শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন-পেশা কৃষি আর নেশা পরোপকার by শাহাবুল শাহীন
মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য... ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত এই গানটিই যেন তাঁর মূলমন্ত্র। মানুষের জন্য কাজ করাই তাঁর নেশা। চিকিৎসার জন্য কোনো রোগীর ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন হলেই ডাক পড়ে তাঁর। এই ডাকে সব সময়ই সাড়া দেন তিনি। এর জন্য রোগীর পরিবারের কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সাও নেন না। যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার জন্য কিছু নিলেও অনেকের ক্ষেত্রে সেটাও ছেড়ে দেন। রোগী ও তার স্বজনেরা সেখানে যত দিন থাকে, তিনিও তত দিন
থাকেন। তারপর একসঙ্গে দেশে ফেরেন। পেশায় কৃষক, নেশায় পরোপকারী এই ব্যক্তি হলেন সবার প্রিয় হজরত ভাই। পুরো নাম হজরত আলী। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোলঘড়িয়া গ্রামের হজরত আলী প্রায় ২৭ বছর ধরে গাইবান্ধা, বগুড়া, নাটোর, নওগাঁসহ অনেক এলাকার রোগী নিয়ে ভারতে গেছেন।
তাঁর হিসাবমতে, এ পর্যন্ত অন্তত সাড়ে চার শ রোগী ভারতে নিয়ে গেছেন। এর জন্য তাঁকে কমপক্ষে ২০৭ বার ভারতে যেতে হয়েছে।
যেভাবে শুরু: ২০-২২ বছর বয়সে হজরত আলী পিঠ ও ঘাড়ের ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। চিকিৎসকেরা জানান, সুস্থ হতে ছয় মাস সময় লাগবে। পরে যান ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানেও চিকিৎসক একই কথা বলেন। ১৯৮৪ সালে চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাইয়ে অবস্থিত একটি হাসপাতালে যান তিনি। সেখানে মাত্র ১৬ দিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। হজরত আলীর ভারত থেকে সুস্থ হয়ে আসার খবর ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৮৫ সালের কথা। লোকমুখে জানতে পেরে হজরত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন নওগাঁ জেলার কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল হক। তাঁর মেয়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্রী, অসুস্থ। তিনি হজরত আলীকে অনুরোধ করেন তাঁদের সঙ্গে ভারতে যাওয়ার জন্য। আমিনুল হকের অনুরোধ ফেলতে পারেননি হজরত আলী। আমিনুল ও তাঁর মেয়েকে নিয়ে চেন্নাই যান তিনি। চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন আমিনুলের মেয়ে।
এভাবেই রোগী নিয়ে ভারতে যাওয়া শুরু হজরত আলীর। হজরত আলী বলেন, ‘একজনের অনুরোধে ভারতে গিয়ে ফিরে এলাম। এরপর আরেকজন অনুরোধ নিয়ে আসেন। তারপর আরেকজন। প্রথম দিকে মনে হতো, এবার ফিরলে আর যাব না। কিন্তু রোগীর বর্ণনা শুনে কাউকে না বলতে পারিনি।’
উপকারভোগীদের কথা: গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চরপাড়া গ্রামের শফিউল আজম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দীর্ঘদিন মাথাব্যথায় ভুগে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। লোকমুখে জানতে পেরে হজরত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। শফিউলের বাবা জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘হজরত ভাইয়ের কাছে সাহস পেয়ে ছেলেকে নিয়ে ভারতে যাই। ছেলে এখন সুস্থ হয়ে চাকরি করছে।’
জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘২০১০ সালে হজরত ভাইয়ের সঙ্গে ছেলেকে নিয়ে ভারতে গিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে চেন্নাই পর্যন্ত অনেক রেলস্টেশনের কর্মকর্তা, সিএনজিচালিত অটোরিকশার অনেক চালক, হাসপাতালের সেবিকা, ওয়ার্ডবয় ও চিকিৎসকেরাও হজরত ভাইকে চেনেন। এমনকি হাসপাতালের আশপাশের ওষুধ ও বিভিন্ন পণ্যের দোকানিরা পর্যন্ত তাঁকে ‘বাংলাদেশের হুজুর’ বলে চেনেন।’ জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘তাঁর পরিচিতি দেখে অবাক হয়েছি। প্রথমে ভাবতাম, তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সুবিধা নিয়ে এসব করেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কোনো সুবিধা নেন না। আসলে পরোপকার করা তাঁর নেশা।’
১৯৯৫ সালে বগুড়া শহরের কলোনিপাড়ার রিকশাচালক আশরাফ আলীর ছেলে রাজিব মিয়ার হূৎপিণ্ডে সমস্যা দেখা দেয়। রাজিব তখন বগুড়া পুলিশ লাইন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। তৎকালীন বগুড়া জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ৫৪ হাজার টাকা অনুদান সংগ্রহ করে রাজিবের বাবাকে দেন। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের অনুরোধে হজরত আলী কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল হকের সঙ্গে রাজিবকে ভারতে নিয়ে যান। চিকিৎসার পর রাজিব সুস্থ হয়ে ওঠে। ছেলের সুস্থ হওয়ার পেছনে হজরত আলীর অবদানের কথা স্মরণ করে মা রেহেনা খাতুন বলেন, ‘হজরত ভাইয়ের উপকারের কথা কখনো ভুলব না। তিনি যাতায়াত খরচের জন্যও কোনো টাকা নেননি।’
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার চাকরিজীবী নূর ইসলাম বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য হজরত ভাইয়ের সঙ্গে দুই দফা ভারতে গিয়েছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও ট্রেনের ভাড়ার বাইরে কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারিনি।’
ভরসার নাম হজরত ভাই: রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্লাড ক্যানসার, মস্তিষ্কে টিউমার, কিডনির জটিলতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত রোগীকে সাধারণত ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। হজরত আলী সব সময় রোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গেই থেকে তাদের সাহস জোগান। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ—সবকিছুই তিনি করে থাকেন। অনেক সময় রোগী ও তার স্বজনদের খাওয়ার জন্য বাজার করা, এমনকি রান্নার কাজটিও করে দেন। একজন রোগীকে সুস্থ করে দেশে ফেরার পর আবার অন্যজনকে নিয়ে ছুটতে হয়।
একজন রোগীকে সুস্থ করে দেশে আনার পর দায়িত্ব শেষ করেন না হজরত আলী। সব সময় তাদের খোঁজ নেন। ভারত থেকে ফিরে আসা অনেকেই তাঁকে আবার ছয় মাস থেকে এক বছরের ওষুধ আনার জন্য টাকা দেন। অনেক রোগীর ফলোআপ রিপোর্ট চিকিৎসকদের জানিয়ে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে সে অনুযায়ী ওষুধ আনেন। এক কথায়, সবার কাছে যেন এক ভরসার নাম হজরত ভাই।
হজরত আলী ঘন ঘন ভারতে যাওয়ায় পাসপোর্ট বইয়ের পাতা দ্রুত শেষ হয়ে যায়। প্রথম ভারতে যাওয়ার পর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ২০ বার পাসপোর্ট বই করেছেন তিনি। রোগীর সাহায্যকারী হিসেবে ভিসা দেওয়া হয় তাঁকে। ঘন ঘন ভারতে যাওয়ার কারণে রাজশাহী ও ঢাকা পাসপোর্ট কার্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীই তাঁর পরিচিত। তাই পাসপোর্ট-ভিসা পেতে কোনো সমস্যা হয় না।
কী বলেন হজরত আলী: ‘এটা আমার নেশা। কেউ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলে তার মুখ দেখে মন ভরে যায়। তাই কষ্ট হলেও কাজ করে যাচ্ছি।’ বলছিলেন বয়সে ষাটের কোটায় থাকা হজরত আলী। তিনি বলেন, প্রথমে পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। সবাই যখন দেখল এটা আমার নেশা, তখন সবাই উৎসাহ দিচ্ছে। হজরত আলী বলেন, ‘আমি আর্থিকভাবে সচ্ছল। তাই এসব কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
আপনার চাওয়া কী—জানতে চাইলে হজরত আলীর উত্তর, ‘আমার চাওয়ার কিছু নেই। শুধু বলি, মৃত্যুর পর আমার জানাজায় শরিক হয়ে দোয়া করবেন।’ তিনি বলেন, ‘যত দিন বেঁচে থাকব, এভাবেই মানুষের সেবা করে যাব।’
পরিবারের কথা: এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক হজরত আলী। প্রায় ৭০ বিঘা পৈতৃক সম্পত্তির মালিক তিনি। কৃষিই মূল পেশা। তবে সেই দায়িত্ব পালন করেন ছেলে সেলিম রেজা। স্ত্রী শেফালী বেগম গৃহিণী।
স্বামীর এই পরোপকারের নেশা প্রসঙ্গে শেফালী বলেন, ‘প্রথমে তাঁর এই কাজে বিরক্ত হতাম। এখন ভালো লাগে। যখন দেখি তাঁর মাধ্যমে অনেকে উন্নত চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে, তখন আনন্দে বুক ভরে যায়।’ বাবার এই কাজে গর্বিত সেলিমও। ‘হাটবাজার, শহর-বন্দরে যখন অপরিচিত লোকজন বাবার কাজের প্রশংসা করেন, তখন গর্ব হয়। তাই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বাবাকে তাঁর কাজে উৎসাহ দেই।’ বলেন সেলিম।
স্থানীয় বিশালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহজাহান আলী বলেন, ‘হজরত আলী মানুষের বিপদের সময় যা করছেন, আমরা জনপ্রতিনিধি হয়েও তা করতে পারছি না। তিনি আমাদের এলাকার গর্ব।’
তাঁর হিসাবমতে, এ পর্যন্ত অন্তত সাড়ে চার শ রোগী ভারতে নিয়ে গেছেন। এর জন্য তাঁকে কমপক্ষে ২০৭ বার ভারতে যেতে হয়েছে।
যেভাবে শুরু: ২০-২২ বছর বয়সে হজরত আলী পিঠ ও ঘাড়ের ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। চিকিৎসকেরা জানান, সুস্থ হতে ছয় মাস সময় লাগবে। পরে যান ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানেও চিকিৎসক একই কথা বলেন। ১৯৮৪ সালে চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাইয়ে অবস্থিত একটি হাসপাতালে যান তিনি। সেখানে মাত্র ১৬ দিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। হজরত আলীর ভারত থেকে সুস্থ হয়ে আসার খবর ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৮৫ সালের কথা। লোকমুখে জানতে পেরে হজরত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন নওগাঁ জেলার কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল হক। তাঁর মেয়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্রী, অসুস্থ। তিনি হজরত আলীকে অনুরোধ করেন তাঁদের সঙ্গে ভারতে যাওয়ার জন্য। আমিনুল হকের অনুরোধ ফেলতে পারেননি হজরত আলী। আমিনুল ও তাঁর মেয়েকে নিয়ে চেন্নাই যান তিনি। চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন আমিনুলের মেয়ে।
এভাবেই রোগী নিয়ে ভারতে যাওয়া শুরু হজরত আলীর। হজরত আলী বলেন, ‘একজনের অনুরোধে ভারতে গিয়ে ফিরে এলাম। এরপর আরেকজন অনুরোধ নিয়ে আসেন। তারপর আরেকজন। প্রথম দিকে মনে হতো, এবার ফিরলে আর যাব না। কিন্তু রোগীর বর্ণনা শুনে কাউকে না বলতে পারিনি।’
উপকারভোগীদের কথা: গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চরপাড়া গ্রামের শফিউল আজম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দীর্ঘদিন মাথাব্যথায় ভুগে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। লোকমুখে জানতে পেরে হজরত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। শফিউলের বাবা জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘হজরত ভাইয়ের কাছে সাহস পেয়ে ছেলেকে নিয়ে ভারতে যাই। ছেলে এখন সুস্থ হয়ে চাকরি করছে।’
জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘২০১০ সালে হজরত ভাইয়ের সঙ্গে ছেলেকে নিয়ে ভারতে গিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে চেন্নাই পর্যন্ত অনেক রেলস্টেশনের কর্মকর্তা, সিএনজিচালিত অটোরিকশার অনেক চালক, হাসপাতালের সেবিকা, ওয়ার্ডবয় ও চিকিৎসকেরাও হজরত ভাইকে চেনেন। এমনকি হাসপাতালের আশপাশের ওষুধ ও বিভিন্ন পণ্যের দোকানিরা পর্যন্ত তাঁকে ‘বাংলাদেশের হুজুর’ বলে চেনেন।’ জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘তাঁর পরিচিতি দেখে অবাক হয়েছি। প্রথমে ভাবতাম, তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সুবিধা নিয়ে এসব করেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কোনো সুবিধা নেন না। আসলে পরোপকার করা তাঁর নেশা।’
১৯৯৫ সালে বগুড়া শহরের কলোনিপাড়ার রিকশাচালক আশরাফ আলীর ছেলে রাজিব মিয়ার হূৎপিণ্ডে সমস্যা দেখা দেয়। রাজিব তখন বগুড়া পুলিশ লাইন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। তৎকালীন বগুড়া জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ৫৪ হাজার টাকা অনুদান সংগ্রহ করে রাজিবের বাবাকে দেন। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের অনুরোধে হজরত আলী কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল হকের সঙ্গে রাজিবকে ভারতে নিয়ে যান। চিকিৎসার পর রাজিব সুস্থ হয়ে ওঠে। ছেলের সুস্থ হওয়ার পেছনে হজরত আলীর অবদানের কথা স্মরণ করে মা রেহেনা খাতুন বলেন, ‘হজরত ভাইয়ের উপকারের কথা কখনো ভুলব না। তিনি যাতায়াত খরচের জন্যও কোনো টাকা নেননি।’
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার চাকরিজীবী নূর ইসলাম বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য হজরত ভাইয়ের সঙ্গে দুই দফা ভারতে গিয়েছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও ট্রেনের ভাড়ার বাইরে কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারিনি।’
ভরসার নাম হজরত ভাই: রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্লাড ক্যানসার, মস্তিষ্কে টিউমার, কিডনির জটিলতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত রোগীকে সাধারণত ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। হজরত আলী সব সময় রোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গেই থেকে তাদের সাহস জোগান। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ—সবকিছুই তিনি করে থাকেন। অনেক সময় রোগী ও তার স্বজনদের খাওয়ার জন্য বাজার করা, এমনকি রান্নার কাজটিও করে দেন। একজন রোগীকে সুস্থ করে দেশে ফেরার পর আবার অন্যজনকে নিয়ে ছুটতে হয়।
একজন রোগীকে সুস্থ করে দেশে আনার পর দায়িত্ব শেষ করেন না হজরত আলী। সব সময় তাদের খোঁজ নেন। ভারত থেকে ফিরে আসা অনেকেই তাঁকে আবার ছয় মাস থেকে এক বছরের ওষুধ আনার জন্য টাকা দেন। অনেক রোগীর ফলোআপ রিপোর্ট চিকিৎসকদের জানিয়ে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে সে অনুযায়ী ওষুধ আনেন। এক কথায়, সবার কাছে যেন এক ভরসার নাম হজরত ভাই।
হজরত আলী ঘন ঘন ভারতে যাওয়ায় পাসপোর্ট বইয়ের পাতা দ্রুত শেষ হয়ে যায়। প্রথম ভারতে যাওয়ার পর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ২০ বার পাসপোর্ট বই করেছেন তিনি। রোগীর সাহায্যকারী হিসেবে ভিসা দেওয়া হয় তাঁকে। ঘন ঘন ভারতে যাওয়ার কারণে রাজশাহী ও ঢাকা পাসপোর্ট কার্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীই তাঁর পরিচিত। তাই পাসপোর্ট-ভিসা পেতে কোনো সমস্যা হয় না।
কী বলেন হজরত আলী: ‘এটা আমার নেশা। কেউ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলে তার মুখ দেখে মন ভরে যায়। তাই কষ্ট হলেও কাজ করে যাচ্ছি।’ বলছিলেন বয়সে ষাটের কোটায় থাকা হজরত আলী। তিনি বলেন, প্রথমে পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। সবাই যখন দেখল এটা আমার নেশা, তখন সবাই উৎসাহ দিচ্ছে। হজরত আলী বলেন, ‘আমি আর্থিকভাবে সচ্ছল। তাই এসব কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
আপনার চাওয়া কী—জানতে চাইলে হজরত আলীর উত্তর, ‘আমার চাওয়ার কিছু নেই। শুধু বলি, মৃত্যুর পর আমার জানাজায় শরিক হয়ে দোয়া করবেন।’ তিনি বলেন, ‘যত দিন বেঁচে থাকব, এভাবেই মানুষের সেবা করে যাব।’
পরিবারের কথা: এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক হজরত আলী। প্রায় ৭০ বিঘা পৈতৃক সম্পত্তির মালিক তিনি। কৃষিই মূল পেশা। তবে সেই দায়িত্ব পালন করেন ছেলে সেলিম রেজা। স্ত্রী শেফালী বেগম গৃহিণী।
স্বামীর এই পরোপকারের নেশা প্রসঙ্গে শেফালী বলেন, ‘প্রথমে তাঁর এই কাজে বিরক্ত হতাম। এখন ভালো লাগে। যখন দেখি তাঁর মাধ্যমে অনেকে উন্নত চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে, তখন আনন্দে বুক ভরে যায়।’ বাবার এই কাজে গর্বিত সেলিমও। ‘হাটবাজার, শহর-বন্দরে যখন অপরিচিত লোকজন বাবার কাজের প্রশংসা করেন, তখন গর্ব হয়। তাই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বাবাকে তাঁর কাজে উৎসাহ দেই।’ বলেন সেলিম।
স্থানীয় বিশালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহজাহান আলী বলেন, ‘হজরত আলী মানুষের বিপদের সময় যা করছেন, আমরা জনপ্রতিনিধি হয়েও তা করতে পারছি না। তিনি আমাদের এলাকার গর্ব।’
No comments