মত ও মন্তব্য-হাজার কণ্ঠে অসামান্য রবীন্দ্রনাথ by হারুন হাবীব

মৃত্যুর প্রায় ৭০ বছর পরও রবীন্দ্রনাথ বাংলা ও বাঙালির কাছে অভাবনীয়ভাবে প্রাসঙ্গিক। বাঙালির যে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, তার বহুলাংশ জুড়েই আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির এই ধীমান পুরুষ তাঁর বাণী ও সুরে বাঙালিকে যেমন আশ্রয় দিয়েছেন, মহৎ করেছেন; একই সঙ্গে দুর্দিনে রুখে দাঁড়ানোর অমিত প্রেরণা জুগিয়েছেন। সে কারণেই বাঙালি তার প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি সংশয়ে ঠাঁই নেয় সেই রবীন্দ্রনাথের কাছে, যাঁর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো ২০১১
সালে। কবিগুরুর বাণী ও সুর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হৃদয় স্পর্শ করে বুলিয়ে দেয় শান্তির পরশ, যা আস্বাদনে আমরা তাঁর কাছেই সমর্পিত হই, প্রার্থনায় নতজানু হই। ২৯-৩১ ডিসেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সহস্রকণ্ঠে ধ্বনিত রবীন্দ্রনাথের গান ও অসামান্য সৃষ্টিমালা বাংলাদেশকে যেন নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছে। মনে করিয়ে দিয়েছে অনন্ত অসীমের সেই রবীন্দ্রনাথ, যিনি আমাদের প্রতিদিনের, প্রাণের ও কাছের মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে আরো বেশি করে চেনার, আরো বেশি করে ভালোবাসার এই অভিনব সুযোগ সৃষ্টি করায় আমার প্রিয় শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও তাঁর 'সুরের ধারা'কে অসংখ্য ধন্যবাদ।
রবিঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনে বাংলাদেশ ও ভারতে বছরব্যাপী অনুষ্ঠান হয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো কবির ভাগ্যে এ রকম সীমান্ত ভেদ করা ভালোবাসার কোরাস জুটেছিল কি না আমার জানা নেই। এগুলোর কয়েকটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। কিন্তু 'সুরের ধারা'র বছর শেষের অনন্য 'রবীন্দ্র উৎসব' যেন সব আয়োজন ছাড়িয়ে দিয়েছে। তিন দিনের এ সুবৃহৎ আয়োজনে রবীন্দ্রনাথ যেন ভিন্নভাবে, আরো একান্ত হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছেন, গানের ও মনের রবীন্দ্রনাথ সাধারণের আত্মায় এবং চেতনায় আরো দীপ্যমান হয়েছেন। একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ এভাবে রবীন্দ্রনাথকে সর্বসাধারণের কাছে, তাঁর সর্বাঙ্গীন মহিমায় তুলে ধরবে-যাঁরা এ উৎসবে গেছেন, গান শুনেছেন, নাচ ও নাটক দেখেছেন, আবৃত্তি শুনেছেন এবং টেলিভিশনের পর্দায় সাগ্রহে চোখ রেখেছেন-কেবল তাঁরাই অনুধাবন করতে পারবেন। আগেই বলেছি, এ আয়োজন সরকারি নয়, ব্যক্তিপর্যায়ের; যা রবীন্দ্রনাথকে ছড়িয়ে দিয়েছে নতুন মাত্রায়। উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্রের পরিচালনা ও রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার নেতৃত্বে সহস্র শিল্পী প্রথমেই গেয়ে শোনান 'গীতবিতান'-এর ভূমিকা পর্বের গান 'প্রথম যুগের উদয় দিগঙ্গনে প্রথম দিনের ঊষা'। এরপর নারী ও পুুরুষের সমবেত কণ্ঠে গীত হয় 'কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা', 'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে', একে একে গাওয়া হয় 'আদি তব শক্তি', 'ও আমার দেশের মাটি', 'আমার মুক্তির আলোয় আলোয়', 'গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ', 'ওহে দয়াময়', 'আকাশভরা সূর্য তারা', 'দুই হাতে তার মন্দিরা বাজে' এবং 'প্রাণ ভরিয়ে আশা হরিয়ে'। সহস্র কণ্ঠের রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনার শেষ টানা হয় 'ঐ মহামানব আসে দিকে দিকে' গানটি গীত হওয়ার
মধ্য দিয়ে।
অনন্যসাধারণ এ আয়োজনের অন্যতম কৃতিত্ব হচ্ছে 'গীতবিতান'-এর ২২২২টি গান নিয়ে 'শ্রুতি গীতবিতান'-এর ডিভিডি প্রকাশনা-যা 'সুরের ধারা'র এক অনন্য কীর্তি। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এর মোড়ক উন্মোচনকালে মন্তব্য করেন, 'যে কাজের জন্য আমাকে এখানে ডাকা হয়েছে, তা অনেক গৌরবের। ছেলেবেলা থেকেই আমি কবিগুরুর চর্চা করে আসছি। তাঁর সৃষ্টি আসলে অসীম।' এই কীর্তিমান বাঙালির ভাষায়, 'আজ আমাকে যে কাজটি করতে দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে আনন্দময় আর কিছু হতে পারে না। ছেলেবেলা থেকে রবীন্দ্রচর্চা করছি। কখনো রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এত বড় আয়োজন দেখব, ভাবতেও পারিনি। গীতবিতানের ২২২২টি গান এক জায়গায় পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। রবিঠাকুরের গানের একটা প্রচণ্ড সৃষ্টিকর দিক রয়েছে। যেটা আমরা এই শ্রুতি গীতবিতানে পাব।' 'শ্রুতি গীতবিতান' প্রকাশের মতো একটি সুবিশাল কর্মযজ্ঞ দক্ষ হাতে সম্পন্ন করতে পারার জন্য রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও তাঁর সংগঠন 'সুরের ধারা' বিশেষভাবে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। রবীন্দ্রসংগীতের একটা স্থায়ী শক্তি আছে; এর কথা শেষ হয় অথচ রেশ থাকে, শেষ হতে চায় না কখনো। এ গান যেমন কান পেতে শোনার, তেমনি উপলব্ধির। এই দুইয়ের মিশ্রণ রবীন্দ্রসংগীতকে চিরদিনের অনন্য আসনে বসিয়েছে। তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই শেখ হাসিনা রাবীন্দ্রিক। তাঁর বক্তব্যে বলেন, 'বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি যত দিন থাকবে, তত দিন রবীন্দ্রনাথ আমাদের আলোর দিশারি হয়ে থাকবেন। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর স্বপ্ন আর জীবন দর্শন আগামী প্রজন্মকেও পথ দেখাবে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে থাকতে।'
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির হয়েও সারা বিশ্বের, আমাদের গর্বের মাত্রাটা সীমা ছাড়িয়ে যায় ওখানেই। বাংলার সার্বজনীন ভাববাদ, ভাষা, সুর ও ছন্দকে তিনি স্বদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন অসীম কৃতিত্বে। তাঁর জন্মের ১৫০ বছর পরও তাই তিনি বাঙালির বিশ্বাস ও চেতনায় দীপ্যমান। শুধু কি তাই? রবীন্দ্রনাথ সত্য ও সুন্দরের পক্ষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনায় সমুজ্জ্বল করেছেন আমাদের, বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শাণিত করেছেন, হয়ে উঠেছেন আমাদের প্রায় প্রতিটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেরণা, সাহস ও শক্তি। এ এক বিস্ময়কর রবীন্দ্রনাথ, যাঁকে না ভালোবাসার শক্তি কোনো বাঙালির নেই। আজকের স্বাধীন রবীন্দ্রচর্চা দেখে অনেকেই হয়তো অতীত ভাববেন না। ভাববেন না, কিভাবে এই বিশ্ববরেণ্য কবি ও দার্শনিককে আক্রান্ত করা হয়েছিল সামরিকতন্ত্রশাসিত ধর্মাশ্রিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে। আমরা তখনো স্কুলের গণ্ডি পেরোইনি। ১৯৬০ সালের প্রথমদিকে আইয়ুব-মোনায়েম খাঁ-রা সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করল। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ওপর চালাল অভাবিত আক্রমণ। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান মিলে যে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি, তাকে তারা ভাগ করতে চেয়েছিল। হয়তো ভেবেছিল রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করলে বাঙালির জাতীয় শক্তির আধার সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে রোখা যাবে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। আমাদের পুরোধা বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ও সংস্কৃতিসেবীরা রুখে দিয়েছিলেন সে আগ্রাসন। আরো জানার বিষয় এই যে সে আন্দোলনের বাতাবরণেই জন্ম নিয়েছিল 'ছায়ানট'-সানজিদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকের মতো কয়েকজন বিদগ্ধ রবীন্দ্রভক্তের নেতৃত্বে। বলতেই হবে, 'ছায়ানটে'র হাতে জন্ম নেওয়া রমনা বটমূলের পহেলা বৈশাখের বাঙালি বর্ষবরণ আজ বাঙালির সাম্প্রদায়িক উন্মেষের এমন এক স্থায়ী আয়োজন, যাঁকে প্রতিরোধ করার শক্তি ধর্মীয় মৌলবাদী বা নব্য-পাকিস্তানপন্থীদের নেই।
স্বীকার করতেই হবে যে ষাটের দশকের রবীন্দ্র অনুরাগীদের সর্বাত্মক প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে আমরা রবীন্দ্রনাথকে যেমন নতুন করে আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম, আরো এবং আরো গভীর করে ভালোবাসতে পেরেছিলাম হৃদয়ে, চেতনায় ও বিশ্বাসে; একই সঙ্গে পেরেছিলাম বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ক্রমান্বয়ে উজ্জীবিত করতে। তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় প্রতিরোধ আন্দোলনের অপ্রতিরুদ্ধ হাতিয়ার। উৎসবের উদ্বোধনীতে আমার থাকা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কলকাতার বন্ধু পাপড়ি গুহঠাকুরতার আমন্ত্রণে শেষ দুদিনের সুরমূর্ছনা প্রেম ও প্রত্যয়ে রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে আবিষ্কার করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে আমাকে। এ যেন এক অনন্য প্রাপ্তি। প্রিয় শিল্পী বন্যা, ঢাকা ও কলকাতায় তাঁর অন্যতম সহযোগী পাপড়িসহ সবাইকে সে কারণে আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। ফাহমিদা খাতুন, অদিতি মহসিন, অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত, মহুয়া মঞ্জুরী সুনন্দা ও প্রতীক এন্দসহ কলকাতার বাকশিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শ্রীকান্ত আচার্য-সবাই মুগ্ধ করেছেন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হাজার হাজার শ্রোতাকে। এর বাইরেও লাখ লাখ মানুষ রবীন্দ্ররশ্মি উপভোগ ও উপলব্ধি করেছেন টেলিভিশনের সামনে বসে। ভিড় করা দর্শকের উপস্থিতিতে ঘটেছে সকাল থেকে রাত অবধি নানা বিষয়ের সেমিনার।
এ আয়োজন একদিক থেকে বাংলাদেশের হলেও এতে ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশের বাঙালি-অবাঙালিরা অংশ নিয়েছেন। কবি শঙ্খ ঘোষ, রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য করুণা সিন্ধু দাশ ও বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুশান্ত দত্ত গুপ্ত, শফি আহমেদ, বিশ্বজিৎ ঘোষ, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, আতিউর রহমান, স্বপন মজুমদার, অমীয় দেব, আল্পনা রায়, সোমেন বন্দ্যোপাধ্যায়, কেতকী কুশারি ডাইসন ও সুশোভন অধিকারীসহ সবাই বিশ্লেষণ করেছেন নানা আঙ্গিকের রবীন্দ্রনাথ। উৎসবে আরো আছে রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, তাঁর গল্পভিত্তিক চলচ্চিত্র এবং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী ও বইয়ের প্রদর্শনী। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এত বড় এবং এত পরিপাটি আয়োজন আগে আর কোথাও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বলতেই হবে, ঢাকার এ উৎসব নতুন মাত্রা যোগ করেছে রবীন্দ্রচর্চায়। আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছেন অগণিত রবীন্দ্রভক্ত, শিল্পী ও সাধারণ মানুষ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। বছর শেষের এ উৎসব সার্ধশততম বার্ষিকীর সব আয়োজনকে পূর্ণতা দিয়েছে। আমার বিশ্বাস, ২০১১ সাল নানা কারণে বাংলাদেশের জন্য নতুন রেনেসাঁর সূত্রপাত ঘটিয়েছে। এ সালেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪০তম বার্ষিকী উদ্যাপনে নতুন প্রজন্মের উপলব্ধি জাতীয় নবজাগরণের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে। বছর শেষের রবীন্দ্র উৎসবটি এ নবজাগরণের উল্লেখযোগ্য এক অধ্যায় হয়ে থাকবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
hh1971@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.