এটাকে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন।
আর এ কথাটি প্রমাণ করার জন্য নানা অশুভশক্তি রাষ্ট্রের মধ্যে এমন সব অভাবিত সমস্যা সৃষ্টি করছে, যা জনজীবনকে বিপন্ন এবং রাষ্ট্রকে অস্থির করে তুলছে। এর মধ্যে দ্রব্যমূল্য-সংক্রান্ত অস্থিরতা থেকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নানাবিধ সামাজিক অস্থিরতা, অনিয়ম, দুর্নীতি, অ্যানার্জি সংকট, কর্মসংকট, প্রবাসীদের চাকরিসংক্রান্ত সংকটসহ দেশের ইমেজসংকট অন্তর্ভুক্ত। ১৬ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে 'দি ডেইলি স্টার' পত্রিকায় প্রকাশিত �Reconciliation : Problem and Prospect� এবং �Crimes Against Humanity that was Never Addressed� শীর্ষক দুটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য দেশে একটি অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন।
এ পরিবেশ সৃষ্টিতে যারা বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, তারা যে কেউই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থেকে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিসহ নানা ধরনের স্যাবোটাজ, দুর্নীতি ও লুটপাটে সম্পৃক্ত হয়েছে তারা নিঃসন্দেহে অপরাধীদের পক্ষেই কাজ করছে। প্রধান বিরোধী দলসহ দেশি ও বিদেশি যে চক্র ঘাতকচক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে, যুদ্ধাপরাধ বিচারে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করছে, ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছে, তারা কেবল নৈতিকতার দৃষ্টিতেই ক্ষমাহীন অপরাধ করছে না, আইনের দৃষ্টিতেও বিচারযোগ্য অপরাধ করছে। এ কারণে তাদের বিচার না করতে পারাটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করতে পারার মতোই একটি বড় মাপের ব্যর্থতা। এ আলোকেই কান পেতে শুনতে হবে এবং অনুভবে আনতে হবে সরকারি দলের জনমত সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা এবং বর্তমান সংসদে জোট সদস্যদের বক্তব্যগুলো।
দেশের নানা সংকট দেখে পাঠককুলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই '৭২-পরবর্তী সরকারের নানা ভ্রান্তির প্রতি। সেই সরকার শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করে, নিকটজন কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে বা নিকটজনের প্রতি দুর্বল হয়ে আদর্শগত পরম মিত্রকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। এ কারণে দেশ যেমন আজকের মতো সংকটে নিমজ্জিত হয়েছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিয়ে ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছিল। পাকিস্তানের প্রতি দুর্বল ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান দিয়ে সরকার যেমন পাকিস্তানি হানাদার তথা যুদ্ধাপরাধীদের ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছিল, তেমনি আদর্শগত পরাজয়ের পথ উন্মুক্ত করেছিল।
বর্তমান সময়ে দেশ ও জাতি এমন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যা মহাঅর্থনৈতিক তথা সামাজিক অস্থিরতার অশনিসংকেত। এর মধ্যে নানা উৎসবের নামে জাতীয় অর্থ ও বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যয় নিরোর বংশীবাদনের তুল্য অপরাধ। জনগণের দুর্বলতা ব্যবহার করে এ অর্থনাশে উৎসাহ দিচ্ছে একটি লুটেরা শক্তি।
'৭২-এ যে শত্রুপক্ষ এবং লুটেরা গ্যাংম্যান ছেরু মিঞার ভূমিকায় নেমেছিল বা শহীদের হাড়হাড্ডি বিক্রি করে ধনাঢ্য হয়েছিল, তারাই আজ ভিন্নরূপে ক্ষমতার কাছে আসন পোক্ত করে নিয়েছে। যে অবাঙালিগোষ্ঠী_তথা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সেদিন কৌশলে কলকাঠি নাড়ছিল, তারাই আজ নররূপে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এসব কারণেই চলছে ব্যাপক মুদ্রা পাচার, বৈদেশিক মুদ্রাসংকট এবং শেয়ার কেলেঙ্কারি।
শেয়ার মার্কেট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে সাধারণের আত্মহনন বা ইতিপূর্বে যথাযথ নিয়ন্ত্রণের অভাবে চলাচলের পথে সাধারণের অপমৃত্যু জাতির আত্মাকে কেবল জরাজীর্ণই করেনি, চলার শক্তিকেও খর্ব করেছে। কোনোভাবেই মানা যায় না জীবনের এমন ক্ষয়_এসব অক্ষমতা, অব্যবস্থাপনা এবং ব্যর্থতা।
সরকার ব্যর্থ হয়েছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে। পদ্ধতিগত ত্রুটি, সঠিক ভিশনের অভাব এবং যথাযথ কৌশলের অভাবের জন্য বিচারকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বিরোধী পক্ষকে শক্তিশালী বা জনমনে স্থান করে দেওয়ার ক্ষেত্রটিও তৈরি করা হয়েছে এ প্রক্রিয়ায়। বিদেশে প্রচার-প্রচারণার ব্যর্থতাটি নেহায়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। সরকারের নানা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, উদ্যোগের অভাব এবং সামগ্রিক বুদ্ধির অভাব তো রয়েছেই।
বিচারের বিষয়টিকে শুরুতে হালকাভাবে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে দুর্বলভাবে সৃষ্ট হয়েছে আদালতের নানা অঙ্গ_বিশেষ করে প্রসিকিউশন। তাদের যথাযথ যোগ্যতা, মনোযোগ ও প্রস্তুতির অভাবের কারণেই আদালত এবং জাতি বারবার হোচট খাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এ বিভাগটি যেমন শক্তিশালী করা প্রয়োজন, তেমনি দ্রুত আদালতের সংখ্যা ১০ এবং তার অধিক করে সার্বিক বিচার কার্যক্রমকে বেগবান করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, মুখ্য অপরাধী ছিল পাকিস্তানি সেনারা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা না গেলে বিচারহীনতাই প্রতিষ্ঠা পাবে। এর মূল্য দেবে সারা পৃথিবীর মানুষ।
বিচারহীনতার কারণে '৭২-পরবর্তী সময়ে যা হয়েছে তা হলো_বিচারের প্রতি আস্থাহীনতা, অপরাধ কর্মগুলোর বৈধতাকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দিয়ে সমাজে সীমাহীন অপরাধ ও সন্ত্রাসের বিস্তার, অপরাধীদের মনোজগতে নেতিবাচক পরিবর্তন, Arrogance of power বা সহিংসতা বৃদ্ধি, অপরাধীরা ধর্মান্ধ রাজনীতিতে বিশ্বাসী হওয়ায় মৌলবাদের বিকাশ ঘটেছে, Victim কর্তৃক অপরাধীর অপরাধ নিজ চরিত্র শোষণ- (Theory of absorption of crime) এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে সমাজে ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা ও হীনস্বার্থপরতাসহ সমুদয় বর্বর কর্মকাণ্ডকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে। এ কারণে আর যা হয়েছে তা হলো_সামগ্রিকভাবে নারীর মর্যাদা এবং মানুষের মর্যাদার অবনমন, অন্যায়ের প্রতি সামগ্রিক সহনশীলতার উদ্ভব, আত্মগ্লানিতে নিমজ্জিত জাতির সম্মানবোধে ফাটল সৃষ্টি, পরাজিত মনোবৃত্তির উদ্ভব, আত্মপরিচয়ের সংকট, শান্তিসম্পর্কিত ধারণায় বিপত্তি, অন্যায় কাজে দ্বিধা সংকোচ লোপ, মূল্যবোধে আঘাত ও অবক্ষয়, জাতিসত্তা ও অহংকারে আঘাত, সামগ্রিকভাবে বিবেকের অবক্ষয়।
এ অশুভ বৃত্ত থেকে বেরোতে হলে কোথাও ছাড় দেওয়া চলবে না। এর মানে এই নয় যে বিচারের ক্ষেত্রে জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের মতো যারা দলীয় সিদ্ধান্তে সার্বিকভাবে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল তাদের বিচার কম গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি হত্যা, নির্যাতন এবং উল্লেখযোগ্য গণহত্যার বিচার হতে হবে মানুষের মর্যদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য, জাতির অহংকার, আত্মপরিচয় ও মূল্যবোধ পুনর্নির্মাণের জন্য। বিরোধী দলকেও অপরাধীর পক্ষ ত্যাগ করে মানবতার পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে কিংবা এ ব্যাপারে সরকারের ব্যর্থতায় আনন্দ প্রকাশ করে অপরাধীর পক্ষ নেওয়াও অপরাধ। বিচারের নানা দুর্বলতা বা বিচারের পক্ষে জনমত সৃষ্টির ব্যর্থতার দায় তাদেরকেও বইতে হবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। সে বড় নির্মম। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের নেতিবাচক অবস্থান সবার বিনাশ ডেকে আনবে। জাতির পরিচয়, সৃষ্টি ও অস্তিত্বের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : আহ্বায়ক, এয়ার ক্রাইমস ফাইন্ডিং ফ্যাক্টস কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক
আর এ কথাটি প্রমাণ করার জন্য নানা অশুভশক্তি রাষ্ট্রের মধ্যে এমন সব অভাবিত সমস্যা সৃষ্টি করছে, যা জনজীবনকে বিপন্ন এবং রাষ্ট্রকে অস্থির করে তুলছে। এর মধ্যে দ্রব্যমূল্য-সংক্রান্ত অস্থিরতা থেকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নানাবিধ সামাজিক অস্থিরতা, অনিয়ম, দুর্নীতি, অ্যানার্জি সংকট, কর্মসংকট, প্রবাসীদের চাকরিসংক্রান্ত সংকটসহ দেশের ইমেজসংকট অন্তর্ভুক্ত। ১৬ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে 'দি ডেইলি স্টার' পত্রিকায় প্রকাশিত �Reconciliation : Problem and Prospect� এবং �Crimes Against Humanity that was Never Addressed� শীর্ষক দুটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য দেশে একটি অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন।
এ পরিবেশ সৃষ্টিতে যারা বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, তারা যে কেউই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থেকে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিসহ নানা ধরনের স্যাবোটাজ, দুর্নীতি ও লুটপাটে সম্পৃক্ত হয়েছে তারা নিঃসন্দেহে অপরাধীদের পক্ষেই কাজ করছে। প্রধান বিরোধী দলসহ দেশি ও বিদেশি যে চক্র ঘাতকচক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে, যুদ্ধাপরাধ বিচারে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করছে, ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছে, তারা কেবল নৈতিকতার দৃষ্টিতেই ক্ষমাহীন অপরাধ করছে না, আইনের দৃষ্টিতেও বিচারযোগ্য অপরাধ করছে। এ কারণে তাদের বিচার না করতে পারাটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করতে পারার মতোই একটি বড় মাপের ব্যর্থতা। এ আলোকেই কান পেতে শুনতে হবে এবং অনুভবে আনতে হবে সরকারি দলের জনমত সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা এবং বর্তমান সংসদে জোট সদস্যদের বক্তব্যগুলো।
দেশের নানা সংকট দেখে পাঠককুলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই '৭২-পরবর্তী সরকারের নানা ভ্রান্তির প্রতি। সেই সরকার শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করে, নিকটজন কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে বা নিকটজনের প্রতি দুর্বল হয়ে আদর্শগত পরম মিত্রকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। এ কারণে দেশ যেমন আজকের মতো সংকটে নিমজ্জিত হয়েছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিয়ে ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছিল। পাকিস্তানের প্রতি দুর্বল ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান দিয়ে সরকার যেমন পাকিস্তানি হানাদার তথা যুদ্ধাপরাধীদের ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছিল, তেমনি আদর্শগত পরাজয়ের পথ উন্মুক্ত করেছিল।
বর্তমান সময়ে দেশ ও জাতি এমন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যা মহাঅর্থনৈতিক তথা সামাজিক অস্থিরতার অশনিসংকেত। এর মধ্যে নানা উৎসবের নামে জাতীয় অর্থ ও বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যয় নিরোর বংশীবাদনের তুল্য অপরাধ। জনগণের দুর্বলতা ব্যবহার করে এ অর্থনাশে উৎসাহ দিচ্ছে একটি লুটেরা শক্তি।
'৭২-এ যে শত্রুপক্ষ এবং লুটেরা গ্যাংম্যান ছেরু মিঞার ভূমিকায় নেমেছিল বা শহীদের হাড়হাড্ডি বিক্রি করে ধনাঢ্য হয়েছিল, তারাই আজ ভিন্নরূপে ক্ষমতার কাছে আসন পোক্ত করে নিয়েছে। যে অবাঙালিগোষ্ঠী_তথা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সেদিন কৌশলে কলকাঠি নাড়ছিল, তারাই আজ নররূপে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এসব কারণেই চলছে ব্যাপক মুদ্রা পাচার, বৈদেশিক মুদ্রাসংকট এবং শেয়ার কেলেঙ্কারি।
শেয়ার মার্কেট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে সাধারণের আত্মহনন বা ইতিপূর্বে যথাযথ নিয়ন্ত্রণের অভাবে চলাচলের পথে সাধারণের অপমৃত্যু জাতির আত্মাকে কেবল জরাজীর্ণই করেনি, চলার শক্তিকেও খর্ব করেছে। কোনোভাবেই মানা যায় না জীবনের এমন ক্ষয়_এসব অক্ষমতা, অব্যবস্থাপনা এবং ব্যর্থতা।
সরকার ব্যর্থ হয়েছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে। পদ্ধতিগত ত্রুটি, সঠিক ভিশনের অভাব এবং যথাযথ কৌশলের অভাবের জন্য বিচারকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বিরোধী পক্ষকে শক্তিশালী বা জনমনে স্থান করে দেওয়ার ক্ষেত্রটিও তৈরি করা হয়েছে এ প্রক্রিয়ায়। বিদেশে প্রচার-প্রচারণার ব্যর্থতাটি নেহায়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। সরকারের নানা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, উদ্যোগের অভাব এবং সামগ্রিক বুদ্ধির অভাব তো রয়েছেই।
বিচারের বিষয়টিকে শুরুতে হালকাভাবে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে দুর্বলভাবে সৃষ্ট হয়েছে আদালতের নানা অঙ্গ_বিশেষ করে প্রসিকিউশন। তাদের যথাযথ যোগ্যতা, মনোযোগ ও প্রস্তুতির অভাবের কারণেই আদালত এবং জাতি বারবার হোচট খাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এ বিভাগটি যেমন শক্তিশালী করা প্রয়োজন, তেমনি দ্রুত আদালতের সংখ্যা ১০ এবং তার অধিক করে সার্বিক বিচার কার্যক্রমকে বেগবান করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, মুখ্য অপরাধী ছিল পাকিস্তানি সেনারা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা না গেলে বিচারহীনতাই প্রতিষ্ঠা পাবে। এর মূল্য দেবে সারা পৃথিবীর মানুষ।
বিচারহীনতার কারণে '৭২-পরবর্তী সময়ে যা হয়েছে তা হলো_বিচারের প্রতি আস্থাহীনতা, অপরাধ কর্মগুলোর বৈধতাকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দিয়ে সমাজে সীমাহীন অপরাধ ও সন্ত্রাসের বিস্তার, অপরাধীদের মনোজগতে নেতিবাচক পরিবর্তন, Arrogance of power বা সহিংসতা বৃদ্ধি, অপরাধীরা ধর্মান্ধ রাজনীতিতে বিশ্বাসী হওয়ায় মৌলবাদের বিকাশ ঘটেছে, Victim কর্তৃক অপরাধীর অপরাধ নিজ চরিত্র শোষণ- (Theory of absorption of crime) এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে সমাজে ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা ও হীনস্বার্থপরতাসহ সমুদয় বর্বর কর্মকাণ্ডকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে। এ কারণে আর যা হয়েছে তা হলো_সামগ্রিকভাবে নারীর মর্যাদা এবং মানুষের মর্যাদার অবনমন, অন্যায়ের প্রতি সামগ্রিক সহনশীলতার উদ্ভব, আত্মগ্লানিতে নিমজ্জিত জাতির সম্মানবোধে ফাটল সৃষ্টি, পরাজিত মনোবৃত্তির উদ্ভব, আত্মপরিচয়ের সংকট, শান্তিসম্পর্কিত ধারণায় বিপত্তি, অন্যায় কাজে দ্বিধা সংকোচ লোপ, মূল্যবোধে আঘাত ও অবক্ষয়, জাতিসত্তা ও অহংকারে আঘাত, সামগ্রিকভাবে বিবেকের অবক্ষয়।
এ অশুভ বৃত্ত থেকে বেরোতে হলে কোথাও ছাড় দেওয়া চলবে না। এর মানে এই নয় যে বিচারের ক্ষেত্রে জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের মতো যারা দলীয় সিদ্ধান্তে সার্বিকভাবে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল তাদের বিচার কম গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি হত্যা, নির্যাতন এবং উল্লেখযোগ্য গণহত্যার বিচার হতে হবে মানুষের মর্যদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য, জাতির অহংকার, আত্মপরিচয় ও মূল্যবোধ পুনর্নির্মাণের জন্য। বিরোধী দলকেও অপরাধীর পক্ষ ত্যাগ করে মানবতার পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে কিংবা এ ব্যাপারে সরকারের ব্যর্থতায় আনন্দ প্রকাশ করে অপরাধীর পক্ষ নেওয়াও অপরাধ। বিচারের নানা দুর্বলতা বা বিচারের পক্ষে জনমত সৃষ্টির ব্যর্থতার দায় তাদেরকেও বইতে হবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। সে বড় নির্মম। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের নেতিবাচক অবস্থান সবার বিনাশ ডেকে আনবে। জাতির পরিচয়, সৃষ্টি ও অস্তিত্বের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : আহ্বায়ক, এয়ার ক্রাইমস ফাইন্ডিং ফ্যাক্টস কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক
No comments