ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : বাংলা ভাষার একনিষ্ঠ সেবক by শান্তা মারিয়া

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ_নামটি উচ্চারণ করলেই মনে পড়ে যায় একটি অমোঘ বাণী_'মাতা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের পরম শ্রদ্ধার বস্তু।' অথবা মনে পড়ে বাঙালির অস্তিত্বের সেই শাশ্বত উচ্চারণ_'আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।


মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকার জো-টি নেই।' হ্যাঁ, এই কথা তিনি বলেছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ১৯৪৯ সালে। অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বছর পরই দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা ঘোষণা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জয়গান গেয়েছিলেন তিনি। অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাঁর সমগ্র জীবন ও সাধনা সম্পর্কে অবহিত হলে বরং মনে হয়, এটিই তাঁর কাছে একান্ত প্রত্যাশিত। সেই ১৯২৮ সালেই কি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেননি? 'হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাঙালি জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতেই হোক না কেন, তা তো করিতেই হইবে। বাঙালি হিন্দু বাঙালি মুসলমান ব্যতীত চলিতে পারিবে না। বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দু ব্যতীত চলিতে পারিবে না। চিরকাল কি একভাবে যাইবে? জগতের ইতিহাসপৃষ্ঠে কি হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি ফরাসি, ইংরেজ, ইতালিয়ান, জার্মান, জাপানি প্রমুখ জাতির ন্যায় নাম রাখিতে পারিবে না? আশা কানে কানে গুঞ্জন করিয়া বলে_পারিবে।' (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মিলনীর দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ, ১৯২৮)। ১৯২৮ সালে যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে সারা ভারতে, যে সময় মনে করা হচ্ছে, মুসলমান ও হিন্দু দুটি পৃথক জাতি। যে সময় ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে চালানো হচ্ছে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রচারণা, সে সময় বাঙালি মনীষী শহীদুল্লাহ বলছেন হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি গঠনের কথা। সে সময় তিনি ভাবছেন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতির উন্নয়নের কথা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছিল মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জ্ঞান সাধনার মূল ক্ষেত্র। তিনি চিরকাল বাংলা ও বাঙালির জয়গান গেয়েছেন। সেই ১৯২০ সালেই তিনি ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে বাংলার দাবি তুলে ধরেছিলেন। ১৯২০ সালে শান্তিনিকেতনে ভারতের সাধারণ ভাষা নিয়ে সভা ডাকা হলো। সভায় সভাপতিত্ব করলেন উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সভায় 'ভারতের সাধারণ সভা' নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করলেন শহীদুল্লাহ। প্রবন্ধে তিনি ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে উত্থাপন করলেন বাংলার কথা। বললেন, 'সাহিত্য শক্তির দিক দিয়া বিচার করিলে ভারতের একটি মাত্র ভাষা সাধারণ ভাষার দাবি করিতে পারি তাহা বাঙ্গালা ভাষা।' না এ দাবি তিনি ছাড়েননি কখনো। এমনকি পাকিস্তান যখন ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলো, তখনো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তিনি দৃঢ়ভাবে দাবি জানালেন বাংলার পক্ষে। তত দিনে ভাষাতাত্তি্বক পণ্ডিত হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতে। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ যখন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালেন, তখন কড়া জবাব দেন শহীদুল্লাহ। একের পর এক প্রবন্ধ লেখেন বাংলার পক্ষে। ভাষাতাত্তি্বক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেন যুক্তির পর যুক্তি। ১৯৪৮ থেকে '৫২_এই কয় বছরে অসংখ্য সভা-সমাবেশ আর লেখায় বাংলা ভাষার দাবিতে যুক্তির পর যুক্তি দিয়েছেন শহীদুল্লাহ। আর '৫২-র ভাষা আন্দোলনে তো প্রত্যক্ষভাবেই অংশ নিয়েছেন তিনি, পালন করেছেন চিন্তাবিদের ভূমিকাও। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সারা জীবন ছিলেন বাংলা ভাষার একনিষ্ঠ সেবক। তিনি গবেষণা করেছেন চর্যাপদ নিয়ে। ফরাসি দার্শনিক ভল্টেয়ারের মতো তিনিও ছিলেন বাঙালির স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্নদ্রষ্টা। মা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ছিল এই জ্ঞানতাপসের পরম আরাধ্য। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাই বাঙালির আপন চেতনায় চিরভাস্বর।
শান্তা মারিয়া

No comments

Powered by Blogger.