শেয়ারবাজার-অস্বাভাবিক উত্থান অনিবার্য পতন by তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

হাজোট সরকারের তিন বছরের অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির ঘটনা। এবার ক্ষমতারোহণের প্রথম দুই বছর ছিল শেয়ারবাজারের উত্থান পর্ব। পরের এক বছর ছিল পতনকাল। বিশেষ করে ২০১০ সালে বিভিন্ন কম্পানির শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিক উত্থান ২০১১ সালের পতনকে অনিবার্য করে তোলে। ২০১০ সালের শেষ মাসে শুরু হওয়া ধস ২০১১ সালজুড়ে বিদ্যমান থাকে। এ ঘটনায় বছরজুড়েই বিচলিত থাকতে হয়েছে সরকারকে।


গত বছরজুড়ে চলা ধসে শেয়ারবাজার থেকে হারিয়ে গেছে এক লাখ দুই হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন। শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, এই টাকা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সঞ্চিত টাকা। এ সঞ্চয় হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৩৩ লাখ বিও অ্যাকাউন্টধারী বিনিয়োগকারী। এ টাকা কখনো ফিরে আসবে না। অতিমূল্যায়ন ঘটিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি।
উত্থান শুরু : ২০০৮ সালের ৬ জানুয়ারি দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ মূল্য সূচক ছিল ২৯২৯.৩২ পয়েন্ট। লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১১০ কোটি ২৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বাজার মূলধন ছিল ৭৪ হাজার ৪৬২ কোটি ৬২ লাখ ২০ হাজার টাকা।
মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দিন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ডিএসইর সাধারণ মূল্য সূচক ছিল ২৭৫৭.৬৫ পয়েন্ট। লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩৭৮ কোটি ৮৭ লাখ ১২ হাজার টাকা। বাজার মূলধন ছিল এক লাখ চার হাজার ২৯৬ কোটি ৮৮ লাখ ১৭ হাজার টাকা। এই এক বছরের বাজার মূলধন ও লেনদেনের পরিমাণ দুটিই বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সূচক প্রায় একই স্তরে ঘুরাফেরা করে।
বাজারের উত্থানপর্ব শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকেই। পরের বছর ২০১০ সালের ৬ জানুয়ারি বাজারের বিভিন্ন নির্দেশক দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। এদিন ডিএসইর সূচক দাঁড়ায় ৪৭০৭.৮২ পয়েন্ট। এক বছরে সূচক বৃদ্ধি পায় ১৯৫১.১৭ পয়েন্ট। লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে এক হাজার ১৩৫ কোটি ৫৪ লাখ ৩৬ হাজারে পেঁৗছায়। এক বছরে লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ৭৫৬ কোটি ৬৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা। বাজার মূলধন পেঁৗছায় এক লাখ ৯৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৪১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এক বছরে বাজার মূলধন বৃদ্ধি পায় ৯১ হাজার ৯০২ কোটি ৫৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।
২০১০ সালের গোড়ার দিকে শুরু হয় বাজারের অস্বাভাবিক উত্থান। কারসাজির মাধ্যমে বিভিন্ন পক্ষ নানাভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে সৃষ্টি করে বুদবুদ। এই উত্থান চলে ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ৫ ডিসেম্বর ডিএসইতে সর্বোচ্চ সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধনসহ পাঁচটি রেকর্ড হয়। ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সাধারণ মূল্য সূচক দাঁড়ায় ৮৯১৮.৫১ পয়েন্ট। ২০১০ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সূচক বৃদ্ধি পায় ৪২১০.৬৯ পয়েন্ট। এ সময়ে লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ২৪৯ কোটি ৫৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকায়। মোট লেনদেন বৃদ্ধি পায় দুই হাজার ১১৪ কোটি তিন লাখ দুই হাজার টাকা। এই ১১ মাসে বাজার মূলধন বৃদ্ধি পেয়ে পেঁৗছায় তিন লাখ ৬৮ হাজার ৭১ কোটি ৪১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই ১১ মাসে বাজার মূলধন বৃদ্ধি পায় এক লাখ ৭১ হাজার ৮৭২ কোটি ৪১ হাজার টাকা।
ধসের শুরু যেভাবে : ২০১০ সালের শেষ দিকে শেয়ারবাজারে অধিকাংশ শেয়ারের দর অস্বাভাবিক পর্যায়ে উঠেছিল। ফলে যেকোনো সময় বড় ধরনের মূল্য সংশোধনই ছিল এর পরিণতি। ওই অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা দ্রুত মুনাফা তুলে নিয়ে বাজার থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করে। এর সঙ্গে আইনসীমার অতিরিক্ত অর্থ প্রত্যাহারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোরতা, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা শিল্প ঋণের টাকা ফেরতের সময় বেঁধে দেওয়া, ব্যাংকের নগদ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) হার বৃদ্ধি এবং মার্জিন ঋণ সংকোচনের ফলে বাজারে অর্থের প্রবাহে ভাটা পড়ে।
অতি মুনাফার লোভে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ধরে রাখলেও বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বেরিয়ে যাওয়ায় বাজারে অর্থসংকট দেখা দেয়। একদিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে তহবিলের অভাবে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের মার্জিন ঋণ প্রদানের সক্ষমতা কমে যায়। সব মিলিয়ে শেয়ারবাজারে বড় রকমের তারল্য সংকট তৈরি হয়। এর সঙ্গে দরপতনের আতঙ্ক যুক্ত হয়ে শেয়ার বিক্রির চাপ ব্যাপক হারে বাড়লেও এর বিপরীতে কাঙ্ক্ষিত দরে ক্রেতার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ফলে প্রতিদিনই ব্যাপক মাত্রায় কমছে শেয়ারের দর ও বাজার সূচক। সরকারসহ বিভিন্ন মহল থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা পতন ঠেকাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এতে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।
পতনকাল : ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া বিপর্যয়ে এ বছরের ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত সূচকের পতন হয়েছে ৩৫৮৫ পয়েন্ট। ২ জানুয়ারি ডিএসইর সূচক ছিল ৫৩৩৩.৪২ পয়েন্ট। এদিন ডিএসইর লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৫৯৪ কোটি দুই লাখ ৮১ হাজার টাকা। এদিন পর্যন্ত লেনদেনের পরিমাণ কমেছে দুই হাজার ৬৫৫ কোটি ৫৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ২ জানুয়ারি পর্যন্ত বাজার মূলধনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার ৩৭৯ কোটি ৪৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা।
অর্থাৎ এ সময়ে বাজার থেকে মূলধন হারিয়ে গেছে এক লাখ দুই হাজার ৬৯১ কোটি ৯৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এ সময়ের মধ্যে বাজারে আইপিওর মাধ্যমে নতুন আসা কম্পানি এবং পুরনো কম্পানিগুলোর রাইট ও বোনাস শেয়ার যোগ হওয়ার পরও ডিএসইর বাজার মূলধন (তালিকাভুক্ত সব শেয়ারের বাজার মূল্যের যোগফল) এই পরিমাণ কমেছে।
তদন্ত কমিটি : ২০১০ সালের ডিসেম্বরের ভয়াবহ পতনের ঘটনা অনুসন্ধানে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। ২৬ জানুয়ারি গঠিত এ কমিটি ৭ এপ্রিল এক পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় অর্থমন্ত্রীর কাছে। তদন্তে বেরিয়ে আসে অনেক রাঘব বোয়ালের নাম। ৩০ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন।
তদন্ত কমিটির বেশ কিছু সুপারিশ ইতিমধ্যে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনকে (এসইসি) পুনর্গঠন করে। পুনর্গঠিত কমিশন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বুক বিল্ডিং, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, প্লেসমেন্ট সংক্রান্ত কিছু আইন সংশোধন করেছে। কিছু আইন সংশোধনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুনর্গঠিত এসইসি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসইসির একজন কর্মকর্তা ও আইসিবির সাবেক এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করছে। তবে সেসব কম্পানি বা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে আরো তদন্তের সুপারিশ করেছিল যার অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। তবে কারসাজির জন্য কয়েকজনকে দায়ী করে যাদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসিকে সতর্ক থাকতে বলেছিল তদন্ত কমিটি, বাজার পরিস্থিতি উত্তরণের দায়িত্ব তাদের কাছেই চলে যায়। এতে পুঁজিবাজারের প্রতি মানুষের আস্থা আরো কমে যায়।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ
বিপর্যয় কাটিয়ে শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে এসইসি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে গত ১৬ নভেম্বর বাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে সাড়ে চার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে একের পর এক বৈঠক শেষে গত ২৩ নভেম্বর সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ২১ দফার ওই প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এতে ব্যাংকসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রশস্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে বিদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগে উৎসাহী করতে নেওয়া হয়েছে একাধিক পদক্ষেপ। আর শেয়ার ব্যবসায় যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের জন্য প্রত্যক্ষভাবে কিছু সুবিধা দিতে একটি বিশেষ স্কিমেরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.