বোধ ও বোধের উদ্বোধন-গ্রন্থমেলা by আবুল হাসানাত

বাংলা একাডেমী কেন বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক? এ জন্য যে, রাষ্ট্রের যে আদর্শ ও স্বপ্ন এবং জাতির যে পরিচয় বাঙালি (রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশি) তার সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে কম-বেশি সার্থক হয়েছে বাংলা একাডেম
বাংলা একাডেমীর নতুন স্লোগান, স্লোগান না বলে 'ÔmottoÕ বলা উচিত (আচরণের নির্দেশনা বা নিয়ম হিসেবে ক্ষুদ্র বাক্য বা বাক্যাংশ, মূলমন্ত্র_ বাংলা একাডেমী ইংলিশ-বেঙ্গলি ডিকশনারি), হচ্ছে 'বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের


প্রতীক'_ আগের মটো ছিল 'জাতির মননের প্রতীক'। দুটোই উৎকৃষ্ট, যথাযথ, যৌক্তিক এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত। মহাপরিচালক হারুন-উর-রশিদকে এ জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছি। এখন বন্ধু সহকর্মী, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে ধন্যবাদ জানাই।
বাংলা একাডেমী যাত্রা শুরু করে ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে। আজ ২০১২ সাল। তাই ৫৭ বছর একটি প্রতিষ্ঠানের জন্যও, মানব জীবনের মতো, যথেষ্ট সুস্থ, সাবলীল এবং কর্ম উদ্যোগী। যদিও ৫৭ বছরে আমাদের অবসরে যেতে হয়েছে। বিবেচক প্রধানমন্ত্রী সংবেদী শেখ হাসিনা আরও দু'বছর বাড়িয়ে দিয়ে একটি যথোপযুক্ত ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি কৃতজ্ঞতার দাবিদার। যা হোক, বাংলা একাডেমীর সঙ্গে আমরা যারা জড়িত চাকরি সূত্রে এবং যারা জড়িত লেখক-প্রকাশক-বিক্রেতা-পাঠক-দর্শক হিসেবে তারা এবং সামগ্রিকভাবে জাতি, বাংলা একাডেমী ভালোবাসে, মায়ের মতো, প্রিয়ার মতো, বন্ধুর মতো। ফলে বাংলা একাডেমীর কাছে সবার প্রত্যাশা। এ প্রত্যাশা কখনও গভীর বিস্তৃত-ব্যাপক ও সীমাহীন। সব সময় বাংলা একাডেমী সবার প্রত্যাশা, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও দাবি পূরণ করতে পারেনি; সম্ভব নয়; যদিও বলা হয়ে থাকে, Impossible is a word which is found in the dictionary of fools; ; কিন্তু নেপোলিয়ন যা বলতে পারেন, বাস্তবায়ন করতে সক্ষম, আমরা কি তা পারি? না পারলে চেষ্টা করা অপরিহার্য। সে কাজটি বাংলা একাডেমী করে আসছে। মহাপরিষদের (সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়), নেতৃত্বে নীতিগুলো বাস্তবায়নে উৎসর্গীকৃত কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মাধ্যমে। যারা যত 'Visionary (স্বপ্ন নয়, কল্পনাপ্রসূত বা. এ. অভিধান) এবং স্বাপি্নক, বাস্তববাদী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী তারা তত সাফল্য এনে দিয়েছে বাংলা একাডেমীকে এবং কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। বলা বাহুল্য, ড. মযহারুল ইসলাম থেকে শামসুজ্জামান পর্যন্ত প্রফেসর আশরাফ সিদ্দিকী একমাত্র ব্যর্থ মহাপরিচালক (স্যার, মাফ করবেন, রাজশাহী কলেজে ১৯৫১-৫৩ সালে সাহিত্যের পাঠ নিয়েছি আপনার কাছ থেকে)। ব্যর্থতার কারণগুলো 'স্যার' বিধায় বলতে চাই না; তা সৌজন্য, বিনয়, ভদ্রতা, শালীনতার বিরোধী। প্রফেসর ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম মহাপরিচালক এক বছর। কিন্তু তিনি যে গতিশীল নেতৃত্বে যে কার্যপ্রণালি, সাধন পদ্ধতি (modus over and Bangla Academy English-Bangali Dictionary) শুরু হয়েছিল তার দ্রুত পরিবর্তনে একটা গৌরবময় বলিষ্ঠ সম্ভাবনার দ্বার বন্ধ করে দেওয়া হলো। আজীবন আমি এ চরম ভুল ও নির্বোধ সিদ্ধান্তকে দুয়ো দেব। যাক, এবার মূল বক্তব্যে যাই। বাংলা একাডেমী কেন বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক? এ জন্য যে, রাষ্ট্রের যে আদর্শ ও স্বপ্ন এবং জাতির যে পরিচয় বাঙালি (রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশি) তার সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে কম-বেশি সার্থক হয়েছে বাংলা একাডেমী। আমরা যদি তাদের বিপুল বই-পাহাড় ও পুস্তক তালিকার দিকে দৃষ্টি দিই তাহলে বুঝতে না পারার কোনো কারণ নেই। বোধ ও বোধের উদ্বোধনে, চিন্তা-চেতনার প্রকাশে, বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি-পরম্পরার স্থির প্রত্যয়ে বাংলা একাডেমী অভ্রংলিহ মর্যাদা ও সম্মানে প্রতিষ্ঠিত ও অধিষ্ঠিত। কী বই প্রণয়ন ও প্রকাশ করেনি একাডেমী? অভিধান, কোষ, রচনাপঞ্জি, ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা বিষয়ক বই, জীবন ও সাহিত্যকর্ম, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক বই, নজরুল বিষয়ক বই, বিবিধ প্রবন্ধ সংকলন, সাহিত্য গবেষণা ও সমালোচনা, গল্প-উপন্যাস ও গল্প-উপন্যাস প্রসঙ্গ, কবিতা ও কবিতা প্রসঙ্গ, নাটক ও নাটক প্রসঙ্গ, শিশু-কিশোর সাহিত্য ও আনন্দ পঠন, একুশের প্রবন্ধ ও স্মারকগ্রন্থ সংকলন, মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ, প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য, ফোকলোর, ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সঙ্গীত, সমাজবিজ্ঞান, সমাজকল্যাণ, নৃ-বিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও লোকপ্রশাসন, দর্শন ও মনোবিদ্যা, অর্থনীতি, বাণিজ্য ও ব্যবস্থাপনা, আইন, শিক্ষা ও সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্র ও চিত্রকলা, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান, কীটতত্ত্ব, প্রাণিবিদ্যা, আণবিক জীববিজ্ঞান, অণুজীববিদ্যা, মাৎস্যবিজ্ঞান ও সমুদ্রবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, উদ্ভিদ রোগবিজ্ঞান, কাঠবিজ্ঞান, ভেষজ বিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান ও উদ্যানতত্ত্ব, মৃত্তিকাবিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞান, হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ওষুধ বিজ্ঞান, পশুপালন ও পশু চিকিৎসা বিদ্যা, গণিত ও পরিসংখ্যান, পদার্থবিদ্যা, ফলিত পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিদ্যা, ভূগোল, ভূতত্ত্ববিদ্যা, প্রকৌশল ও কারিগরি বিদ্যা, সাধারণ বিজ্ঞান, ভাষাশহীদ গ্রন্থশালা ও জীবনী গ্রন্থশালা। অসাধারণ, অভাবনীয়, অচিন্তনীয়, অশ্রুতপূর্ব এবং অতুলনীয়। আমি আবেদন করি বাংলাদেশের তরুণ সমাজ, যুবক সম্প্রদায়কে গভীরভাবে ভালোবাসায় (বাংলা একাডেমীর প্রতি) এবং বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিসত্তা ও মননের বিকাশে তারা যেন বই পড়েন, সাধারণের বই, সব প্রকাশকের বই এবং বিশেষ করে বাংলা একাডেমীর বই। অন্যান্য প্রকাশনার, সহজ ভাষায় বই পড়ার ক্ষেত্রে বই নির্বাচনে বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা ও সতর্কতার আশ্রয়ী হবেন। উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমীর বইমেলা সর্বজনীন রূপ নিয়েছে। এ রূপের ঐতিহ্য ও মর্যাদা বাংলা একাডেমী বহন ও ধারণ করতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস। তবুও বলব, বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ কেন বইয়ের মেলা এ স্থানে রাখতে চায়? আমি জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের স্কন্ধে চাপাতে চাই; এটি তার কাজ। বাংলা একাডেমীর কাজ বই বেচা, কেনা নয়। নিরঙ্কুশভাবে প্রকাশক ও কতিপয় লেখকের স্বার্থে বইমেলার আয়োজন_ বিপুল সময়, অর্থ, পরিশ্রম করে এবং বাংলা একাডেমীর মূল কাজের অন্তত ৫ মাস ক্ষতি সাধন করে_ ঔচিত্যের, বিবেচনার, সঙ্গত কারণের বিরোধী। তবু যদি বিশেষ কারণে বইমেলার দায়িত্ব বাংলা একাডেমী তার স্কন্ধে নিতে আগ্রহী হয়, তাহলে অবশ্যই পরমাণু শক্তি কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কিছু স্থান বাংলা একাডেমীর বইমেলার বিশাল ও আধুনিক আয়োজনের জন্য বরাদ্দ করা হোক। মাভৈঃ_ ভয় নেই।

আবুল হাসানাত : সাবেক পরিচালক বাংলা একাডেমী

No comments

Powered by Blogger.