বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক-পানি থেকে কতটুকু জলের তফাত? by মহিউদ্দিন আহমদ
অনেক বছর আগে আমি একটা পদ্য লিখেছিলাম। বিষয়বস্তু ছিল হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া। পদ্যটি এ রকম— ‘পানি থেকে কতটুকু জলের তফাৎ ইতোমধ্যে দুইবার ভেঙ্গে গেছে দেশ। নদীতে দেয়াল ওঠে শুকায় গড়াই’ হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া বেশ পুরোনো। একসময় ঝগড়াটা এমন পর্যায়ে গেল যে, তারা আর একসঙ্গে থাকতে পারল না।
দেশ দুই ভাগ হলো। ঝগড়া চলল। মুসলমানের দেশটার দুই অংশে আবার ঝগড়া শুরু হলো। আবার ভাগাভাগি। আমরা এই ঝগড়ার ওপর রাজনৈতিক লেবাস চড়ালাম। জাতীয়তাবাদ, জাতি-রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, অধিকার ইত্যাদি। আমাদের একটা আলাদা দেশ হলো। কিন্তু ঝগড়া থামল না। প্রকাশ্যে আমরা যতই সভ্যভব্য বলে জাহির করি না কেন, অবচেতনে রয়ে গেছে সেই সনাতন হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া। সম্প্রতি তিস্তা নিয়ে তুলকালাম হলো। এমন কথাও শুনতে হলো, হিন্দুরা আমাদের পানি দেবে না। ‘মুসলমানের দেশ’ বাংলাদেশে এমন কথা নতুন নয়। আর ‘হিন্দুর দেশ’ ভারতে এ কথা প্রায়ই বলা হয়, ‘মুসলমানেরা বেইমান।’ এই পানিযুদ্ধ চলছে, চলবে।
আমাদের দেশে যে পরিমাণ পানি বিভিন্ন নদীনালা দিয়ে প্রবাহিত হয়, তার প্রায় ৯২ শতাংশ আসে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এই তিনটি নদীর মাধ্যমে। বর্ষা মৌসুমে, বিশেষ করে জুন থেকে অক্টোবর মাসে যে পরিমাণ পানি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তা যদি আটকে রাখা যেত, তাহলে বাংলাদেশ ১০ মিটার পানির নিচে থাকত। এত পানি পৃথিবীতে শুধু আরেকটি নদী দিয়েই প্রবাহিত হয়। তা হলো দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন। কিন্তু পানি তো ধরে রাখা যায় না। অনেকটা চলে যায় সাগরে। এবং যাওয়ার রাস্তা একটাই, চাঁদপুরের কোল ঘেঁষে মেঘনা দিয়ে। শুকনো মৌসুমে চিত্রটা ভিন্ন। পানি আসে কম। অনেক শাখানদী শুকিয়ে যায়। তৈরি হয় নানা রকম সমস্যা।
যেকোনো সম্পদ যদি সীমিত হয়, তার ভাগাভাগি নিয়ে সমস্যা তৈরি হতেই পারে। সমতার ভিত্তিতে যদি ভাগ-বাটোয়ারা হয়, তাহলে সবাইকে অল্পস্বল্প নিয়ে তুষ্ট থাকতে হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা পানি সমস্যার একটা সুরাহা করার চেষ্টা করি না কেন?
আমরা অনেক দিন যাবৎ শুনে আসছি, আমাদের ‘বেসিন অ্যাপ্রোচ’-এ যাওয়া দরকার। অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনা হতে হবে অববাহিকাভিত্তিক। বিষয়টি খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা একটি বিশাল এলাকা। নদীর জন্ম মানুষের জন্মের আগে। দেশ তো হয়েছে আরও অনেক পরে। এখন নদীর মালিকানা দাবি করে বসেছে অববাহিকাভুক্ত দেশগুলো। কেমন করে হবে এর সমাধান?
এই তিনটি নদীর অববাহিকার মোট অঞ্চলের ৭ শতাংশ পড়েছে বাংলাদেশের ভেতর, ৪ শতাংশ নেপালে, ২ শতাংশ ভুটানে। ১০-১২ শতাংশ চীনে এবং বাকিটা ভারতে। এই নদীগুলোর পানি নানাভাবে ব্যবহার করে আসছে এই অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ, হাজার হাজার বছর ধরে। এখন পানি ব্যবহারের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। তাই চাহিদার তুলনায় জোগানে ঘাটতি পড়ছে।
এখন শুধু জলপান, গৃহস্থালি কাজ আর চাষবাসে পানির ব্যবহার সীমাবদ্ধ নয়। বিজলি বানাতে পানি লাগে, কলকারখানায় পানি দরকার হয়, আধুনিক কৃষিব্যবস্থায় সেচের জন্য পানি লাগে প্রচুর। নগরায়ণ বেড়ে যাওয়ার ফলে পানির জোগান দিতে হিমশিম খেতে হয় পুরসভাগুলোকে। মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে মানুষের চাহিদা। নদীর ক্ষমতা বাড়ছে না, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে পড়ে ক্রমহ্রাসমান হচ্ছে জলের ধারা।
একটি নদীর অববাহিকায় বসবাসকারী প্রতিটি মানুষেরই অধিকার আছে ওই নদীর পানি ব্যবহারের। আবার নদীকে রক্ষা করার দায়িত্বও সবার। এখানে ভাবতে হবে মানুষের কথা, বাঁচাতে হবে নদী।
আমাদের জানা আছে, দেশমাত্রই মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। মানুষের চেয়ে দেশ বড়, বড়াই করে এ কথা তাঁরাই বলেন, যাঁরা দেশের কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করেন। মানুষের কথা ভাবলে, তার প্রয়োজনকে আমলে নিলে তো দেশে দেশে ঝগড়া হওয়ার কথা নয়। তার পরও ঝগড়া চলে। যেমন বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে চলছে চার দশক ধরে। এই ঝগড়ার এক অমোঘ অনুপান হলো পানির জাতীয়তাবাদী ব্যবহার, যা প্রয়োগ করা হচ্ছে দুই দেশের ভোটের রাজনীতিতে। দেশ বিক্রি, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি—এসব নষ্ট পঙিক্তমালা উচ্চারিত হচ্ছে রাজনীতিবিদদের মুখে মুখে।
পানির জোগান কমে গেলে তা মোকাবিলা করার সবচেয়ে সহজ রাস্তা হলো পানি ব্যবহারের অগ্রাধিকার নির্ণয় করা এবং অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয় বা কম দরকারি চাহিদাগুলোকে বাদ দিয়ে জীবনধারণের জন্য যা কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ, তার দিকে নজর দেওয়া। প্রথমেই হিসাব করা দরকার, আমাদের পানীয় জলের প্রয়োজন কতটুকু। তারপর আসে চাষবাস। আমাদের ভেবে দেখতে হবে, একবার টয়লেট ফ্লাশ করার জন্য আমরা চার লিটার পানি ব্যবহার করব, নাকি ওই চার লিটার পানীয় জলের চাহিদা মেটানোর জন্য সরবরাহ করব।
আমরা এক এক করে সবগুলো নদীর পানিপ্রবাহের পরিমাণ এবং ওই নদীর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগত দিকটি হিসাব করে আলোচনার টেবিলে বসে ঝগড়া মিটমাট করতে পারি। একবার ভাগাভাগি হয়ে গেলে একটি দেশ তার পরিধির মধ্যে ওই পানি কীভাবে ব্যবহার করবে, সেটা সেই দেশ ঠিক করে নেবে। ধরা যাক, আমরা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পাব তিস্তা থেকে। তো সেই পানি আমরা কতটুকু দেব কুড়িগ্রামের কৃষককে, কতটুকু দেব লালমনিরহাটের কৃষককে আর কতটুকু রাখব রংপুর শহরের নাগরিকদের টয়লেট ফ্লাশ করার জন্য, সেই পরিকল্পনা আমাদেরই করতে হবে।
আমরা অনেকেই পানি বণ্টন নিয়ে আবেগতাড়িত হই এবং রাজনীতি করি। আমরা এটা স্বীকার করতে চাই না যে, পর্যাপ্ত পানি পেলেও সব মানুষের তাতে অধিকার থাকে না। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছিল বিজলি তৈরির জন্য। সেই বিজলি ব্যবহার করেছে ঢাকার নাগরিকেরা। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশের হাজার হাজার মানুষের ভিটা, জমি, পুকুর, বাগান তলিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য।
এই অঞ্চলের প্রত্যেক মানুষকেই ভাবতে হবে, পানির প্রয়োজন সবার। গঙ্গার পানিতে উত্তর প্রদেশের কৃষকের যতটুকু অধিকার, ততটুকু অধিকার মুর্শিদাবাদের কৃষকের এবং সমান অধিকার কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী কিংবা বিক্রমপুরের কৃষকের। গায়ের জোরে এই অধিকার কেড়ে নেওয়া অনৈতিক। একটি নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষ কত, তার চাহিদা কত, পানির পরিমাণ কত—এসব হিসাব কষা খুব জটিল বিষয় নয়। দুই দেশের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছেই এ হিসাবগুলো আছে। আমরা যদি আলাপ-আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিনিময় করতে পারি, ফুটবল টিম আনতে ও পাঠাতে পারি, যৌথ প্রযোজনায় ছবি বানাতে পারি, তাহলে এই অতি জরুরি মানবিক সমস্যার সমাধান কেন করতে পারব না?
‘ন্যায্য হিস্যা’ নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি অনেক হয়েছে। দরকার এই ন্যায্যতার মানদণ্ড ঠিক করা। বাগাড়ম্বরের রাজনীতি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান কোনো দিনই হবে না। এই দুটি দেশ নানাভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা যেমন শক্তির জোগান দিতে পারে, তেমনি হতে পারে বোঝা কিংবা দায়। এই নির্ভরশীলতার বিষয়টিকে যদি কোনো একটি পক্ষ ব্ল্ল্যাকমেইলিংয়ের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, তাহলে কোনো দিনই বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে না।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
আমাদের দেশে যে পরিমাণ পানি বিভিন্ন নদীনালা দিয়ে প্রবাহিত হয়, তার প্রায় ৯২ শতাংশ আসে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এই তিনটি নদীর মাধ্যমে। বর্ষা মৌসুমে, বিশেষ করে জুন থেকে অক্টোবর মাসে যে পরিমাণ পানি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তা যদি আটকে রাখা যেত, তাহলে বাংলাদেশ ১০ মিটার পানির নিচে থাকত। এত পানি পৃথিবীতে শুধু আরেকটি নদী দিয়েই প্রবাহিত হয়। তা হলো দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন। কিন্তু পানি তো ধরে রাখা যায় না। অনেকটা চলে যায় সাগরে। এবং যাওয়ার রাস্তা একটাই, চাঁদপুরের কোল ঘেঁষে মেঘনা দিয়ে। শুকনো মৌসুমে চিত্রটা ভিন্ন। পানি আসে কম। অনেক শাখানদী শুকিয়ে যায়। তৈরি হয় নানা রকম সমস্যা।
যেকোনো সম্পদ যদি সীমিত হয়, তার ভাগাভাগি নিয়ে সমস্যা তৈরি হতেই পারে। সমতার ভিত্তিতে যদি ভাগ-বাটোয়ারা হয়, তাহলে সবাইকে অল্পস্বল্প নিয়ে তুষ্ট থাকতে হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা পানি সমস্যার একটা সুরাহা করার চেষ্টা করি না কেন?
আমরা অনেক দিন যাবৎ শুনে আসছি, আমাদের ‘বেসিন অ্যাপ্রোচ’-এ যাওয়া দরকার। অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনা হতে হবে অববাহিকাভিত্তিক। বিষয়টি খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা একটি বিশাল এলাকা। নদীর জন্ম মানুষের জন্মের আগে। দেশ তো হয়েছে আরও অনেক পরে। এখন নদীর মালিকানা দাবি করে বসেছে অববাহিকাভুক্ত দেশগুলো। কেমন করে হবে এর সমাধান?
এই তিনটি নদীর অববাহিকার মোট অঞ্চলের ৭ শতাংশ পড়েছে বাংলাদেশের ভেতর, ৪ শতাংশ নেপালে, ২ শতাংশ ভুটানে। ১০-১২ শতাংশ চীনে এবং বাকিটা ভারতে। এই নদীগুলোর পানি নানাভাবে ব্যবহার করে আসছে এই অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ, হাজার হাজার বছর ধরে। এখন পানি ব্যবহারের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। তাই চাহিদার তুলনায় জোগানে ঘাটতি পড়ছে।
এখন শুধু জলপান, গৃহস্থালি কাজ আর চাষবাসে পানির ব্যবহার সীমাবদ্ধ নয়। বিজলি বানাতে পানি লাগে, কলকারখানায় পানি দরকার হয়, আধুনিক কৃষিব্যবস্থায় সেচের জন্য পানি লাগে প্রচুর। নগরায়ণ বেড়ে যাওয়ার ফলে পানির জোগান দিতে হিমশিম খেতে হয় পুরসভাগুলোকে। মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে মানুষের চাহিদা। নদীর ক্ষমতা বাড়ছে না, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে পড়ে ক্রমহ্রাসমান হচ্ছে জলের ধারা।
একটি নদীর অববাহিকায় বসবাসকারী প্রতিটি মানুষেরই অধিকার আছে ওই নদীর পানি ব্যবহারের। আবার নদীকে রক্ষা করার দায়িত্বও সবার। এখানে ভাবতে হবে মানুষের কথা, বাঁচাতে হবে নদী।
আমাদের জানা আছে, দেশমাত্রই মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। মানুষের চেয়ে দেশ বড়, বড়াই করে এ কথা তাঁরাই বলেন, যাঁরা দেশের কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করেন। মানুষের কথা ভাবলে, তার প্রয়োজনকে আমলে নিলে তো দেশে দেশে ঝগড়া হওয়ার কথা নয়। তার পরও ঝগড়া চলে। যেমন বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে চলছে চার দশক ধরে। এই ঝগড়ার এক অমোঘ অনুপান হলো পানির জাতীয়তাবাদী ব্যবহার, যা প্রয়োগ করা হচ্ছে দুই দেশের ভোটের রাজনীতিতে। দেশ বিক্রি, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি—এসব নষ্ট পঙিক্তমালা উচ্চারিত হচ্ছে রাজনীতিবিদদের মুখে মুখে।
পানির জোগান কমে গেলে তা মোকাবিলা করার সবচেয়ে সহজ রাস্তা হলো পানি ব্যবহারের অগ্রাধিকার নির্ণয় করা এবং অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয় বা কম দরকারি চাহিদাগুলোকে বাদ দিয়ে জীবনধারণের জন্য যা কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ, তার দিকে নজর দেওয়া। প্রথমেই হিসাব করা দরকার, আমাদের পানীয় জলের প্রয়োজন কতটুকু। তারপর আসে চাষবাস। আমাদের ভেবে দেখতে হবে, একবার টয়লেট ফ্লাশ করার জন্য আমরা চার লিটার পানি ব্যবহার করব, নাকি ওই চার লিটার পানীয় জলের চাহিদা মেটানোর জন্য সরবরাহ করব।
আমরা এক এক করে সবগুলো নদীর পানিপ্রবাহের পরিমাণ এবং ওই নদীর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগত দিকটি হিসাব করে আলোচনার টেবিলে বসে ঝগড়া মিটমাট করতে পারি। একবার ভাগাভাগি হয়ে গেলে একটি দেশ তার পরিধির মধ্যে ওই পানি কীভাবে ব্যবহার করবে, সেটা সেই দেশ ঠিক করে নেবে। ধরা যাক, আমরা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পাব তিস্তা থেকে। তো সেই পানি আমরা কতটুকু দেব কুড়িগ্রামের কৃষককে, কতটুকু দেব লালমনিরহাটের কৃষককে আর কতটুকু রাখব রংপুর শহরের নাগরিকদের টয়লেট ফ্লাশ করার জন্য, সেই পরিকল্পনা আমাদেরই করতে হবে।
আমরা অনেকেই পানি বণ্টন নিয়ে আবেগতাড়িত হই এবং রাজনীতি করি। আমরা এটা স্বীকার করতে চাই না যে, পর্যাপ্ত পানি পেলেও সব মানুষের তাতে অধিকার থাকে না। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছিল বিজলি তৈরির জন্য। সেই বিজলি ব্যবহার করেছে ঢাকার নাগরিকেরা। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশের হাজার হাজার মানুষের ভিটা, জমি, পুকুর, বাগান তলিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য।
এই অঞ্চলের প্রত্যেক মানুষকেই ভাবতে হবে, পানির প্রয়োজন সবার। গঙ্গার পানিতে উত্তর প্রদেশের কৃষকের যতটুকু অধিকার, ততটুকু অধিকার মুর্শিদাবাদের কৃষকের এবং সমান অধিকার কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী কিংবা বিক্রমপুরের কৃষকের। গায়ের জোরে এই অধিকার কেড়ে নেওয়া অনৈতিক। একটি নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষ কত, তার চাহিদা কত, পানির পরিমাণ কত—এসব হিসাব কষা খুব জটিল বিষয় নয়। দুই দেশের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছেই এ হিসাবগুলো আছে। আমরা যদি আলাপ-আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিনিময় করতে পারি, ফুটবল টিম আনতে ও পাঠাতে পারি, যৌথ প্রযোজনায় ছবি বানাতে পারি, তাহলে এই অতি জরুরি মানবিক সমস্যার সমাধান কেন করতে পারব না?
‘ন্যায্য হিস্যা’ নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি অনেক হয়েছে। দরকার এই ন্যায্যতার মানদণ্ড ঠিক করা। বাগাড়ম্বরের রাজনীতি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান কোনো দিনই হবে না। এই দুটি দেশ নানাভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা যেমন শক্তির জোগান দিতে পারে, তেমনি হতে পারে বোঝা কিংবা দায়। এই নির্ভরশীলতার বিষয়টিকে যদি কোনো একটি পক্ষ ব্ল্ল্যাকমেইলিংয়ের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, তাহলে কোনো দিনই বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে না।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
No comments