সদরে অন্দরে-কে সামলাবে এই সোনার ছেলেদের by মোস্তফা হোসেইন
কাকের মাংস কাকে খায় না। ব্যাপক প্রচলিত প্রবাদ এটি। কিন্তু ছাত্রলীগ ছাত্রলীগের মাংস খায়। এমনই প্রবাদতুল্য কথা খাটে ছাত্রলীগের কীর্তিকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে। সহকর্মী-সহযোগী এবং নেতা-কর্মী হওয়ার পরও রেহাই নেই। মতের অমিল হলে কিংবা ভাগে কমবেশি হলে মাথা কেটে নিতেও দ্বিধা করে না ওরা। কেন এমনটি হলো? প্রশ্ন সংগত কারণেই এসে যায়। নিন্দুকের মুখ থেকে শোনা হলেও বাস্তবতার সঙ্গে অনেক মিল আছে সেই প্রশ্নের জবাবের। তাদের কথা,
আজরাইলের যেমন নিজের প্রাণ নিজেরই বধ করার কথা, তেমন আর কি? প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে করতে প্রতিপক্ষহীন ছাত্রলীগ এবার নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে লাগতে শুরু করেছে। অন্তত সাম্প্রতিক ছাত্রলীগীয় কিছু কীর্তিকাণ্ড দেখে এমনটাই মনে হয়েছে। আঞ্চলিক গ্রুপ কিংবা নেতাভিত্তিক গ্রুপ এক পক্ষ আরেক পক্ষের সঙ্গে খুনোখুনি করতে ব্যস্ত। অন্যদিকে, প্রতিপক্ষ যদি খুঁজে পাওয়া যায়, সেখানেও হামলে পড়ে সোনার ছেলেরা। শুধু তা-ই নয়, কে সিনিয়র, কে জুনিয়র-এগুলোরও কোনো তোয়াক্কা করে না ওরা। হালের ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, ওরা যেন একটা কাজই বেশি করতে পছন্দ করে। আর তা হচ্ছে, 'পেটাও', 'তালা লাগাও', সর্বোপরি 'যা আছে, সবই কেড়ে নাও'।
তাদের দলীয় নেতা-কর্মীরাই যেখানে নিজেদের নেতা-কর্মীদের হাত থেকে রেহাই পায় না, সেখানে ভিন্ন দলের ছাত্রছাত্রীর অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। ভিন্ন দল কিংবা সাধারণ ছাত্রছাত্রী তাদের হাতে শায়েস্তা হতে হতে এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়ল বলে। শুধু তা-ই নয়, এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নারী নির্যাতনের দুর্নামও পেয়েছে গত দুই দশক ধরে। ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানিক গ্রুপ নামে খ্যাত ছাত্রলীগকর্মীদের হাতে ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। সেই ইতিহাস কিন্তু এখনো মুছে যায়নি। গত বৃহস্পতিবার রাতে সাতক্ষীরা শহরে সোনার ছেলেদের জেলা সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদক মিলে যে কাজটি করেছে, তাতে ছাত্রলীগের ঐতিহ্য ম্লান হয়ে গেছে। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আসা নৃত্যশিল্পীকে ধর্ষণের চেষ্টায় গ্রেপ্তার হওয়া জুয়েল হাসান রাজনীতির অঙ্গনে কিভাবে পরিচিত হবে, জানি না। তবে ছাত্রলীগের ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য এমন জুয়েলদের বেশি প্রয়োজন হয় না।
আর এসব ঐতিহ্যবিরোধী কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হয়েছে মূলত স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকাল থেকে। বিশেষ করে ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত খুনের নায়কের মাধ্যমেই নেতিবাচক ছাত্ররাজনীতির উত্থান বলে মনে করা হয়। সেই খুনি (উচ্চ আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত এবং পরবর্তীকালে সামরিক সরকার কর্তৃক খালাসপ্রাপ্ত; আর এখনো তিনি একটি দলের নেতা হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন) ছাত্রলীগের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির উদ্ভাবক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তাকে গ্রহণ করার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।
শুধু কি সেই খুনিই শেষ কিংবা একমাত্র নেতিবাচক ভূমিকা পালনকারী? হয়তো কোহিনূরসহ সাত খুনের মতো বড় ঘটনা আর কেউ ঘটায়নি। কিন্তু একেক বছর যে পরিমাণ অঘটন এই সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা ঘটিয়েছে, সেগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেসব ঘটনা ১৯৭৩ সালের সেই ঘটনাকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে পিটিয়ে আহত করা, ছুরিকাঘাত করা কিংবা বোমার আঘাত হানার মতো কাজগুলো করতে তাদের মোটেও দ্বিধা হচ্ছে না। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক লাঞ্ছিত করেছে, জাহাঙ্গীরনগরে সহপাঠীদের হত্যা করেছে। শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এবং কুয়েট থেকে শুরু করে বুয়েট, হেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের অপকর্মের ছোঁয়া লাগেনি। সম্প্রতি কুয়েট বন্ধ হয়ে গেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তাণ্ডবের কারণে। বর্তমান সরকারের আমলে এমনি আরো বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অপকর্মের কারণে।
মানুষ যে কতটা অসহিষ্ণু হতে পারে, তার প্রমাণ পেতে হলে বোধ করি ছাত্রলীগের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। সপ্তাহকাল আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ছাত্রলীগকর্মী সিনিয়র শিক্ষার্থী চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ঈষাণকে পিটিয়ে হাত-পা থেঁতলে দিয়েছে। সেই ঘটনার প্রতিবাদে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন করতে দেখা গেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের দুই গুণধর নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
এই গুণধর দুই ছাত্রলীগকর্মী ছাত্ররাজনীতির পরিণতি ভোগ করেছে-এটা বলতে মন সায় দেয় না। কত আশা-ভরসা করে তাদের মা-বাবা বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে নিজেদের সন্তানকে পাঠিয়েছিলেন। ছেলে তাদের ইঞ্জিনিয়ার হবে, নিজের এবং পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে। আর সেই ছেলে কি না বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মাস্তানি করে নিজের এবং পরিবারের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে।
তাদের এই অপকর্ম যে সমাজে কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলছে, তা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও বোঝা সম্ভব হয়েছে। সপ্তাহকাল আগে বুয়েটে এ ঘটনা ঘটার পর বেশ কিছু ফোনকল রিসিভ করতে হয়। সেই ফোনকলগুলো রিসিভ করার পর মনে হয়েছে, ভুক্তভোগীদের আত্মীয়স্বজনের না জানি কী অবস্থা। ফোন যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই কথা-আমার ছেলের কিছু হয়নি তো? সেও পড়ে বুয়েটে। তাঁদের আশঙ্কা, না জানি এমন ছেলেটাও কোনো বিপাকে পড়েছে? এটাও ভাবা যায়? বুয়েটের ছাত্রদের মতো মেধাবীরাও ক্ষত রাজনীতির ছোঁয়ায় সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লেখাতে পারে? ক্ষমতার দাপট মানুষকে কতটা অমানুষ করে দিতে পারে, এমন উদাহরণ দিতে গিয়ে আজ মানুষ ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারণ করে। এটা আর যা-ই হোক, আমরা যাঁরা স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষ, তাঁরা প্রত্যাশা করি না। কামনাও করি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো (যদিও ছাত্রলীগকে তাদের অঙ্গসংগঠন হিসেবে তারা প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দেয় না) যেভাবে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করেছে, তাতে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা বেড়েই চলেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের কি দমিয়ে রাখার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষই নেই? তাদের অভিভাবক দল আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের উসকে দেওয়ার মতো বক্তব্যও শোনা যায় নেতাদের মুখ থেকে। টেন্ডারবাজি করছে ওরা সারা দেশে। এটা ওপেন সিক্রেট। এবং ওদের সহযোগিতা করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই। এই টেন্ডারবাজির মধ্যেই যে ওরা সীমাবদ্ধ নেই, এটা তো পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো থেকেই স্পষ্ট।
তাদের অপকর্মগুলোর জন্য শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদেরও দায় আছে। এ ক্ষেত্রে দলীয় নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন আসতে পারে। ১৯৯৯ সালের ২৫ এপ্রিলের এমনই একটি উক্তির কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বক্তব্য প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, 'আমরা তো শিক্ষাঙ্গনকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে রাখিনি। কিন্তু অন্য দল যখন অস্ত্র নিয়ে আসে, সন্ত্রাস করে, তখন আমাদের ছেলেরা উৎসাহী হয়। তারাও তো তরুণ।' শুধু তা-ই নয়, আরেকবার বলেছেন, 'সন্ত্রাসীরাই অনেক সময় ছাত্রলীগে জোর করে যোগ দেয়। সেটার কী করা যায়?'
এ ধরনের বক্তব্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে উসকে দিতেই পারে।
অথচ এই ছাত্রলীগই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করেছে। এ দেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বোধ জাগিয়ে তুলেছে। গণমানুষের শ্রদ্ধা পেয়ে তাদের সমর্থন নিয়ে বিশাল সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ লাভ করেছে। ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়টি মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে, তার সব ক'টিতেই নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। সেই ছাত্রলীগেরই উত্তরসূরি কি বর্তমান ছাত্রলীগ?
সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদ ভাষ্যমতে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, 'দল যেহেতু ক্ষমতায়, সেহেতু অনেকেই ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এর দায়-দায়িত্ব ছাত্রলীগ নিতে পারে না।' প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেছেন, কুয়েটসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের কমিটি না থাকলেও দোষ পড়েছে তাঁদের ওপর।
কমিটি না থাকলেও সেখানে ছাত্রলীগের কোনো কর্মী-সমর্থক নেই, এটা কিন্তু তিনি বলেননি। আর যাদের নাম এসেছে, তারাও দলের কেউ নয়, এমনটাও বলা হয়নি। সুতরাং ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে কেউ অপকর্ম করে পার পেয়ে যেতে পারে, এটা ভাবা কঠিন বৈকি।
mhussain_71@yahoo.com
তাদের দলীয় নেতা-কর্মীরাই যেখানে নিজেদের নেতা-কর্মীদের হাত থেকে রেহাই পায় না, সেখানে ভিন্ন দলের ছাত্রছাত্রীর অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। ভিন্ন দল কিংবা সাধারণ ছাত্রছাত্রী তাদের হাতে শায়েস্তা হতে হতে এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়ল বলে। শুধু তা-ই নয়, এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নারী নির্যাতনের দুর্নামও পেয়েছে গত দুই দশক ধরে। ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানিক গ্রুপ নামে খ্যাত ছাত্রলীগকর্মীদের হাতে ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। সেই ইতিহাস কিন্তু এখনো মুছে যায়নি। গত বৃহস্পতিবার রাতে সাতক্ষীরা শহরে সোনার ছেলেদের জেলা সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদক মিলে যে কাজটি করেছে, তাতে ছাত্রলীগের ঐতিহ্য ম্লান হয়ে গেছে। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আসা নৃত্যশিল্পীকে ধর্ষণের চেষ্টায় গ্রেপ্তার হওয়া জুয়েল হাসান রাজনীতির অঙ্গনে কিভাবে পরিচিত হবে, জানি না। তবে ছাত্রলীগের ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য এমন জুয়েলদের বেশি প্রয়োজন হয় না।
আর এসব ঐতিহ্যবিরোধী কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হয়েছে মূলত স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকাল থেকে। বিশেষ করে ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত খুনের নায়কের মাধ্যমেই নেতিবাচক ছাত্ররাজনীতির উত্থান বলে মনে করা হয়। সেই খুনি (উচ্চ আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত এবং পরবর্তীকালে সামরিক সরকার কর্তৃক খালাসপ্রাপ্ত; আর এখনো তিনি একটি দলের নেতা হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন) ছাত্রলীগের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির উদ্ভাবক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তাকে গ্রহণ করার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।
শুধু কি সেই খুনিই শেষ কিংবা একমাত্র নেতিবাচক ভূমিকা পালনকারী? হয়তো কোহিনূরসহ সাত খুনের মতো বড় ঘটনা আর কেউ ঘটায়নি। কিন্তু একেক বছর যে পরিমাণ অঘটন এই সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা ঘটিয়েছে, সেগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেসব ঘটনা ১৯৭৩ সালের সেই ঘটনাকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে পিটিয়ে আহত করা, ছুরিকাঘাত করা কিংবা বোমার আঘাত হানার মতো কাজগুলো করতে তাদের মোটেও দ্বিধা হচ্ছে না। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক লাঞ্ছিত করেছে, জাহাঙ্গীরনগরে সহপাঠীদের হত্যা করেছে। শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এবং কুয়েট থেকে শুরু করে বুয়েট, হেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের অপকর্মের ছোঁয়া লাগেনি। সম্প্রতি কুয়েট বন্ধ হয়ে গেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তাণ্ডবের কারণে। বর্তমান সরকারের আমলে এমনি আরো বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অপকর্মের কারণে।
মানুষ যে কতটা অসহিষ্ণু হতে পারে, তার প্রমাণ পেতে হলে বোধ করি ছাত্রলীগের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। সপ্তাহকাল আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ছাত্রলীগকর্মী সিনিয়র শিক্ষার্থী চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ঈষাণকে পিটিয়ে হাত-পা থেঁতলে দিয়েছে। সেই ঘটনার প্রতিবাদে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন করতে দেখা গেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের দুই গুণধর নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
এই গুণধর দুই ছাত্রলীগকর্মী ছাত্ররাজনীতির পরিণতি ভোগ করেছে-এটা বলতে মন সায় দেয় না। কত আশা-ভরসা করে তাদের মা-বাবা বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে নিজেদের সন্তানকে পাঠিয়েছিলেন। ছেলে তাদের ইঞ্জিনিয়ার হবে, নিজের এবং পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে। আর সেই ছেলে কি না বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মাস্তানি করে নিজের এবং পরিবারের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে।
তাদের এই অপকর্ম যে সমাজে কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলছে, তা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও বোঝা সম্ভব হয়েছে। সপ্তাহকাল আগে বুয়েটে এ ঘটনা ঘটার পর বেশ কিছু ফোনকল রিসিভ করতে হয়। সেই ফোনকলগুলো রিসিভ করার পর মনে হয়েছে, ভুক্তভোগীদের আত্মীয়স্বজনের না জানি কী অবস্থা। ফোন যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই কথা-আমার ছেলের কিছু হয়নি তো? সেও পড়ে বুয়েটে। তাঁদের আশঙ্কা, না জানি এমন ছেলেটাও কোনো বিপাকে পড়েছে? এটাও ভাবা যায়? বুয়েটের ছাত্রদের মতো মেধাবীরাও ক্ষত রাজনীতির ছোঁয়ায় সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লেখাতে পারে? ক্ষমতার দাপট মানুষকে কতটা অমানুষ করে দিতে পারে, এমন উদাহরণ দিতে গিয়ে আজ মানুষ ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারণ করে। এটা আর যা-ই হোক, আমরা যাঁরা স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষ, তাঁরা প্রত্যাশা করি না। কামনাও করি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো (যদিও ছাত্রলীগকে তাদের অঙ্গসংগঠন হিসেবে তারা প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দেয় না) যেভাবে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করেছে, তাতে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা বেড়েই চলেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের কি দমিয়ে রাখার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষই নেই? তাদের অভিভাবক দল আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের উসকে দেওয়ার মতো বক্তব্যও শোনা যায় নেতাদের মুখ থেকে। টেন্ডারবাজি করছে ওরা সারা দেশে। এটা ওপেন সিক্রেট। এবং ওদের সহযোগিতা করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই। এই টেন্ডারবাজির মধ্যেই যে ওরা সীমাবদ্ধ নেই, এটা তো পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো থেকেই স্পষ্ট।
তাদের অপকর্মগুলোর জন্য শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদেরও দায় আছে। এ ক্ষেত্রে দলীয় নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন আসতে পারে। ১৯৯৯ সালের ২৫ এপ্রিলের এমনই একটি উক্তির কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বক্তব্য প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, 'আমরা তো শিক্ষাঙ্গনকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে রাখিনি। কিন্তু অন্য দল যখন অস্ত্র নিয়ে আসে, সন্ত্রাস করে, তখন আমাদের ছেলেরা উৎসাহী হয়। তারাও তো তরুণ।' শুধু তা-ই নয়, আরেকবার বলেছেন, 'সন্ত্রাসীরাই অনেক সময় ছাত্রলীগে জোর করে যোগ দেয়। সেটার কী করা যায়?'
এ ধরনের বক্তব্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে উসকে দিতেই পারে।
অথচ এই ছাত্রলীগই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করেছে। এ দেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বোধ জাগিয়ে তুলেছে। গণমানুষের শ্রদ্ধা পেয়ে তাদের সমর্থন নিয়ে বিশাল সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ লাভ করেছে। ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়টি মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে, তার সব ক'টিতেই নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। সেই ছাত্রলীগেরই উত্তরসূরি কি বর্তমান ছাত্রলীগ?
সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদ ভাষ্যমতে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, 'দল যেহেতু ক্ষমতায়, সেহেতু অনেকেই ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এর দায়-দায়িত্ব ছাত্রলীগ নিতে পারে না।' প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেছেন, কুয়েটসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের কমিটি না থাকলেও দোষ পড়েছে তাঁদের ওপর।
কমিটি না থাকলেও সেখানে ছাত্রলীগের কোনো কর্মী-সমর্থক নেই, এটা কিন্তু তিনি বলেননি। আর যাদের নাম এসেছে, তারাও দলের কেউ নয়, এমনটাও বলা হয়নি। সুতরাং ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে কেউ অপকর্ম করে পার পেয়ে যেতে পারে, এটা ভাবা কঠিন বৈকি।
mhussain_71@yahoo.com
No comments