দূরদেশ-নাশিদের ক্ষমতাচ্যুতিতে কারা লাভবান হবে? by আলী রীয়াজ
মালদ্বীপে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে ২০০৮ সালে সূচিত যাত্রা গত সপ্তাহে এসে বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। সেনা ও পুলিশ বিদ্রোহের মুখে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। মালদ্বীপে অভ্যুত্থানচেষ্টা মোটেই নতুন কিছু নয়। ১৯৮০, ১৯৮৩ ও ১৯৮৮ সালেও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মামুন আবদুল গাইয়ুমকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা হয়েছিল।
১৯৮৮ সালের অভ্যুত্থান দমন করতে ভারতীয় ছত্রীসেনারা রাজধানী মালেতে অভিযান চালায়। এসব অভ্যুত্থান কোনোটাই সফল হয়নি। কিন্তু এবারের অভ্যুত্থান অতীতের যেকোনো চেষ্টা থেকেই ভিন্ন। শুধু এই কারণে নয় যে এটা সফল হয়েছে; এই কারণেও নয় যে এই প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুটো কারণের গুরুত্ব খাটো না করেও বলা যায়, এবারের অভ্যুত্থানের পেছনে কেবল ব্যক্তির ক্ষমতাগ্রহণের আকাঙ্ক্ষাই কাজ করেনি, দেশকে একটি পথে পরিচালনার ইঙ্গিতও বহন করছে।
এই অভ্যুত্থানের কারণ হিসেবে প্রধান গণমাধ্যমগুলোতে যা বলা হয়েছে তার অন্যতম হলো, প্রেসিডেন্ট নাশিদ দেশের ফৌজদারি আদালতের প্রধান আবদুল্লাহ মোহাম্মদকে আটক করেছিলেন। আবদুল্লাহ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজনৈতিক পক্ষপাত ও দুর্নীতির। বিচারপতি মোহাম্মদকে আটকের জন্য নাশিদ দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। এ নিয়ে বিক্ষোভের পরিণতিই হলো প্রেসিডেন্ট নাশিদের অপসারণ। কিন্তু আবদুল্লাহ মোহাম্মদের আটকের প্রশ্নটি কারণ না অজুহাত, এই প্রশ্ন তোলা অসংগত হবে না।
প্রেসিডেন্ট নাশিদের সঙ্গে বিচার বিভাগের, বিশেষ করে আবদুল্লাহ মোহাম্মদের বিরোধ হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। সম্পর্কের টানাপোড়েন চূড়ান্ত রূপ নেয় যখন দেশের সংবিধানের আওতায় প্রতিষ্ঠিত জুডিশিয়াল সার্ভিসেস কমিশনের বিরুদ্ধে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ দেওয়ানি মামলা করেন। ২০০৮ সালের সংবিধানে কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিচারকদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করার। কিন্তু কমিশনের সদস্যদের বক্তব্য অনুযায়ী, সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা আবদুল্লাহ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে গত বছরগুলোতে তদন্ত করতে পারছেন না। ২০০৯ সালে বিচারক মোহাম্মদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে যে কমিটি করা হয়, তা ২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত ৪৪ বার বৈঠক করেছে; কিন্তু একটি প্রতিবেদনও তৈরি করতে পারেনি। কমিশনের অন্যতম সদস্য আইশাথ ভেলিজিনি গত বছরের মার্চ মাসে পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে লেখা এক খোলা চিঠিতে বলেন, বিরোধী দলের প্রভাব বিস্তার ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্ত বিচারকদের বাধার মুখে বিচারক মোহাম্মদের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। ভেলিজিনি দুবার দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন এবং শেষাবধি কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। পার্লামেন্টের স্পিকার ও বিরোধী দলের নেতা ২০১০ সালে আইনি ফাঁক গলিয়ে এমন ব্যবস্থা পাস করিয়ে নেন যে ২০২৬ সাল পর্যন্ত ফৌজদারি আদালত থেকে আবদুল্লাহ মোহাম্মদকে সরানো যাবে না। প্রেসিডেন্ট নাশিদ ও তাঁর দলের সদস্যরা ছাড়াও মালদ্বীপের অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিই বলতে থাকেন, গোটা বিচারব্যবস্থাই প্রধান বিচারপতি আবদুল্লাহ মোহাম্মদের করতলগত হয়ে পড়েছে। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে এ যাবৎ অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরই প্রেক্ষাপটে জানুয়ারির মাঝামাঝি আবদুল্লাহ মোহাম্মদকে আটকের জন্য সেনাবাহিনীর সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়। ফলে সাদা চোখে প্রেসিডেন্ট নাশিদ তাঁর ক্ষমতা বাড়াতে বিচারপতিকে আটক করেছিলেন বা ক্রমেই অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠছিলেন বলে মনে হলেও সেটা পুরো চিত্র তুলে ধরে না। মালদ্বীপের আদালতে গত সরকারের নিয়োগ পাওয়া এসব বিচারক পক্ষপাতিত্ব করছেন, সাবেক শাসক গাইয়ুম ও তাঁর ভাইয়ের দল দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন—এমন অভিযোগের প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট আরও কৌশলী হলেই ভালো করতেন। পার্লামেন্ট ও বিচার বিভাগ প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর দলকে এই পদক্ষেপে বাধ্য করেছে এটা সত্য, কিন্তু প্রেসিডেন্টের অনভিজ্ঞতা ও সাবেক ক্ষমতাসীনদের শক্তির বিষয়ে ধারণা না থাকাটাও তার ভুল পদক্ষেপের কারণ।
প্রেসিডেন্ট নাশিদের বিরুদ্ধে কিছুদিন ধরে আরেকটি গোষ্ঠী শক্তি সঞ্চয় করেছে। তারা হলো দেশের ইসলামপন্থীরা। মালদ্বীপের প্রায় ১০০ শতাংশ মুসলমান। ওই দেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম এবং ইসলাম ধর্মবিরোধী কোনো আইন প্রয়োগ করা যাবে না; তা সত্ত্বেও মালদ্বীপের নাগরিকেরা ধর্মকে রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেননি। মালদ্বীপে ইসলাম সেখানকার প্রচলিত রীতিনীতির সঙ্গে মিলে একধরনের উদার রূপ নিয়েছে। কিন্তু গত বছরগুলোতে কট্টর ইসলামপন্থীরা দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। দেশের অন্যতম ইসলামপন্থী দল ‘আদালত’ গত নির্বাচনে এক শতাংশের কম ভোট পেয়েছিল; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নাশিদ তাদের একজন প্রতিনিধিকে ধর্মমন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন। সেই সুযোগে গত বছরগুলোতে সংগঠনটি যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে। তদুপরি দেশের আরেকটি ছোট দল দিভেহি কওমি পার্টি (ডিকিউপি) (গত নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোট ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, আসন সংখ্যা ২) ক্রমেই কট্টরপন্থী অবস্থান নিয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, সার্ক সম্মেলনের সময় মালেতে ভাস্কর্য তৈরি, দেশের প্রধান কোরআন শিশু শিক্ষালয়ের সংস্কার ইত্যাদিকে তাঁরা ইসলামবিরোধী কাজ বলে বর্ণনা করে। প্রেসিডেন্ট নাশিদ মালদ্বীপ থেকে ইসলাম তুলে দিতে চাইছেন বলে তাঁরা প্রচার করতে শুরু করেন। ২০১০ সালে ভারতীয় ইসলাম প্রচারক জাকির নায়েককে মালদ্বীপে যাওয়ার অনুমতি দিতে সরকারের অনীহাকে তাঁরা এর প্রমাণ বলে হাজির করেন। এই কট্টর ইসলামপন্থীরা প্রেসিডেন্ট নাশিদের ওপর এই কারণেও ক্ষুব্ধ হয় যে তিনিই প্রথম স্বীকার করেন যে, মালদ্বীপের নাগরিকেরা পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানে ইসলামপন্থীদের হয়ে লড়াই করছেন। এই পটভূমিকায় গত ডিসেম্বরে আদালত পার্টির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় ‘ইসলাম রক্ষা’র জন্য সমাবেশ। তাদের সঙ্গে বিরোধী দল ডিআরপি, গাইয়ুমের ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন প্রগেসিভ পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল যোগ দেয়।
প্রেসিডেন্টের দল এমডিপি পাল্টা সমাবেশ করে এই বলে যে, তারা সহিষ্ণু, প্রচলিত ইসলামের পথে আছে এবং থাকবে। এই সমাবেশ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, স্বল্প জনসমর্থন রয়েছে এমন ইসলামপন্থীরা প্রধান বিরোধী দলের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে ইসলাম রক্ষার নামে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট নাশিদের ক্ষমতাচ্যুতি তার ধারাবাহিকতা কি না, বলা মুশকিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নাশিদের ক্ষমতাচ্যুতিতে তারা যে লাভবান হবে, সেটা বুঝতে কারোরই কষ্ট হয় না। মালদ্বীপ কি এই গোষ্ঠীর কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে? বুঝতে হলে ঘটনাবলির ওপর ভালোভাবে নজর রাখা দরকার।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভারসিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments