যুক্তি তর্ক গল্প-উন্নয়নের পথে বাধা কোথায়? by আবুল মোমেন
এশিয়ার যেসব দেশ অনেক পেছন থেকে এসে আমাদের ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে, সেসব দেশের কোনো কোনোটিতে আগেও গিয়েছি, এবার থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে টানা ১০ দিন থেকে এসে আবারও কয়েকটি কথা মনে হচ্ছে। এবার দুটি পৃথক কারণে বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল ও ব্যাংকক হাসপাতালে অনেকটা সময় দিতে হয়েছে। দুটি হাসপাতালই বিশাল, বহু বিভাগ নিয়ে ব্যস্ত প্রতিষ্ঠান আর রোগী ও চিকিৎসার মানের দিক থেকে আন্তর্জাতিক।
দুটি হাসপাতালের ক্রেতা-সেবার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত মধ্য ও নিম্ন-মধ্যস্তরের ৯০ শতাংশ কর্মী, সেবিকা ও চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট সহযোগী কর্মীদের ৯০ শতাংশই নারী। চিকিৎসকসহ সব কর্মীর ইংরেজি-জ্ঞান অতি সামান্য। বিমানবন্দরের কর্মী, বিপণিকেন্দ্রের বিক্রেতা, ট্যাক্সিচালক, গণপরিবহনের কন্ডাক্টর—সবাই অতি সামান্য ইংরেজি-জ্ঞান নিয়ে কাজ চালাচ্ছেন।
থাইল্যান্ডে কিছুকাল আগেই বড় ধরনের রাজনৈতিক টানাপোড়েন গেছে। নানা ক্ষেত্রে সফল হলেও দুর্নীতির দায়ে একজন প্রধানমন্ত্রীকে পদ হারাতে হয়, এমনকি দেশত্যাগী হতে হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেই দেশত্যাগী ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা সম্পর্কে সেখানকার বিদ্বজ্জনের ধারণা তেমন ভালো নয়। দ্য নেশন ও ব্যাংকক পোস্ট পড়ে মনে হয়, গণমাধ্যমও তার সরকারের দক্ষতা নিয়ে সন্দিগ্ধ।
পারিবারিক বন্ধু-দম্পতির কাছ থেকে তাঁদের প্রায় ১৬ বছর ব্যাংককে বাসের অভিজ্ঞতা থেকেও জানতে পারি, রাজনৈতিক সংকট সত্ত্বেও সে দেশে অর্থনৈতিক বা সামাজিক জীবনে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়নি। এবার থাইল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণারত কিছু বাংলাদেশি ছাত্রের সঙ্গেও দেখা ও কথাবার্তা হয়েছে। তারা সেখানকার সমাজ ও তরুণদের সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথাবার্তা বলল। সব মিলিয়ে দেশটির প্রধানত একটি ইতিবাচক চিত্রই পাওয়া যায়, যদিও নেতিবাচক দিক যে কিছু নেই, তা নয়।
থাইল্যান্ড থেকে জাপান পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশের ইতিহাস পড়ে ও বাস্তবতা দেখে বোঝা যায়, ইংরেজি-জ্ঞান কোনো দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত নয়। এমনকি জাপানের গণতন্ত্রের নাজুক অবস্থা, বিশেষত, ঘন ঘন সরকারের পতন ও পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রাখলে বলতে হয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সঙ্গেও উন্নয়ন সরাসরি সম্পর্কিত নয়। একজন বাঙালি অধ্যাপক বললেন, থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক আন্দোলন ও পরিবর্তন ঘটলেও তাতে দেশে বিরাজমান ও চলমান পদ্ধতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আসে না। এমনকি ‘লাল শার্ট আন্দোলন’ যখন তুঙ্গে, তা যখন সরকার পতন ও পরিবর্তনের দাবিতে জঙ্গি রূপ নিচ্ছিল, তখনো আন্দোলন সীমিত ছিল ব্যাংকক শহরের, ধরা যাক, দুই বর্গকিলোমিটারের মধ্যে। অন্যত্র ব্যবসা-বাণিজ্য, বাজার-হাট, অফিস-আদালতসহ কাজকর্ম ও জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক।
জাপান কিংবা থাইল্যান্ডে দুর্নীতি নেই, এমন কথা বলা যাবে না। বরং জাপানে বারবার প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও বিভিন্ন মন্ত্রী এবং থাইল্যান্ডে থাকসিনসহ একাধিক মন্ত্রীর বড় ধরনের দুর্নীতির খবর আমরা জানি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে না।
তাহলে আমাদের সমস্যাটা কী? বা আমাদের সঙ্গে পার্থক্য কোথায় ওদের? ওরা পারলে—বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিধর জাপানকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার কথাই যদি ধরি—আমরা কেন পারব না, কেন পারছি না?
যেকোনো উন্নয়ন, বস্তুগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে যা আরও সত্য, প্রয়োজন মেধা, শ্রম ও ধারাবাহিকতার সমন্বয়। সম্ভবত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, প্রতিভা হচ্ছে ২০ শতাংশ মেধা ও ৮০ শতাংশ শ্রমের সমন্বয়। বাঙালির মেধা সম্পর্কে আমার মনে কোনো সংশয় নেই, বিভিন্ন বিষয়ে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার স্বাক্ষর আমরা রেখেছি। সাধারণ কৃষক-শ্রমিক যে দারুণ পরিশ্রমী, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকার কারণ নেই। আমাদের সাধারণ মানুষ সরল ও সৎ। এবার সত্যিই মেলানো কঠিন—যদি এতসব সদ্গুণ বাঙালির থাকে, তাহলে কেন সে ঠেকে আছে, ঠেকে থাকছে?
আমার বিবেচনায় এর পেছনে মূল কারণ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব ও জের। বিষয়টা হয়তো একটু ব্যাখ্যা করে বলা প্রয়োজন। ইংরেজরা ঔপনিবেশিক শাসন চালানোর জন্যই এ দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন করেছিল, যার অনেক সুফলের কথা আমরা জানি। এ-ও আমরা জানি যে ইংরেজের লক্ষ্য ছিল—
১. প্রশাসনে তাদের সহযোগী একটি আমলাতন্ত্র ও কেরানিতন্ত্র তৈরি করা এবং ২. সমাজে ইংরেজি জানা তাদের অনুসারী ও অনুগ্রহভাজন একটি ‘অভিজাত’ শ্রেণী তৈরি করা। এই শিক্ষার মাধ্যমে দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ও স্বাধীনতা-সংগ্রামী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, এ কথাও সত্যি। কিন্তু এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর বাইরে ঠিকই ইংরেজের অভীপ্সিত একটি শিক্ষিত শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা কেবল শাসকের অনুগত হয়নি, যাদের মধ্যে পরাধীনতার মানসিকতা মজ্জাগত হয়ে পড়েছে। এই ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও কর্ম-সংস্কৃতি বাঙালিমানসে পরাধীনতা, পরনির্ভরতা, আজ্ঞাবাহী মনোভাব, পরশ্রীকাতরতা এবং ফাঁকিবাজি মানসিকতার বীজ গভীরভাবে বপন করেছে। এই মূলত চাকুরে ও পেশাজীবী শিক্ষিত নাগরিক শ্রেণীই পরবর্তী ২০০ বছরে বৃহত্তর বাঙালি সমাজমানসকে প্রভাবিত করেছে। আজ অবধি আমাদের শিক্ষা ও প্রশাসন এই ঔপনিবেশিক প্রথারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে।
আমরা দু-দুবার স্বাধীন হলাম বটে, রীতিমতো মুক্তিযুদ্ধ করে অসীম বীরত্ব ও অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করে দেশ স্বাধীন করলাম বটে, এমনকি বিপুল সংগ্রাম করে স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্র কায়েম করলাম বটে, কিন্তু সেই পরাধীনতার ও সেই ঔপনিবেশিকতার মানসশৃঙ্খল ও সংস্কৃতির বেড়ি কিছুতেই ভাঙতে পারলাম না। বরং দীর্ঘকাল এই পরাধীন ঔপনিবেশিক মানসিকতার শৃঙ্খল বহন করে এত দিনে আমাদের চরিত্রে আরও নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য সংযোজিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মারাত্মক হলো অবিশ্বাসের সংস্কৃতি। কেউ কাউকে আমরা বিশ্বাস করি না, নিজেকেও না। আমরা যেন বিশ্বাস করতে জানি না, পারি না। আমরা সংবিধান ও আইন তৈরি করি, কিন্তু সেগুলো মানি না। কারণ, সেগুলো যে মানার জন্য তৈরি হয়, তা বিশ্বাস করি না। আমরা সর্বক্ষেত্রে অনর্গল আদর্শ ও নীতির বুলি কপচাই, কিন্তু একইভাবে সেগুলো মানি না। কারণ, সেগুলো যে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করার ও আচরণে প্রকাশ করার দায় আছে, তা বিশ্বাস করি না। এভাবে এই ফিরিস্তি আরও দীর্ঘ করা যাবে।
দেখা যাচ্ছে, নানা বিষয়ে আমাদের ভাবাবেগ বেশ জোরালো। ভাবাবেগ এমন এক প্রবৃত্তি, যার ধর্ম আকস্মিক বন্যার মতো, যখন আসে তখন ভাসিয়ে নেয়। কিন্তু স্থায়িত্ব থাকে না, গভীরতাও থাকে না। আমাদের দেশপ্রেম, মানবতাবোধসহ অন্যান্য অঙ্গীকার এ ধরনের ভাবাবেগমাত্র। বিভিন্ন সময় আমাদের সমাজে ভাবের জোয়ার এসেছে, সে একেবারে শ্রীচৈতন্যের গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন থেকে আজকের দিনের যুদ্ধাপরাধীর বিচার পর্যন্ত একই রকম। ভাবের জোয়ারে কিছু কিছু কাজ হয়ে যায়, কিন্তু কাজটা যদি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মতো দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা-নির্ভর হয়, যদি পুরোনোকে বাতিল বা বদল করে সংস্কারের মতো দূরদর্শিতা ও দক্ষতা-ধৈর্যের ওপর নির্ভর করে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মতো প্রধানত চিন্তাপ্রসূত ও ধৈর্যশীল, মেধা, শ্রম ও ধারাবাহিকতার সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল কাজ হয় এবং যার ফলাফল হবে অনিশ্চিত কিংবা দূর ভবিষ্যতের বিষয়, তাহলে আমরা অস্থির হয়ে পড়ি এবং দলাদলিতে লিপ্ত হয়ে কাজের উদ্দেশ্য ও পরিণতি সম্পর্কে সংশয় ও বিতর্ক সৃষ্টি করি। শেষ পর্যন্ত কাজের চেয়ে তর্ক ও বিবাদই মুখ্য হয়ে ওঠে।
আমাদের সমাজে সাধারণত প্রতিটি দপ্তরে, প্রতিটি দলে, প্রতিটি পরিবারে একজন করে একনায়কের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর আদেশ-নির্দেশ পালনই অন্যদের কাজ। অধীনেরা তাঁকে ভয় পায়, তাঁর প্রতি অন্তরে ঘৃণা ও অবজ্ঞা পোষণ করে, নিজের কাজটুকু অনীহা ও অনাস্থার সঙ্গে বাধ্য হয়ে সম্পাদন করে। লক্ষ্যহীন, মর্যাদাহীন জীবনে চাকরির ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে বেতন-ভাতা, ছুটিছাটাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা—দায়িত্ব-কর্তব্য ও কাজ সম্পর্কে সাধারণত কোনো আগ্রহ থাকে না। রাজনৈতিক দলেও একক নেতৃত্বের কাছে অসহায় ও অধীন থেকে অন্যদের মধ্যে অনাস্থা, অস্থিরতা ক্ষোভ তৈরি হয়।
এভাবে প্রতিটি অফিসে, দলে, পরিবারে দলাদলি, পরশ্রীকাতরতা ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতির প্রভাবে কোন্দল কিংবা অচলাবস্থা বিরাজমান। আর তাই মৌলিক চিন্তা, নতুন ভাবনা, সংস্কার ও নবায়ন এ সমাজে দুঃসাধ্য।
থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে আমাদের তুলনায় মেধা, বিদ্যা, সৃষ্টিশীলতায় পিছিয়ে থেকেও তারা যে ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে, তার কারণ ঔপনিবেশিক মানসশৃঙ্খল থেকে তারা মুক্ত। আমাদের সমাজে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ব্যতীত রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো অর্থহীন। মানুষকে ঔপনিবেশিক মানসশৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা না গেলে গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং মানুষের মর্যাদাসহ প্রকৃত স্বাধীনতা বাস্তবে অধরাই থেকে যাবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
থাইল্যান্ডে কিছুকাল আগেই বড় ধরনের রাজনৈতিক টানাপোড়েন গেছে। নানা ক্ষেত্রে সফল হলেও দুর্নীতির দায়ে একজন প্রধানমন্ত্রীকে পদ হারাতে হয়, এমনকি দেশত্যাগী হতে হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেই দেশত্যাগী ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা সম্পর্কে সেখানকার বিদ্বজ্জনের ধারণা তেমন ভালো নয়। দ্য নেশন ও ব্যাংকক পোস্ট পড়ে মনে হয়, গণমাধ্যমও তার সরকারের দক্ষতা নিয়ে সন্দিগ্ধ।
পারিবারিক বন্ধু-দম্পতির কাছ থেকে তাঁদের প্রায় ১৬ বছর ব্যাংককে বাসের অভিজ্ঞতা থেকেও জানতে পারি, রাজনৈতিক সংকট সত্ত্বেও সে দেশে অর্থনৈতিক বা সামাজিক জীবনে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়নি। এবার থাইল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণারত কিছু বাংলাদেশি ছাত্রের সঙ্গেও দেখা ও কথাবার্তা হয়েছে। তারা সেখানকার সমাজ ও তরুণদের সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথাবার্তা বলল। সব মিলিয়ে দেশটির প্রধানত একটি ইতিবাচক চিত্রই পাওয়া যায়, যদিও নেতিবাচক দিক যে কিছু নেই, তা নয়।
থাইল্যান্ড থেকে জাপান পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশের ইতিহাস পড়ে ও বাস্তবতা দেখে বোঝা যায়, ইংরেজি-জ্ঞান কোনো দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত নয়। এমনকি জাপানের গণতন্ত্রের নাজুক অবস্থা, বিশেষত, ঘন ঘন সরকারের পতন ও পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রাখলে বলতে হয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সঙ্গেও উন্নয়ন সরাসরি সম্পর্কিত নয়। একজন বাঙালি অধ্যাপক বললেন, থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক আন্দোলন ও পরিবর্তন ঘটলেও তাতে দেশে বিরাজমান ও চলমান পদ্ধতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আসে না। এমনকি ‘লাল শার্ট আন্দোলন’ যখন তুঙ্গে, তা যখন সরকার পতন ও পরিবর্তনের দাবিতে জঙ্গি রূপ নিচ্ছিল, তখনো আন্দোলন সীমিত ছিল ব্যাংকক শহরের, ধরা যাক, দুই বর্গকিলোমিটারের মধ্যে। অন্যত্র ব্যবসা-বাণিজ্য, বাজার-হাট, অফিস-আদালতসহ কাজকর্ম ও জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক।
জাপান কিংবা থাইল্যান্ডে দুর্নীতি নেই, এমন কথা বলা যাবে না। বরং জাপানে বারবার প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও বিভিন্ন মন্ত্রী এবং থাইল্যান্ডে থাকসিনসহ একাধিক মন্ত্রীর বড় ধরনের দুর্নীতির খবর আমরা জানি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে না।
তাহলে আমাদের সমস্যাটা কী? বা আমাদের সঙ্গে পার্থক্য কোথায় ওদের? ওরা পারলে—বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিধর জাপানকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার কথাই যদি ধরি—আমরা কেন পারব না, কেন পারছি না?
যেকোনো উন্নয়ন, বস্তুগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে যা আরও সত্য, প্রয়োজন মেধা, শ্রম ও ধারাবাহিকতার সমন্বয়। সম্ভবত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, প্রতিভা হচ্ছে ২০ শতাংশ মেধা ও ৮০ শতাংশ শ্রমের সমন্বয়। বাঙালির মেধা সম্পর্কে আমার মনে কোনো সংশয় নেই, বিভিন্ন বিষয়ে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার স্বাক্ষর আমরা রেখেছি। সাধারণ কৃষক-শ্রমিক যে দারুণ পরিশ্রমী, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকার কারণ নেই। আমাদের সাধারণ মানুষ সরল ও সৎ। এবার সত্যিই মেলানো কঠিন—যদি এতসব সদ্গুণ বাঙালির থাকে, তাহলে কেন সে ঠেকে আছে, ঠেকে থাকছে?
আমার বিবেচনায় এর পেছনে মূল কারণ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব ও জের। বিষয়টা হয়তো একটু ব্যাখ্যা করে বলা প্রয়োজন। ইংরেজরা ঔপনিবেশিক শাসন চালানোর জন্যই এ দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন করেছিল, যার অনেক সুফলের কথা আমরা জানি। এ-ও আমরা জানি যে ইংরেজের লক্ষ্য ছিল—
১. প্রশাসনে তাদের সহযোগী একটি আমলাতন্ত্র ও কেরানিতন্ত্র তৈরি করা এবং ২. সমাজে ইংরেজি জানা তাদের অনুসারী ও অনুগ্রহভাজন একটি ‘অভিজাত’ শ্রেণী তৈরি করা। এই শিক্ষার মাধ্যমে দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ও স্বাধীনতা-সংগ্রামী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, এ কথাও সত্যি। কিন্তু এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর বাইরে ঠিকই ইংরেজের অভীপ্সিত একটি শিক্ষিত শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা কেবল শাসকের অনুগত হয়নি, যাদের মধ্যে পরাধীনতার মানসিকতা মজ্জাগত হয়ে পড়েছে। এই ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও কর্ম-সংস্কৃতি বাঙালিমানসে পরাধীনতা, পরনির্ভরতা, আজ্ঞাবাহী মনোভাব, পরশ্রীকাতরতা এবং ফাঁকিবাজি মানসিকতার বীজ গভীরভাবে বপন করেছে। এই মূলত চাকুরে ও পেশাজীবী শিক্ষিত নাগরিক শ্রেণীই পরবর্তী ২০০ বছরে বৃহত্তর বাঙালি সমাজমানসকে প্রভাবিত করেছে। আজ অবধি আমাদের শিক্ষা ও প্রশাসন এই ঔপনিবেশিক প্রথারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে।
আমরা দু-দুবার স্বাধীন হলাম বটে, রীতিমতো মুক্তিযুদ্ধ করে অসীম বীরত্ব ও অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করে দেশ স্বাধীন করলাম বটে, এমনকি বিপুল সংগ্রাম করে স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্র কায়েম করলাম বটে, কিন্তু সেই পরাধীনতার ও সেই ঔপনিবেশিকতার মানসশৃঙ্খল ও সংস্কৃতির বেড়ি কিছুতেই ভাঙতে পারলাম না। বরং দীর্ঘকাল এই পরাধীন ঔপনিবেশিক মানসিকতার শৃঙ্খল বহন করে এত দিনে আমাদের চরিত্রে আরও নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য সংযোজিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মারাত্মক হলো অবিশ্বাসের সংস্কৃতি। কেউ কাউকে আমরা বিশ্বাস করি না, নিজেকেও না। আমরা যেন বিশ্বাস করতে জানি না, পারি না। আমরা সংবিধান ও আইন তৈরি করি, কিন্তু সেগুলো মানি না। কারণ, সেগুলো যে মানার জন্য তৈরি হয়, তা বিশ্বাস করি না। আমরা সর্বক্ষেত্রে অনর্গল আদর্শ ও নীতির বুলি কপচাই, কিন্তু একইভাবে সেগুলো মানি না। কারণ, সেগুলো যে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করার ও আচরণে প্রকাশ করার দায় আছে, তা বিশ্বাস করি না। এভাবে এই ফিরিস্তি আরও দীর্ঘ করা যাবে।
দেখা যাচ্ছে, নানা বিষয়ে আমাদের ভাবাবেগ বেশ জোরালো। ভাবাবেগ এমন এক প্রবৃত্তি, যার ধর্ম আকস্মিক বন্যার মতো, যখন আসে তখন ভাসিয়ে নেয়। কিন্তু স্থায়িত্ব থাকে না, গভীরতাও থাকে না। আমাদের দেশপ্রেম, মানবতাবোধসহ অন্যান্য অঙ্গীকার এ ধরনের ভাবাবেগমাত্র। বিভিন্ন সময় আমাদের সমাজে ভাবের জোয়ার এসেছে, সে একেবারে শ্রীচৈতন্যের গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন থেকে আজকের দিনের যুদ্ধাপরাধীর বিচার পর্যন্ত একই রকম। ভাবের জোয়ারে কিছু কিছু কাজ হয়ে যায়, কিন্তু কাজটা যদি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মতো দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা-নির্ভর হয়, যদি পুরোনোকে বাতিল বা বদল করে সংস্কারের মতো দূরদর্শিতা ও দক্ষতা-ধৈর্যের ওপর নির্ভর করে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মতো প্রধানত চিন্তাপ্রসূত ও ধৈর্যশীল, মেধা, শ্রম ও ধারাবাহিকতার সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল কাজ হয় এবং যার ফলাফল হবে অনিশ্চিত কিংবা দূর ভবিষ্যতের বিষয়, তাহলে আমরা অস্থির হয়ে পড়ি এবং দলাদলিতে লিপ্ত হয়ে কাজের উদ্দেশ্য ও পরিণতি সম্পর্কে সংশয় ও বিতর্ক সৃষ্টি করি। শেষ পর্যন্ত কাজের চেয়ে তর্ক ও বিবাদই মুখ্য হয়ে ওঠে।
আমাদের সমাজে সাধারণত প্রতিটি দপ্তরে, প্রতিটি দলে, প্রতিটি পরিবারে একজন করে একনায়কের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর আদেশ-নির্দেশ পালনই অন্যদের কাজ। অধীনেরা তাঁকে ভয় পায়, তাঁর প্রতি অন্তরে ঘৃণা ও অবজ্ঞা পোষণ করে, নিজের কাজটুকু অনীহা ও অনাস্থার সঙ্গে বাধ্য হয়ে সম্পাদন করে। লক্ষ্যহীন, মর্যাদাহীন জীবনে চাকরির ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে বেতন-ভাতা, ছুটিছাটাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা—দায়িত্ব-কর্তব্য ও কাজ সম্পর্কে সাধারণত কোনো আগ্রহ থাকে না। রাজনৈতিক দলেও একক নেতৃত্বের কাছে অসহায় ও অধীন থেকে অন্যদের মধ্যে অনাস্থা, অস্থিরতা ক্ষোভ তৈরি হয়।
এভাবে প্রতিটি অফিসে, দলে, পরিবারে দলাদলি, পরশ্রীকাতরতা ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতির প্রভাবে কোন্দল কিংবা অচলাবস্থা বিরাজমান। আর তাই মৌলিক চিন্তা, নতুন ভাবনা, সংস্কার ও নবায়ন এ সমাজে দুঃসাধ্য।
থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে আমাদের তুলনায় মেধা, বিদ্যা, সৃষ্টিশীলতায় পিছিয়ে থেকেও তারা যে ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে, তার কারণ ঔপনিবেশিক মানসশৃঙ্খল থেকে তারা মুক্ত। আমাদের সমাজে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ব্যতীত রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো অর্থহীন। মানুষকে ঔপনিবেশিক মানসশৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা না গেলে গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং মানুষের মর্যাদাসহ প্রকৃত স্বাধীনতা বাস্তবে অধরাই থেকে যাবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments