কোন দুঃখে? by শেখ রোকন
জাতিসংঘ জলপ্রবাহ সনদে (ইউএন ওয়াটারকোর্স কনভেনশন, ১৯৯৭) বাংলাদেশ স্বাক্ষর করছে না কেন? আগে যদিও মৃদু-মন্দ ছিল, টিপাইমুখ ইস্যু ডামাডোলে বেশ জোরেশোরেই উঠেছে কথাটি। বারবার উত্থাপিত এই প্রশ্নের জবাব অবশ্য মিলছে না। জানা যাচ্ছে, কমবেশি ২৭ বছরের প্রস্তুতি, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শেষে ১৯৯৭ সালের ২১ মে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে 'দ্য কনভেনশন অন দ্য ল অব নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল
ওয়াটারকোর্সেস' গৃহীত হয়েছিল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। ১০৬টি দেশ এর পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ভোট প্রক্রিয়া বর্জন করেছিল ২৬টি দেশ, অনুপস্থিত ৩১টি। বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল মাত্র তিনটি দেশ_ বুরুন্ডি, চীন ও তুরস্ক। কনভেনশনটি কেবল আন্তর্জাতিক জল-আইনের বিবর্তনের ধারায় বড় ধরনের সাফল্য নয়, সাধারণ পরিষদে পাস হওয়ার সময়টিও আখ্যায়িত হয়েছিল 'ঐতিহাসিক মুহূর্ত' হিসেবে। খোদ কনভেনশনটিও ইতিহাসে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘের কোনো কনভেনশন কার্যকর করতে অন্তত ৩৫টি সদস্য দেশের অনুস্বাক্ষর বা রেটিফিকেশন প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত ২২টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। অনুস্বাক্ষর করেছে প্রয়োজনের অর্ধেকেরও কম, ১৬। অথচ নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, এর প্রস্তাবকারী দেশের সংখ্যাই ছিল ৩৮টি। প্রস্তাবকারী দেশগুলোই যদি অনুস্বাক্ষর করত, এটি কার্যকর হতো আরও ১০ বছর আগে।
প্রস্তুতি ও পাস পর্বে কনভেনশনটিকে তো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পানিসম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে দেখা হচ্ছিল। দেখা হচ্ছিল আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে। বস্তুত নৌ চলাচলের বাইরে পানিসম্পদ ব্যবহার ও বণ্টনের ক্ষেত্রে গত দুই শতকে যেসব ইতিবাচক তত্ত্ব ও তদারকি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, কনভেনশনটিতে তার সবকিছুর সনি্নবেশ ঘটেছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি কার্যকর হলে পানি বণ্টন, প্লাবন ও দূষণ নিয়ে দুনিয়াজুড়ে যে জটিলতা তৈরি হচ্ছে, তার আন্তর্জাতিক সমাধানসূত্র মিলত। এমনকি বঞ্চিত রাষ্ট্রের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। তারপরও কনভেনশনটি থেকে হঠাৎ সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল কেন?
বিরোধিতার তর্জনী তোলা হচ্ছে ওয়াটারকোর্স কনভেনশনের সাত নম্বর ধারাটির দিকে। সেখানে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক প্রবাহের ক্ষেত্রে একটি দেশ এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না, যা আরেকটি দেশের জন্য 'ধর্তব্য ক্ষতি'র কারণ হয়। প্রভাবশালী যেসব দেশ গায়ের জোরে আন্তর্জাতিক প্রবাহের মর্জিমাফিক ব্যবহার করছে, তারা বেঁকে বসেছে। কেবল নিজেরা বিরোধিতা করছে না, তাদের প্রভাববলয়ে থাকা দেশগুলোকেও নিরুৎসাহিত করছে। আবার কিছু কিছু দেশ, বিশেষ করে ইউরোপে, ইতিমধ্যেই নিজেদের মধ্যে যেসব দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তি সম্পন্ন করেছে, সেগুলো ইউএন ওয়াটারকোর্স কনভেনশনের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর।
এসব বড়দের ব্যাপার; বাংলাদেশ কনভেনশনটিতে স্বাক্ষর করছে না কেন? অথচ আমরা গোড়া থেকেই কনভেনশনটির পক্ষে ছিলাম। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এর প্রস্তাবকারী ২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল তালিকার দ্বিতীয় স্থানে। যদিও সেটা বর্ণানুক্রমে, এর প্রতীকী মূল্য নিশ্চয়ই রয়েছে। ৫৭টি অভিন্ন নদী তথা ভূ-উপরিস্থ পানিসম্পদের সব উৎসের ভাটিতে থাকা একটি দেশের জন্য ইউএন ওয়াটারকোর্স কনভেনশনের ব্যবহারিক উপযোগিতা নিয়ে নতুন করে কী বলার আছে? এমনও নয় যে ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীর সঙ্গে আরও উন্নত দ্বিপক্ষীয় রক্ষাকবচ নিয়ে বসে আছে। বরং গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির নবম অনুচ্ছেদে অভিন্ন প্রবাহে 'অপরের জন্য ক্ষতিকর কিছু' না করার যে চুক্তি রয়েছে, ভারত তা সকাল-বিকেল লঙ্ঘন করছে।
আরও পরিহাসের বিষয়, একবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে মত নেওয়ার জন্য দেশীয় যেসব বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তারা সবাই প্রায় একবাক্যে সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আর বিষয়টি অগ্রসর হয়নি। কোন দুঃখে আমরা বসে আছি, কে জানে!
skrokon@gmail.com
জাতিসংঘের কোনো কনভেনশন কার্যকর করতে অন্তত ৩৫টি সদস্য দেশের অনুস্বাক্ষর বা রেটিফিকেশন প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত ২২টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। অনুস্বাক্ষর করেছে প্রয়োজনের অর্ধেকেরও কম, ১৬। অথচ নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, এর প্রস্তাবকারী দেশের সংখ্যাই ছিল ৩৮টি। প্রস্তাবকারী দেশগুলোই যদি অনুস্বাক্ষর করত, এটি কার্যকর হতো আরও ১০ বছর আগে।
প্রস্তুতি ও পাস পর্বে কনভেনশনটিকে তো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পানিসম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে দেখা হচ্ছিল। দেখা হচ্ছিল আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে। বস্তুত নৌ চলাচলের বাইরে পানিসম্পদ ব্যবহার ও বণ্টনের ক্ষেত্রে গত দুই শতকে যেসব ইতিবাচক তত্ত্ব ও তদারকি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, কনভেনশনটিতে তার সবকিছুর সনি্নবেশ ঘটেছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি কার্যকর হলে পানি বণ্টন, প্লাবন ও দূষণ নিয়ে দুনিয়াজুড়ে যে জটিলতা তৈরি হচ্ছে, তার আন্তর্জাতিক সমাধানসূত্র মিলত। এমনকি বঞ্চিত রাষ্ট্রের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। তারপরও কনভেনশনটি থেকে হঠাৎ সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল কেন?
বিরোধিতার তর্জনী তোলা হচ্ছে ওয়াটারকোর্স কনভেনশনের সাত নম্বর ধারাটির দিকে। সেখানে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক প্রবাহের ক্ষেত্রে একটি দেশ এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না, যা আরেকটি দেশের জন্য 'ধর্তব্য ক্ষতি'র কারণ হয়। প্রভাবশালী যেসব দেশ গায়ের জোরে আন্তর্জাতিক প্রবাহের মর্জিমাফিক ব্যবহার করছে, তারা বেঁকে বসেছে। কেবল নিজেরা বিরোধিতা করছে না, তাদের প্রভাববলয়ে থাকা দেশগুলোকেও নিরুৎসাহিত করছে। আবার কিছু কিছু দেশ, বিশেষ করে ইউরোপে, ইতিমধ্যেই নিজেদের মধ্যে যেসব দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তি সম্পন্ন করেছে, সেগুলো ইউএন ওয়াটারকোর্স কনভেনশনের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর।
এসব বড়দের ব্যাপার; বাংলাদেশ কনভেনশনটিতে স্বাক্ষর করছে না কেন? অথচ আমরা গোড়া থেকেই কনভেনশনটির পক্ষে ছিলাম। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এর প্রস্তাবকারী ২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল তালিকার দ্বিতীয় স্থানে। যদিও সেটা বর্ণানুক্রমে, এর প্রতীকী মূল্য নিশ্চয়ই রয়েছে। ৫৭টি অভিন্ন নদী তথা ভূ-উপরিস্থ পানিসম্পদের সব উৎসের ভাটিতে থাকা একটি দেশের জন্য ইউএন ওয়াটারকোর্স কনভেনশনের ব্যবহারিক উপযোগিতা নিয়ে নতুন করে কী বলার আছে? এমনও নয় যে ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীর সঙ্গে আরও উন্নত দ্বিপক্ষীয় রক্ষাকবচ নিয়ে বসে আছে। বরং গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির নবম অনুচ্ছেদে অভিন্ন প্রবাহে 'অপরের জন্য ক্ষতিকর কিছু' না করার যে চুক্তি রয়েছে, ভারত তা সকাল-বিকেল লঙ্ঘন করছে।
আরও পরিহাসের বিষয়, একবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে মত নেওয়ার জন্য দেশীয় যেসব বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তারা সবাই প্রায় একবাক্যে সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আর বিষয়টি অগ্রসর হয়নি। কোন দুঃখে আমরা বসে আছি, কে জানে!
skrokon@gmail.com
No comments