শ্রদ্ধাঞ্জলি-আমার স্মৃতিতে কমরেড ফরহাদ
ছাত্রজীবন থেকেই কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে জানতাম। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, ১৯৫৮-পরবর্তী সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কিংবদন্তিসম খ্যাতি এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান, সেই সময় ছাত্র আন্দোলনে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের কাছে সুবিদিত ছিল। ঢাকার বাইরে ছাত্রজীবন কাটানোর ফলে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাইনি।
স্বাধীনতার পর ঢাকায় কর্মজীবন শুরু করলেও সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না হওয়ায় এখানেও পরিচয় হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারসহ হত্যা করে দেশে রাজনৈতিক ধারা বদলে দেওয়ার পালা শুরু হয়। এর পরই চারজন জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। দেশে নেমে আসে অন্ধকারসম সামরিক প্রতিক্রিয়াশীল শাসন। আমি সেই সময় মোহাম্মদপুরে একটি বাসায় থাকতাম। ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান, যিনি এখন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতা এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অধিভুক্ত সমিতিগুলোর জাতীয় পর্যায়ের সমন্বয়ক, তিনি ছিলেন ফরহাদ ভাইয়ের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি আমার একজন শ্রদ্ধেয় শুভানুধ্যায়ী ও পরামর্শক। তিনি আমাকে জানালেন, ফরহাদ ভাই এখন পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে কাজ করছেন। আমার বাসায় মাঝেমধ্যে থাকার প্রস্তাব ওয়াজেদ ভাই জানালেন। আমি সম্মতি জানানোর পর একদিন ওয়াজেদ ভাই রাতে তাঁকে আমার বাসায় নিয়ে এলেন। আমার ছোট বাসায় একটি কক্ষে তিনি কয়েক দিন অবস্থান করলেন, তারপর নিরাপত্তার কারণে অন্য জায়গায় চলে গেলেন। কিছুদিন পর এসে আবার কয়েক দিন থাকলেন। এভাবে কয়েক দফায় তিনি সেখানে দিন কাটিয়েছেন। প্রায়ই সেখানে গোপনে নেতা-কর্মীরা আসতেন এবং আলোচনা ও খবরাখবর বিনিময় হতো এবং নির্দেশ পাঠানো হতো।
ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচিতির পরিধি ছিল পরিবারের দিক থেকে সীমিত ও সময়ের হিসাবে স্বল্প। এর মধ্যেও তাঁর সম্বন্ধে কিছু বিষয়ে আমি নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি। প্রথমত, তিনি অন্যদের সঙ্গে আচরণে ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মানুষকে তাঁর সঙ্গে সহজ ভাব-বিনিময়ে নিয়ে যেতে পারতেন। দ্বিতীয়ত, অনেক জটিল বিষয়কে তিনি সহজ আঙ্গিকে উপস্থাপন করে বিশ্লেষণ করতে পারতেন। রাজনীতিতে তাঁর যতটা দখল ছিল, তার তুলনায় আমার জ্ঞান ছিল অতি সামান্য। অথচ তাঁর সঙ্গে যখন আলোচনা হতো, তখন অনেক কঠিন জিনিস তিনি সহজ করে দিতেন। তৃতীয়ত, তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। আত্মগোপনে থাকা সত্ত্বেও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনার মাধ্যমে যে উদ্দীপনা ও কর্মতৎপরতা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, তা আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারতাম। নিজের দল তো বটেই, সহযোগী দলগুলোর সংগঠনেও তিনি অবদান রেখেছিলেন। সামরিক শাসন উঠে যাওয়ার পর এই পর্যায় শেষ হয়। এর পরও মাঝেমধ্যে ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিন্তু তিনি তখন অত্যন্ত কর্মব্যস্ত।
আরও একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। চিকিৎসক হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা ও আলোচনা হওয়ার সুযোগ হতো। তাঁরা অনেকেই আমার সঙ্গে ফরহাদ ভাইয়ের সংযোগ সম্বন্ধে জানতেন না। বিভিন্ন সংকটের সময় তাঁদের কয়েকজন এ কথা প্রকাশ করেন বা তাঁরা ফরহাদ ভাইয়ের পরামর্শ নিয়েছেন বা নেবেন। ফরহাদ ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতি শ্রদ্ধা শুধু তাঁর দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।
ফরহাদ ভাইয়ের অকালপ্রয়াণ শুধু যে তাঁর দলের জন্য ক্ষতি ছিল তা নয়, এ দেশের রাজনীতিতে তা একটি বড় শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল। অনেকের সঙ্গে আমিও মনে করি, তিনি বেঁচে থাকলে প্রগতিশীল রাজনীতি আরও বেগবান হতো এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন আরও ত্বরান্বিত হতো।
মাহমুদ হাসান
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারসহ হত্যা করে দেশে রাজনৈতিক ধারা বদলে দেওয়ার পালা শুরু হয়। এর পরই চারজন জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। দেশে নেমে আসে অন্ধকারসম সামরিক প্রতিক্রিয়াশীল শাসন। আমি সেই সময় মোহাম্মদপুরে একটি বাসায় থাকতাম। ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান, যিনি এখন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতা এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অধিভুক্ত সমিতিগুলোর জাতীয় পর্যায়ের সমন্বয়ক, তিনি ছিলেন ফরহাদ ভাইয়ের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি আমার একজন শ্রদ্ধেয় শুভানুধ্যায়ী ও পরামর্শক। তিনি আমাকে জানালেন, ফরহাদ ভাই এখন পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে কাজ করছেন। আমার বাসায় মাঝেমধ্যে থাকার প্রস্তাব ওয়াজেদ ভাই জানালেন। আমি সম্মতি জানানোর পর একদিন ওয়াজেদ ভাই রাতে তাঁকে আমার বাসায় নিয়ে এলেন। আমার ছোট বাসায় একটি কক্ষে তিনি কয়েক দিন অবস্থান করলেন, তারপর নিরাপত্তার কারণে অন্য জায়গায় চলে গেলেন। কিছুদিন পর এসে আবার কয়েক দিন থাকলেন। এভাবে কয়েক দফায় তিনি সেখানে দিন কাটিয়েছেন। প্রায়ই সেখানে গোপনে নেতা-কর্মীরা আসতেন এবং আলোচনা ও খবরাখবর বিনিময় হতো এবং নির্দেশ পাঠানো হতো।
ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচিতির পরিধি ছিল পরিবারের দিক থেকে সীমিত ও সময়ের হিসাবে স্বল্প। এর মধ্যেও তাঁর সম্বন্ধে কিছু বিষয়ে আমি নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি। প্রথমত, তিনি অন্যদের সঙ্গে আচরণে ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মানুষকে তাঁর সঙ্গে সহজ ভাব-বিনিময়ে নিয়ে যেতে পারতেন। দ্বিতীয়ত, অনেক জটিল বিষয়কে তিনি সহজ আঙ্গিকে উপস্থাপন করে বিশ্লেষণ করতে পারতেন। রাজনীতিতে তাঁর যতটা দখল ছিল, তার তুলনায় আমার জ্ঞান ছিল অতি সামান্য। অথচ তাঁর সঙ্গে যখন আলোচনা হতো, তখন অনেক কঠিন জিনিস তিনি সহজ করে দিতেন। তৃতীয়ত, তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। আত্মগোপনে থাকা সত্ত্বেও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনার মাধ্যমে যে উদ্দীপনা ও কর্মতৎপরতা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, তা আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারতাম। নিজের দল তো বটেই, সহযোগী দলগুলোর সংগঠনেও তিনি অবদান রেখেছিলেন। সামরিক শাসন উঠে যাওয়ার পর এই পর্যায় শেষ হয়। এর পরও মাঝেমধ্যে ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিন্তু তিনি তখন অত্যন্ত কর্মব্যস্ত।
আরও একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। চিকিৎসক হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা ও আলোচনা হওয়ার সুযোগ হতো। তাঁরা অনেকেই আমার সঙ্গে ফরহাদ ভাইয়ের সংযোগ সম্বন্ধে জানতেন না। বিভিন্ন সংকটের সময় তাঁদের কয়েকজন এ কথা প্রকাশ করেন বা তাঁরা ফরহাদ ভাইয়ের পরামর্শ নিয়েছেন বা নেবেন। ফরহাদ ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতি শ্রদ্ধা শুধু তাঁর দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।
ফরহাদ ভাইয়ের অকালপ্রয়াণ শুধু যে তাঁর দলের জন্য ক্ষতি ছিল তা নয়, এ দেশের রাজনীতিতে তা একটি বড় শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল। অনেকের সঙ্গে আমিও মনে করি, তিনি বেঁচে থাকলে প্রগতিশীল রাজনীতি আরও বেগবান হতো এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন আরও ত্বরান্বিত হতো।
মাহমুদ হাসান
No comments