পররাষ্ট্রনীতি-ঘাটতি আছে দক্ষতা ও সমন্বয়ের by এম হুমায়ূন কবির
মহাজোট সরকার যখন তিন বছর পূর্ণ করছে, তখন সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, গত তিন বছরে সরকার কেমন পররাষ্ট্র সম্পর্ক পরিচালনা করেছে। এতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতখানি সমুন্নত ছিল অথবা তা কতখানিই বা এগোল। মূল্যায়নের জন্য তিন বছর খুব একটা লম্বা সময় না হলেও খুব একটা কম সময়, তা-ও বলা যাবে না। তিনটি মানদণ্ডের নিরিখে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। প্রথমত, মহাজোটের প্রধান শরিক
আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদে পররাষ্ট্রনীতির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার আলোকে বিচার করলে গত তিন বছরে ফল ইতিবাচক বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, কূটনীতির সনাতনী মানদণ্ডে, যার মধ্যে রয়েছে সব পর্যায়ের সফর বিনিময়, চুক্তি স্বাক্ষরসহ দৈনন্দিন যোগাযোগ, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্ক গত তিন বছরে নাড়াচাড়া প্রত্যক্ষ করেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। প্রচুর সফর বিনিময় হয়েছে, অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, কিছু কিছু নতুন উদ্যোগও পরিলক্ষিত হয়েছে। তার ভিত্তিতেও বাংলাদেশের অর্জনকে ইতিবাচক বলা যেতে পারে। তৃতীয়ত, কূটনীতির গতিশীল জগতে বিশেষত, বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে একটি ভিন্ন চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে।
২০০৮ সালের নির্বাচন শুধু গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য ছিল না, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের অনেক অবয়ব, অনেক ইঙ্গিত এবং অনেক প্রত্যাশা। একটি সুশাসিত গণতান্ত্রিক, আত্মপ্রত্যয়ী ও ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল। বিশ্ব সম্প্রদায়ের মানুষও সে স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সরব অংশীদার ছিল। সে প্রেক্ষাপট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদ্ভাব ও আস্থাকে পুঁজি করে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করে। এখন বলতে দ্বিধা নেই, বিভিন্ন কারণে আস্থার সে জোর যেন এখন আর নেই। অনেকে মনে করেন, একমাত্রিক পররাষ্ট্র সম্পর্ক পরিচালনা করে নতুন বন্ধুত্ব গড়ে তোলা গেলেও পরীক্ষিত বন্ধুদের ক্ষেত্রে আস্থার সম্পর্ককে সুদৃঢ় করা যায়নি। শুরু ভালো হলেও কেন জানি আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্ক হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়িয়েছে।
তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে গত তিন বছরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে অন্তত একটি ইতিবাচক দিক যোগ হয়েছে। বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থানের যে শঙ্কা বিশ্বপরিমণ্ডলে তৈরি হয়েছিল, বাংলাদেশ সে নেতিবাচক ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে। বর্তমান সরকারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী নীতিমালা বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে এ বিষয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা গেলে এ প্রক্রিয়া টেকসই হতে পারত বলেও অনেকে মনে করেন। তবে একই সঙ্গে বলা দরকার, জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচেষ্টার সাফল্য এবং ভাবমূর্তির ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়লেও নতুন করে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে আমাদের জন্য। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গৃহীত কিছু কিছু উদ্যোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রয়াসের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে।
প্রবণতার দিক থেকে বিচার করলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কে প্রধান উপাদান। ভারতের বিশ্বাস অর্জন করার লক্ষ্যে সরকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। এ ধরনের উদ্যোগ পারস্পরিক বিশ্বাসকে একটি নতুন স্তরে উত্তীর্ণ করে, যা পরবর্তী সময়ে সম্পর্কের অন্য দিকগুলোতেও ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময়ে বাংলাদেশ অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই ভারতকে ট্রানজিট সুবিধাসহ চট্টগ্রাম ও মঙ্গলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগদানে স্বীকৃত হয়। এ ছাড়া যৌথভাবে সন্ত্রাস দমনে, যৌথ নদীর বিশেষ করে, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ অনেক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের উদার মনোভাব সম্পর্কে যেমন গতিসঞ্চার করে, তেমনি প্রত্যাশার মাত্রাকেও উঁচু পর্যায়ে নিয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় স্থল সীমানা নির্ধারণে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার লক্ষ্যে প্রটোকল ও দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কাঠামোগত চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আটটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়। তবে তিস্তার পানি বণ্টন, ভারতের পক্ষে ট্রানজিট প্রটোকল, বিদ্যুৎ রপ্তানির চুক্তি ও প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে তা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। পরবর্তী সময়ে মণিপুর রাজ্য কর্তৃক টিপাইমুখে বরাক নদের ওপর বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ এবং আশুগঞ্জ-আখাউড়া পথে নৌপরিবহন চুক্তির আওতায় ভারতীয় পণ্য চলাচল নিয়ে জনমনে গভীর অসন্তোষ তৈরি হয়। পরীক্ষামূলক ট্রানজিটদানের বিষয়টি এতে জটিলতা আরও বাড়িয়ে তোলে। এখন অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন, ভারতের দিক থেকে বাড়তি উদ্যোগ না এলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঝুলে যেতে পারে।
অন্য প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। দীর্ঘ আট বছর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে মিয়ানমার সফর করেন এবং এতে করে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। নিকট প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চলমান রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এ সরকারের সময়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জোরালো সমর্থক ও বড় বাণিজ্য অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে মিঠে-কড়া অবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় থাকলেও রাজনৈতিক পর্যায়ে সম্পর্কে খানিকটা ধীরগতি লক্ষণীয়। আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতাবস্থার মধ্যে রয়েছে। যদিও বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থের উৎস হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো এখনো আমাদের প্রধান সূত্র। অসাধারণ গতিশীল কূটনীতি ছাড়া এ সম্পর্কে গতি আনা কষ্টকর বলে অনেকে মনে করেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ধারাবাহিকতা কতটা বজায় থাকছে তা নিয়ে কথা হতে পারে। বস্তুত, যেকোনো দেশের পররাষ্ট্র সম্পর্ক একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, কারণ জাতীয় স্বার্থের বিষয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই অপেক্ষাকৃত কম পরিবর্তনশীল। গত তিন বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কে অনেকগুলো বিষয়ে ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে নতুন সম্পর্ক অনুসন্ধান করা হয়েছে। ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ অন্যান্য অনেক আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের প্রতি বাংলাদেশ অনুগত থেকেছে, জাতিসংঘের শান্তি মিশনে আমাদের অবদান অব্যাহত রয়েছে। জলবায়ু সমস্যা, অর্থনৈতিক বিষয়াবলিসহ আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়েই আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক প্রক্রিয়ার প্রতিও বাংলাদেশ সক্রিয় থেকেছে, এমনকি নতুন ধারণা নিয়ে এ প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করতেও সচেষ্ট থেকেছে। যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে, তাদের সঙ্গেও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থেকেছে। তবে নতুন উপাদান ঢুকে পড়ে সম্পর্কের বিবর্তনকে যে প্রভাবান্বিত করেনি তা বলা যাবে না। যেমন সার্ক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাকে জোরালোভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। একইভাবে ক্ষেত্রবিশেষে বাংলাদেশ দর-কষাকষির ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ছাড় দিয়ে সম্পর্ককে নতুন মোড় দিতে সচেষ্টও থেকেছে, যদিও এ ধরনের অবস্থানের ফলাফল দেখতে খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়, যা প্রতিষ্ঠিত ধারণা ও কার্যপ্রণালি থেকে ভিন্ন। বস্তুত, গত তিন বছরে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং দুই ক্ষেত্রেই যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখানো যায়নি। অনেকগুলো বিষয় এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য। প্রথমত, নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরাসরি সম্পৃক্ততা ও সমর্থন ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করলেও নীতি প্রণয়নে তা অতিকেন্দ্রিকতার জন্মও দিয়েছে। এতে করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সব অংশীদারের অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে, যা এ প্রক্রিয়াকে যথাযথ শক্তিশালী হতে সাহায্য করেনি। দ্বিতীয় নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভাবাবেগের প্রবল উপস্থিতি আন্তরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানকে বাস্তব অবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে দেওয়া-নেওয়ার ভারসাম্য রক্ষা করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। তৃতীয়ত, এ ধরনের অবস্থার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর। বহিঃসম্পর্ক পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ চাপের মধ্যে পড়েছে। ফলে পররাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের নীতি সমন্বয় প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা। মন্ত্রণালয়ের কাজের ধারা বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে দূতাবাসগুলোর দক্ষতাও কমেছে, যা ইতিমধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় প্রতীয়মান হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বের উদাসীনতা ও পেশাদারির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্র সম্পর্কের স্বার্থে এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার এবং তা করা প্রয়োজন দ্রুত!
এম হুমায়ূন কবির: সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব।
২০০৮ সালের নির্বাচন শুধু গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য ছিল না, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের অনেক অবয়ব, অনেক ইঙ্গিত এবং অনেক প্রত্যাশা। একটি সুশাসিত গণতান্ত্রিক, আত্মপ্রত্যয়ী ও ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল। বিশ্ব সম্প্রদায়ের মানুষও সে স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সরব অংশীদার ছিল। সে প্রেক্ষাপট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদ্ভাব ও আস্থাকে পুঁজি করে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করে। এখন বলতে দ্বিধা নেই, বিভিন্ন কারণে আস্থার সে জোর যেন এখন আর নেই। অনেকে মনে করেন, একমাত্রিক পররাষ্ট্র সম্পর্ক পরিচালনা করে নতুন বন্ধুত্ব গড়ে তোলা গেলেও পরীক্ষিত বন্ধুদের ক্ষেত্রে আস্থার সম্পর্ককে সুদৃঢ় করা যায়নি। শুরু ভালো হলেও কেন জানি আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্ক হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়িয়েছে।
তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে গত তিন বছরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে অন্তত একটি ইতিবাচক দিক যোগ হয়েছে। বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থানের যে শঙ্কা বিশ্বপরিমণ্ডলে তৈরি হয়েছিল, বাংলাদেশ সে নেতিবাচক ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে। বর্তমান সরকারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী নীতিমালা বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে এ বিষয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা গেলে এ প্রক্রিয়া টেকসই হতে পারত বলেও অনেকে মনে করেন। তবে একই সঙ্গে বলা দরকার, জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচেষ্টার সাফল্য এবং ভাবমূর্তির ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়লেও নতুন করে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে আমাদের জন্য। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গৃহীত কিছু কিছু উদ্যোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রয়াসের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে।
প্রবণতার দিক থেকে বিচার করলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কে প্রধান উপাদান। ভারতের বিশ্বাস অর্জন করার লক্ষ্যে সরকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। এ ধরনের উদ্যোগ পারস্পরিক বিশ্বাসকে একটি নতুন স্তরে উত্তীর্ণ করে, যা পরবর্তী সময়ে সম্পর্কের অন্য দিকগুলোতেও ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময়ে বাংলাদেশ অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই ভারতকে ট্রানজিট সুবিধাসহ চট্টগ্রাম ও মঙ্গলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগদানে স্বীকৃত হয়। এ ছাড়া যৌথভাবে সন্ত্রাস দমনে, যৌথ নদীর বিশেষ করে, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ অনেক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের উদার মনোভাব সম্পর্কে যেমন গতিসঞ্চার করে, তেমনি প্রত্যাশার মাত্রাকেও উঁচু পর্যায়ে নিয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় স্থল সীমানা নির্ধারণে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার লক্ষ্যে প্রটোকল ও দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কাঠামোগত চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আটটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়। তবে তিস্তার পানি বণ্টন, ভারতের পক্ষে ট্রানজিট প্রটোকল, বিদ্যুৎ রপ্তানির চুক্তি ও প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে তা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। পরবর্তী সময়ে মণিপুর রাজ্য কর্তৃক টিপাইমুখে বরাক নদের ওপর বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ এবং আশুগঞ্জ-আখাউড়া পথে নৌপরিবহন চুক্তির আওতায় ভারতীয় পণ্য চলাচল নিয়ে জনমনে গভীর অসন্তোষ তৈরি হয়। পরীক্ষামূলক ট্রানজিটদানের বিষয়টি এতে জটিলতা আরও বাড়িয়ে তোলে। এখন অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন, ভারতের দিক থেকে বাড়তি উদ্যোগ না এলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঝুলে যেতে পারে।
অন্য প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। দীর্ঘ আট বছর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে মিয়ানমার সফর করেন এবং এতে করে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। নিকট প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চলমান রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এ সরকারের সময়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জোরালো সমর্থক ও বড় বাণিজ্য অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে মিঠে-কড়া অবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় থাকলেও রাজনৈতিক পর্যায়ে সম্পর্কে খানিকটা ধীরগতি লক্ষণীয়। আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতাবস্থার মধ্যে রয়েছে। যদিও বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থের উৎস হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো এখনো আমাদের প্রধান সূত্র। অসাধারণ গতিশীল কূটনীতি ছাড়া এ সম্পর্কে গতি আনা কষ্টকর বলে অনেকে মনে করেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ধারাবাহিকতা কতটা বজায় থাকছে তা নিয়ে কথা হতে পারে। বস্তুত, যেকোনো দেশের পররাষ্ট্র সম্পর্ক একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, কারণ জাতীয় স্বার্থের বিষয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই অপেক্ষাকৃত কম পরিবর্তনশীল। গত তিন বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কে অনেকগুলো বিষয়ে ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে নতুন সম্পর্ক অনুসন্ধান করা হয়েছে। ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ অন্যান্য অনেক আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের প্রতি বাংলাদেশ অনুগত থেকেছে, জাতিসংঘের শান্তি মিশনে আমাদের অবদান অব্যাহত রয়েছে। জলবায়ু সমস্যা, অর্থনৈতিক বিষয়াবলিসহ আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়েই আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক প্রক্রিয়ার প্রতিও বাংলাদেশ সক্রিয় থেকেছে, এমনকি নতুন ধারণা নিয়ে এ প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করতেও সচেষ্ট থেকেছে। যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে, তাদের সঙ্গেও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থেকেছে। তবে নতুন উপাদান ঢুকে পড়ে সম্পর্কের বিবর্তনকে যে প্রভাবান্বিত করেনি তা বলা যাবে না। যেমন সার্ক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাকে জোরালোভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। একইভাবে ক্ষেত্রবিশেষে বাংলাদেশ দর-কষাকষির ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ছাড় দিয়ে সম্পর্ককে নতুন মোড় দিতে সচেষ্টও থেকেছে, যদিও এ ধরনের অবস্থানের ফলাফল দেখতে খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়, যা প্রতিষ্ঠিত ধারণা ও কার্যপ্রণালি থেকে ভিন্ন। বস্তুত, গত তিন বছরে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং দুই ক্ষেত্রেই যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখানো যায়নি। অনেকগুলো বিষয় এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য। প্রথমত, নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরাসরি সম্পৃক্ততা ও সমর্থন ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করলেও নীতি প্রণয়নে তা অতিকেন্দ্রিকতার জন্মও দিয়েছে। এতে করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সব অংশীদারের অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে, যা এ প্রক্রিয়াকে যথাযথ শক্তিশালী হতে সাহায্য করেনি। দ্বিতীয় নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভাবাবেগের প্রবল উপস্থিতি আন্তরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানকে বাস্তব অবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে দেওয়া-নেওয়ার ভারসাম্য রক্ষা করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। তৃতীয়ত, এ ধরনের অবস্থার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর। বহিঃসম্পর্ক পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ চাপের মধ্যে পড়েছে। ফলে পররাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের নীতি সমন্বয় প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা। মন্ত্রণালয়ের কাজের ধারা বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে দূতাবাসগুলোর দক্ষতাও কমেছে, যা ইতিমধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় প্রতীয়মান হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বের উদাসীনতা ও পেশাদারির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্র সম্পর্কের স্বার্থে এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার এবং তা করা প্রয়োজন দ্রুত!
এম হুমায়ূন কবির: সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব।
No comments