কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
সাইকেল রিকশার মতো সিএনজিচালিত অটোরিকশাও হরতালে জায়েজ হয়ে গেল। হরতালের কয়েক দিন রাজধানীর অনেক রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে সে রকম অভিজ্ঞতাই আমার হয়েছে। যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যাও কম ছিল না। আর মহাখালীর মোড় ছাড়িয়ে যতই উত্তরে গেছি, দেখেছি প্রচুর প্রাইভেট গাড়ি।
তার ভেতর কোটি টাকার জিপও চোখে পড়েছে। অর্থাৎ গুলশান, বনানী, ওল্ড এবং নিউ ডিওএইচএস, বারিধারা, উত্তরায় হরতালের সাড়া কোথায়। ছুটির দিনের আউটিংয়ের মেজাজে সবাই যেন ফুর্তি করতে বেরিয়েছে। হরতাল আহ্বানকারী রাজনৈতিক দলের বেশির ভাগ নেতাই কিন্তু এসব তথাকথিত অভিজাত এলাকায় থাকেন। এ নেতাদের বেশির ভাগই হরতালের সময় পিকেটিং করতে রাস্তায় বের না হয়ে ছুটির মেজাজে সময় কাটান। হরতাল শেষে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে সত্য-মিথ্যার গরম গরম কথা বলেন উত্তেজিত ভঙ্গিতে। ভাবখানা এমন যে 'করিল লঙ্কা জয়'। কত কথা যে তাঁরা বলেন! অনর্গল অজস্র অবান্তর কথা শুনতে শুনতে মনে হয়, ওরে বাবা, এত বোঝেন তাঁরা! সঙ্গে সঙ্গে পুরনো প্রবাদটিও দুঃখজনকভাবে মনে পড়ে। সেই যে 'যে কহে বিস্তর কথা সে কহে বিস্তর মিছা'। দেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু সবই বোঝেন। কেননা গণমাধ্যম, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্যামেরার লেন্স নানা ফাঁকফোকর দিয়ে এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব কিছু তুলে ধরে যে নেতাদের কথার ফুলঝুরির ভেতর গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রকৃত সত্যকে তাঁরা ঠিকই যাচাই করে নেন। ৬ জুলাই সংসদ ভবনের পবিত্র এলাকায় বিরোধী দলের চিফ হুইপের ঘটনা তাই বোধ হয় রাজনীতিতে খুব একটা প্লাস পয়েন্ট হয়ে দেখা দেয়নি। ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনক তো বটেই। পুলিশের হাতে অনেকটা স্বেচ্ছা-লাঞ্ছিত বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের ঘটনাটিকে ভিত্তি করে বিএনপির রাজনীতি খুব একটা লাভবান না হলেও দুর্মুখেরা বলেন, দলীয় রেটিংয়ে জয়নুল আবদিন ফারুকের র্যাংক ওপরে উঠলেও উঠতে পারে। দুর্মুখেরা আরো বলেন, হয়তো এ জন্যই তিনি কর্তব্যরত পুলিশকে উসকানি দিয়ে উত্তপ্ত করেছেন। ক্রমাগত উত্তপ্ত এবং অপমানে আহত হতে হতে পুলিশ সদস্যরা শালীনতা বজায় রাখতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত যা ঘটার তাই ঘটেছে। রাজপথে লাঞ্ছিত ফারুক সাহেবের অর্ধনগ্ন শরীরের ছবি দেশ-বিদেশে প্রদর্শিত হয়েছে গণমাধ্যমের কল্যাণে। বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, পুলিশ নাকি জয়নুল আবদিন ফারুককে হত্যা করতে চেয়েছিল। সাধারণ মানুষ এটা বিশ্বাস করবেন বলে বিশ্বাস হয় না। তাঁরা যে আগেভাগেই গণমাধ্যমের ক্যামেরায় ঘটনার পূর্বাপর সব কিছু দেখে ফেলেছেন। জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘটনাটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের কমিটিও গঠন করেছে। এটা নিয়েও সাধারণ মানুষ অবশ্য বেশি কিছু ভাবেন না বলেই আমার ধারণা। অনুসন্ধানের রিপোর্ট কী হতে পারে তা তাঁরা জানেন। অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁরা তা বুঝতে পারেন। রিপোর্টে কী পাওয়া গেল, কী পাওয়া গেল না তা জানার জন্য তাঁদের আগ্রহও থাকবে না জানি। কারণ গণমাধ্যমের তথ্য এবং নিজেদের বিবেচনায় তাঁরা কী সত্য, কতটুকু সত্য_মোটামুটি বুঝে গেছেন। খবরের পেছনের খবর তো তাঁরা জানেনই। তাই ভবিষ্যতে কী হতে পারে বা হবে, সেটাও তাঁরা আগাম বুঝে গেছেন।
জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ হত্যা করতে চেয়েছিল বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। অথচ ২১ আগস্টের মতো ভয়াবহ ঘটনাকে তারা তাদের শাসনামলে গুরুত্বই দেয়নি। সেদিনের বিরোধীদলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য বর্বর গ্রেনেড হামলার বিষয়টি তাদের বিবেচনায় এতই সাদামাটা যে এ ব্যাপারে সামান্যতম দুঃখ প্রকাশ না করে সরকার, প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় নেতারা মিথ্যা ও কুরুচিপূর্ণ অরাজনৈতিক মন্তব্য করেছিলেন। প্রায় সাত বছর পরে যখন সিআইডির তদন্তে আসল সত্য উন্মোচিত হতে চলেছে তখনো তারা হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িতদের রক্ষা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। সঙ্গে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাঙালি নিধনে সহায়তাকারী জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই তারা একজোট হয়েছে। জনগণ কিন্তু এসব বোঝেন। তাঁরা বোঝেন যে জনস্বার্থে নয়, বিরোধী দল তাদের নিজের মানুষদের বিচারের হাত থেকে বাঁচানোর স্বার্থে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। ৬, ৭ এবং পূর্ববর্তী হরতালগুলোর উদ্দেশ্য ও কারণও তাঁরা সহজ হিসাবে ঠিকই মিলিয়ে নেন। বক্তৃতা-বিবৃতি-সেমিনার-টক শো-গাড়ি পোড়ানো ইত্যাদির পেছনে আসল উদ্দেশ্য যে কী, তাও তাঁরা সহজে বুঝে ফেলেন। তুলনায় না গিয়েও ২১ আগস্ট এবং ৬ জুলাইয়ের ঘটনার মধ্যে আসল ও নকলের ফারাক বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। অথচ নকলটার জন্য আজ বিরোধী দলের অপপ্রচারও কুম্ভীরাশ্রু। সেদিনের আসলটার জন্য সামান্য উদ্বেগটুকুও তারা প্রকাশ করে না। এটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিপন্থী। অথচ বিরোধী চিফ হুইপের ঘটনায় সংসদে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসী তা জেনেছেন। বিরোধী দলের নেত্রী এবং সংসদ সদস্যরা সেদিন সংসদে উপস্থিত থাকলে ভালো হতো না কি! তা ছাড়া বিরোধী চিফ হুইপ কেন যে সেদিন সংসদ ভবনের নিরাপদ আশ্রয়ে না গিয়ে উল্টো ন্যাম ভবনের দিকে দৌড়ালেন, সেটাও জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে এতবার হরতালের যৌক্তিকতা নিয়েও। জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত না করে কেবল বিশেষ স্বার্থে দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করতে ঘন ঘন হরতাল ডেকে গুরুত্বপূর্ণ এই গণতান্ত্রিক অস্ত্রকে ভোঁতা হয়ে যেতে দেখলে খারাপই লাগে। প্রতিবাদের অহিংস পন্থা হিসেবে হরতাল বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জনসম্পৃক্ত হরতালের ভূমিকা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে গেছে। সেসব হরতালের জনভিত্তি ছিল, অধিকার আদায়ের দাবিতে যৌক্তিক ভূমিকা ছিল। কিন্তু গত আড়াই বছরে আহূত হরতালের ফলে সেই ঐতিহ্যিক ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টা হয়েছে। জনস্বার্থ বিবর্জিত নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী হরতালে সাধারণ মানুষের বিরক্তি এবং উৎকণ্ঠা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎকেও ধ্বংস করছে। তরুণ সমাজের স্বাভাবিক উচ্ছল অগ্রগতিতে অহেতুক ছন্দপতন ঘটিয়ে তাদের রাজনীতিবিমুখ করার এই ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গল বয়ে আনবে না। তা ছাড়া হরতালে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং সামাজিক সংকট সৃষ্টির দায়িত্বও কি হরতাল আহ্বানকারী দল ও গোষ্ঠী এড়াতে পারবে? গাড়ি পুড়িয়ে, বোমা ফাটিয়ে, আতঙ্ক সৃষ্টি করে কি জনগণকে দলে ভেড়ানো যাবে? যাবে না। আন্দোলনের কর্মসূচিতে যদি নিজের এবং পারিপাশ্বর্িকতার প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্নমাখা না থাকে তবে সাধারণ মানুষ সচেতনভাবে সম্পৃক্ত হবেনই বা কেন! যৌক্তিক বিচারে তাঁরা যদি সচেতন এবং উদ্বুদ্ধ না হন তবে জোরজবরদস্তি করে তাদের যে আপন করা যাবে না_এটা কে না বোঝে। তা ছাড়া সভ্যতার অগ্রযাত্রায় হিংস্রতা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা বর্তমান বিশ্ব সংস্কৃতিতে অন্তরায়। এ প্রসঙ্গে গ্রাম্য প্রবাদের কথা মনে পড়ছে, 'গায়ের জোরে পিরিত হয় না, ধইরা-বাইন্দা মুরিদ হয় না।' প্রগতি এবং উন্নয়নবিরোধী হরতাল নেতাদের কথাটা মনে রাখা ভালো।
সরকারের জনভিত্তি এখন পর্যন্ত যথেষ্ট শক্ত এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উন্নয়নযাত্রায় তাদের কার্যকর ভূমিকাও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সুতরাং কেবল দলীয় কর্মীদের সক্রিয় রাখার হরতালে সরকারকে সহজে ব্যর্থ প্রমাণিত করা যাবে না। ভোঁতা দায়ে যেমন কচুগাছও কাটা যায় না, তেমনি অপ্রয়োজনীয় হরতাল অথবা সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের পতনও সম্ভব নয়। বরং সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বাভাবিক চর্চায় বিরোধী দলকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সেখানে দেশ এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর কর্মসূচিই কাম্য। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য যদি সংসদে না গিয়ে রাজপথে রুচিহীন, অসুন্দর ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে চলেন, তবে তা স্বাভাবিকও নয়, শোভনও নয়। ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের মতো দেশে সামাজিক সুস্থিতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা ছাড়া জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। নীতি অথবা কর্মসূচির ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের বৈপরীত্য থাকাটা স্বাভাবিক। নৈরাজ্যবাদীরা সরকারের সব সিদ্ধান্তে খুশি হবে না, সেটাও স্বাভাবিক। সব ব্যাপারে যৌক্তিক মতামত দেওয়ার অধিকার গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সিদ্ধ। সুশৃঙ্খল এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ ছাড়া সেখানে আর কোনো পথ জনগ্রাহ্য হতে পারে না। কিন্তু এভাবে হরতালের পর হরতাল (অলি সাহেব মাসব্যাপী হরতালের প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন) দিয়ে সাধারণ মানুষের গাড়ি পুড়িয়ে, বোমা ফাটিয়ে নৈরাজ্য ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়। ভুলে গেলে চলবে না যে মাত্র আড়াই বছর আগে যে সরকার দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাকে আড়াই বছর পর নির্বাচনের মাধ্যমে হটানো ছাড়া আর কোনো বৈধ এবং স্বাভাবিক পথ খোলা নেই। আর অন্য পথের চোরাগলি যদি কেউ বেছে নেন, তা অবৈধ এবং অস্বাভাবিক।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ হত্যা করতে চেয়েছিল বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। অথচ ২১ আগস্টের মতো ভয়াবহ ঘটনাকে তারা তাদের শাসনামলে গুরুত্বই দেয়নি। সেদিনের বিরোধীদলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য বর্বর গ্রেনেড হামলার বিষয়টি তাদের বিবেচনায় এতই সাদামাটা যে এ ব্যাপারে সামান্যতম দুঃখ প্রকাশ না করে সরকার, প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় নেতারা মিথ্যা ও কুরুচিপূর্ণ অরাজনৈতিক মন্তব্য করেছিলেন। প্রায় সাত বছর পরে যখন সিআইডির তদন্তে আসল সত্য উন্মোচিত হতে চলেছে তখনো তারা হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িতদের রক্ষা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। সঙ্গে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাঙালি নিধনে সহায়তাকারী জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই তারা একজোট হয়েছে। জনগণ কিন্তু এসব বোঝেন। তাঁরা বোঝেন যে জনস্বার্থে নয়, বিরোধী দল তাদের নিজের মানুষদের বিচারের হাত থেকে বাঁচানোর স্বার্থে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। ৬, ৭ এবং পূর্ববর্তী হরতালগুলোর উদ্দেশ্য ও কারণও তাঁরা সহজ হিসাবে ঠিকই মিলিয়ে নেন। বক্তৃতা-বিবৃতি-সেমিনার-টক শো-গাড়ি পোড়ানো ইত্যাদির পেছনে আসল উদ্দেশ্য যে কী, তাও তাঁরা সহজে বুঝে ফেলেন। তুলনায় না গিয়েও ২১ আগস্ট এবং ৬ জুলাইয়ের ঘটনার মধ্যে আসল ও নকলের ফারাক বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। অথচ নকলটার জন্য আজ বিরোধী দলের অপপ্রচারও কুম্ভীরাশ্রু। সেদিনের আসলটার জন্য সামান্য উদ্বেগটুকুও তারা প্রকাশ করে না। এটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিপন্থী। অথচ বিরোধী চিফ হুইপের ঘটনায় সংসদে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসী তা জেনেছেন। বিরোধী দলের নেত্রী এবং সংসদ সদস্যরা সেদিন সংসদে উপস্থিত থাকলে ভালো হতো না কি! তা ছাড়া বিরোধী চিফ হুইপ কেন যে সেদিন সংসদ ভবনের নিরাপদ আশ্রয়ে না গিয়ে উল্টো ন্যাম ভবনের দিকে দৌড়ালেন, সেটাও জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে এতবার হরতালের যৌক্তিকতা নিয়েও। জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত না করে কেবল বিশেষ স্বার্থে দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করতে ঘন ঘন হরতাল ডেকে গুরুত্বপূর্ণ এই গণতান্ত্রিক অস্ত্রকে ভোঁতা হয়ে যেতে দেখলে খারাপই লাগে। প্রতিবাদের অহিংস পন্থা হিসেবে হরতাল বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জনসম্পৃক্ত হরতালের ভূমিকা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে গেছে। সেসব হরতালের জনভিত্তি ছিল, অধিকার আদায়ের দাবিতে যৌক্তিক ভূমিকা ছিল। কিন্তু গত আড়াই বছরে আহূত হরতালের ফলে সেই ঐতিহ্যিক ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টা হয়েছে। জনস্বার্থ বিবর্জিত নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী হরতালে সাধারণ মানুষের বিরক্তি এবং উৎকণ্ঠা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎকেও ধ্বংস করছে। তরুণ সমাজের স্বাভাবিক উচ্ছল অগ্রগতিতে অহেতুক ছন্দপতন ঘটিয়ে তাদের রাজনীতিবিমুখ করার এই ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গল বয়ে আনবে না। তা ছাড়া হরতালে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং সামাজিক সংকট সৃষ্টির দায়িত্বও কি হরতাল আহ্বানকারী দল ও গোষ্ঠী এড়াতে পারবে? গাড়ি পুড়িয়ে, বোমা ফাটিয়ে, আতঙ্ক সৃষ্টি করে কি জনগণকে দলে ভেড়ানো যাবে? যাবে না। আন্দোলনের কর্মসূচিতে যদি নিজের এবং পারিপাশ্বর্িকতার প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্নমাখা না থাকে তবে সাধারণ মানুষ সচেতনভাবে সম্পৃক্ত হবেনই বা কেন! যৌক্তিক বিচারে তাঁরা যদি সচেতন এবং উদ্বুদ্ধ না হন তবে জোরজবরদস্তি করে তাদের যে আপন করা যাবে না_এটা কে না বোঝে। তা ছাড়া সভ্যতার অগ্রযাত্রায় হিংস্রতা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা বর্তমান বিশ্ব সংস্কৃতিতে অন্তরায়। এ প্রসঙ্গে গ্রাম্য প্রবাদের কথা মনে পড়ছে, 'গায়ের জোরে পিরিত হয় না, ধইরা-বাইন্দা মুরিদ হয় না।' প্রগতি এবং উন্নয়নবিরোধী হরতাল নেতাদের কথাটা মনে রাখা ভালো।
সরকারের জনভিত্তি এখন পর্যন্ত যথেষ্ট শক্ত এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উন্নয়নযাত্রায় তাদের কার্যকর ভূমিকাও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সুতরাং কেবল দলীয় কর্মীদের সক্রিয় রাখার হরতালে সরকারকে সহজে ব্যর্থ প্রমাণিত করা যাবে না। ভোঁতা দায়ে যেমন কচুগাছও কাটা যায় না, তেমনি অপ্রয়োজনীয় হরতাল অথবা সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের পতনও সম্ভব নয়। বরং সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বাভাবিক চর্চায় বিরোধী দলকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সেখানে দেশ এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর কর্মসূচিই কাম্য। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য যদি সংসদে না গিয়ে রাজপথে রুচিহীন, অসুন্দর ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে চলেন, তবে তা স্বাভাবিকও নয়, শোভনও নয়। ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের মতো দেশে সামাজিক সুস্থিতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা ছাড়া জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। নীতি অথবা কর্মসূচির ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের বৈপরীত্য থাকাটা স্বাভাবিক। নৈরাজ্যবাদীরা সরকারের সব সিদ্ধান্তে খুশি হবে না, সেটাও স্বাভাবিক। সব ব্যাপারে যৌক্তিক মতামত দেওয়ার অধিকার গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সিদ্ধ। সুশৃঙ্খল এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ ছাড়া সেখানে আর কোনো পথ জনগ্রাহ্য হতে পারে না। কিন্তু এভাবে হরতালের পর হরতাল (অলি সাহেব মাসব্যাপী হরতালের প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন) দিয়ে সাধারণ মানুষের গাড়ি পুড়িয়ে, বোমা ফাটিয়ে নৈরাজ্য ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়। ভুলে গেলে চলবে না যে মাত্র আড়াই বছর আগে যে সরকার দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাকে আড়াই বছর পর নির্বাচনের মাধ্যমে হটানো ছাড়া আর কোনো বৈধ এবং স্বাভাবিক পথ খোলা নেই। আর অন্য পথের চোরাগলি যদি কেউ বেছে নেন, তা অবৈধ এবং অস্বাভাবিক।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments