জ্বালানি-তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সরকার by আরিফুজ্জামান তুহিন
২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, গ্যাস রপ্তানিতে রাজি না হওয়ায় তিনি নির্বাচনে হেরেছেন। সেই আওয়ামী লীগ গত জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। বিরোধীপক্ষ অভিযোগ তুলেছে, গতবার তেল-গ্যাস খাতে যেসব ভুল আওয়ামী লীগের নেত্রী করেছেন, এবার আর সে ভুল করতে তিনি রাজি নন। এ কারণে একের পর এক তেল-গ্যাসক্ষেত্র বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়েছেন। সরকারবিরোধীদের
এ বক্তব্য কতখানি সত্য বা মিথ্যা সেটা ভিন্ন বিষয়, কিন্তু ২০১১ সাল ছিল বাংলাদেশের তেল-গ্যাসের ওপর বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য উল্লেখযোগ্য বছর। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার মতো সুপার পাওয়ার দেশের তেল-গ্যাস কম্পানি বাংলাদেশের সাগরবক্ষ ও স্থলের তেল-গ্যাসের ওপর অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস উত্তোলন কম্পানি বাপেঙ্ প্রয়োজনীয় বরাদ্দ চেয়েও পায়নি।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করার ফলে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে পিডিবিকে (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড)। পাশাপাশি এসব রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভর্তুকি দামে জ্বালানি সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারের কোষাগার শূন্য হতে চলেছে। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট খাতে ভর্তুকি টানতে গিয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সরকারের তিন বছরে মূল ধারার স্থায়ী কোনো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়নি, বরং একটার পর একটা বেসরকারি খাতের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় বিদ্যুতের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলে দেওয়া ভর্তুকি চলে যাচ্ছে কিছু ব্যবসায়ীদের পকেটে।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতা নেওয়ার পর সব থেকে উল্লেখযোগ্য চুক্তি হলো যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কম্পানি কনোকো-ফিলিপসের কাছে বঙ্গোপসাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক ছেড়ে দেওয়া। রপ্তানি ও তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির বিধান কনোকো-ফিলিপসের বাংলাদেশ সরকার গত ১৬ জুন বৃহস্পতিবার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন কম্পানি কনোকো-ফিলিপসকে ৮০ শতাংশ গ্যাসের মালিকানা, তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি ও রপ্তানির অনুমতি পেল। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি একসময়ের শীতল যুদ্ধের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়াও পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশের তেল-গ্যাসের ভাগ। স্থলভাগের ১০টি গ্যাসকূপ তুলে দেওয়া হচ্ছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের হাতে। এ ১০টি গ্যাসকূপের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি পুরনো কূপ ও পাঁচটি নতুন কূপ। গ্যাস সংকট সমাধানের নামে বিদেশি কম্পানির কাছে অধিক অর্থে গ্যাসকূপগুলো তুলে দেওয়ার ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। শুধু রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রই নয়, চীনকেও দেওয়া হয়েছে তেল-গ্যাস উত্তোলনের দায়িত্ব। চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কম্পানি সিনোপেকের সঙ্গে বাপেঙ্রে জয়েন্ট ভেঞ্চারের বিষয় একটি গোপন খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। অন্যান্য চুক্তির মতোই এই চুক্তির খসড়াও গোপন রাখা হয়েছে।
বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সরকার তাড়াহুড়া করে রেন্টাল পাওয়ার কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। সরকারি ঘরানার ব্যবসায়ীদের হাতে দ্রুত হারে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ছেড়ে দেওয়ার গত তিন বছরে প্রায় দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও সরকারের কাঁধে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস ও ডিজেল তেলের ব্যাপক ভর্তুকি এবং উক্ত রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে অধিক দামে (ইউনিটপ্রতি ১৪ থেকে ১৬ টাকা) বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে অর্থনীতি তলানিতে পেঁৗছেছে। দ্রুত উৎপাদন বাড়াতে গত দুই বছরে ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের চাহিদা বেড়েছে বছরে ১৩ লাখ থেকে ১৫ লাখ টনের মতো। আগামী বছর নতুন আরো কয়েকটি রেন্টাল পাওয়ার কেন্দ্র চালু হলে তেলের চাহিদা বাড়বে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত মিলে ৬০ লাখ টন তেল আমদানি করা হবে। অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির চাপ কমানোর চেষ্টা করেছে সরকার। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে তিন দফা দাম বাড়িয়েছে ৩৩.৫৭ শতাংশ।
গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটে দেশের শিল্প
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় ২০০৮-এর ৬ জানুয়ারি প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ছিল ২০০ কোটি ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে সে সময় সরবরাহ হতো ১৭৫ কোটি ঘনফুট, ঘাটতি ছিল ২৫ কোটি ঘনফুট। গত তিন বছরে চাহিদা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রতিদিন ২৫০ কোটি ঘনফুট। আর বর্তমানে জোগান রয়েছে ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট। ২৫ থেকে ৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। যদিও গত দেড় বছর ধরে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদান বন্ধ রয়েছে। ২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত গ্যাস সংযোগ প্রদান থাকার আদেশ এখনো বলবৎ রয়েছে।
গ্যাসের অভাবে শিল্পকারখানার চাকা গ্যাসের বন্ধ ছিল। সরকারি হিসাবে ২০১০-১১ অর্থবছরে গ্যাস খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল এক শতাংশেরও কম। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পাঁচ বছরের মধ্যে চলতি বছর গ্যাস খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে আশঙ্কার চেয়েও কম হারে। ২০০৬-০৭ সালে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে (২০১০-১১) তা এসে দাঁড়িয়েছে ০.৯৬ শতাংশে। তার আগের অর্থবছরেও (২০০৯-১০) প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৫১ শতাংশ। এমনকি ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ৭.৭২ শতাংশ এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৮.৪২ শতাংশ।
আবাসন মালিকদের সংগঠন রিহ্যাব সূত্রে জানা যায়, গ্যাস ও বিদ্যুতের নতুন সংযোগ বন্ধ থাকায় ২৫ হাজার আবাসিক ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা যাচ্ছে না। বিকেএমইএ সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে মোট ২৩০টি স্পিনিং মিল, কম্পোজিট টেঙ্টাইল ও গার্মেন্টসহ তৈরি পোশাক সম্পর্কিত খাতের শিল্প কারখানা গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়ে ওঠা চার শতাধিক প্রতিষ্ঠান গত আড়াই বছর ধরে গ্যাস সংযোগ পাচ্ছে না। বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সূত্র জানিয়েছে, পোশাক খাতে ৫২টি বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গত দুই-আড়াই বছর ধরে বিনিয়োগ করে বসে আছে। গড়ে এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা মাসে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের সুদ গুনছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ টেঙ্টাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) দেওয়া তথ্য মতে, বস্ত্র খাতে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে গ্যাসের অভাবে। গত দুই বছর ধরে এমন ভারী মেশিনারিজ স্থাপন করে ২৫টি টেঙ্টাইল মিল বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপেক্ষায় রয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪৭টি নতুন সিএনজি স্টেশন স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গ্যাস-সংযোগ পায়নি একটিও।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ-সংকট চলেছে। অন্যদিকে সিলেট অঞ্চলে ১০ কোটি (১০০ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাস উদ্বৃত্ত। পাইপলাইনের অভাবে এ গ্যাস সংকটপূর্ণ এলাকায় পেঁৗছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে হবিগঞ্জের বিবিয়ানা থেকে টাঙ্গাইলের ধনুয়া পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি লাইন স্থাপনের কাজ ২০১২ সালের মধ্যে শেষ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নর্থ-সাউথ পাইপলাইনের সমান্তরাল আরেকটি লাইন বসানোর কাজও শুরু করা হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা ধারণা দিয়েছেন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বর্তমানে বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এ হিসাবে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১১০ কোটি টাকা।
সরকারের তিন বছর পার হওয়ার পরও গ্যাস সংকট সমাধানে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন ঘটেনি।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করার ফলে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে পিডিবিকে (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড)। পাশাপাশি এসব রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভর্তুকি দামে জ্বালানি সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারের কোষাগার শূন্য হতে চলেছে। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট খাতে ভর্তুকি টানতে গিয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সরকারের তিন বছরে মূল ধারার স্থায়ী কোনো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়নি, বরং একটার পর একটা বেসরকারি খাতের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় বিদ্যুতের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলে দেওয়া ভর্তুকি চলে যাচ্ছে কিছু ব্যবসায়ীদের পকেটে।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতা নেওয়ার পর সব থেকে উল্লেখযোগ্য চুক্তি হলো যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কম্পানি কনোকো-ফিলিপসের কাছে বঙ্গোপসাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক ছেড়ে দেওয়া। রপ্তানি ও তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির বিধান কনোকো-ফিলিপসের বাংলাদেশ সরকার গত ১৬ জুন বৃহস্পতিবার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন কম্পানি কনোকো-ফিলিপসকে ৮০ শতাংশ গ্যাসের মালিকানা, তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি ও রপ্তানির অনুমতি পেল। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি একসময়ের শীতল যুদ্ধের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়াও পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশের তেল-গ্যাসের ভাগ। স্থলভাগের ১০টি গ্যাসকূপ তুলে দেওয়া হচ্ছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের হাতে। এ ১০টি গ্যাসকূপের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি পুরনো কূপ ও পাঁচটি নতুন কূপ। গ্যাস সংকট সমাধানের নামে বিদেশি কম্পানির কাছে অধিক অর্থে গ্যাসকূপগুলো তুলে দেওয়ার ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। শুধু রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রই নয়, চীনকেও দেওয়া হয়েছে তেল-গ্যাস উত্তোলনের দায়িত্ব। চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কম্পানি সিনোপেকের সঙ্গে বাপেঙ্রে জয়েন্ট ভেঞ্চারের বিষয় একটি গোপন খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। অন্যান্য চুক্তির মতোই এই চুক্তির খসড়াও গোপন রাখা হয়েছে।
বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সরকার তাড়াহুড়া করে রেন্টাল পাওয়ার কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। সরকারি ঘরানার ব্যবসায়ীদের হাতে দ্রুত হারে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ছেড়ে দেওয়ার গত তিন বছরে প্রায় দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও সরকারের কাঁধে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস ও ডিজেল তেলের ব্যাপক ভর্তুকি এবং উক্ত রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে অধিক দামে (ইউনিটপ্রতি ১৪ থেকে ১৬ টাকা) বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে অর্থনীতি তলানিতে পেঁৗছেছে। দ্রুত উৎপাদন বাড়াতে গত দুই বছরে ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের চাহিদা বেড়েছে বছরে ১৩ লাখ থেকে ১৫ লাখ টনের মতো। আগামী বছর নতুন আরো কয়েকটি রেন্টাল পাওয়ার কেন্দ্র চালু হলে তেলের চাহিদা বাড়বে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত মিলে ৬০ লাখ টন তেল আমদানি করা হবে। অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির চাপ কমানোর চেষ্টা করেছে সরকার। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে তিন দফা দাম বাড়িয়েছে ৩৩.৫৭ শতাংশ।
গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটে দেশের শিল্প
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় ২০০৮-এর ৬ জানুয়ারি প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ছিল ২০০ কোটি ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে সে সময় সরবরাহ হতো ১৭৫ কোটি ঘনফুট, ঘাটতি ছিল ২৫ কোটি ঘনফুট। গত তিন বছরে চাহিদা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রতিদিন ২৫০ কোটি ঘনফুট। আর বর্তমানে জোগান রয়েছে ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট। ২৫ থেকে ৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। যদিও গত দেড় বছর ধরে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদান বন্ধ রয়েছে। ২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত গ্যাস সংযোগ প্রদান থাকার আদেশ এখনো বলবৎ রয়েছে।
গ্যাসের অভাবে শিল্পকারখানার চাকা গ্যাসের বন্ধ ছিল। সরকারি হিসাবে ২০১০-১১ অর্থবছরে গ্যাস খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল এক শতাংশেরও কম। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পাঁচ বছরের মধ্যে চলতি বছর গ্যাস খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে আশঙ্কার চেয়েও কম হারে। ২০০৬-০৭ সালে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে (২০১০-১১) তা এসে দাঁড়িয়েছে ০.৯৬ শতাংশে। তার আগের অর্থবছরেও (২০০৯-১০) প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৫১ শতাংশ। এমনকি ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ৭.৭২ শতাংশ এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৮.৪২ শতাংশ।
আবাসন মালিকদের সংগঠন রিহ্যাব সূত্রে জানা যায়, গ্যাস ও বিদ্যুতের নতুন সংযোগ বন্ধ থাকায় ২৫ হাজার আবাসিক ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা যাচ্ছে না। বিকেএমইএ সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে মোট ২৩০টি স্পিনিং মিল, কম্পোজিট টেঙ্টাইল ও গার্মেন্টসহ তৈরি পোশাক সম্পর্কিত খাতের শিল্প কারখানা গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়ে ওঠা চার শতাধিক প্রতিষ্ঠান গত আড়াই বছর ধরে গ্যাস সংযোগ পাচ্ছে না। বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সূত্র জানিয়েছে, পোশাক খাতে ৫২টি বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গত দুই-আড়াই বছর ধরে বিনিয়োগ করে বসে আছে। গড়ে এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা মাসে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের সুদ গুনছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ টেঙ্টাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) দেওয়া তথ্য মতে, বস্ত্র খাতে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে গ্যাসের অভাবে। গত দুই বছর ধরে এমন ভারী মেশিনারিজ স্থাপন করে ২৫টি টেঙ্টাইল মিল বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপেক্ষায় রয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪৭টি নতুন সিএনজি স্টেশন স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গ্যাস-সংযোগ পায়নি একটিও।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ-সংকট চলেছে। অন্যদিকে সিলেট অঞ্চলে ১০ কোটি (১০০ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাস উদ্বৃত্ত। পাইপলাইনের অভাবে এ গ্যাস সংকটপূর্ণ এলাকায় পেঁৗছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে হবিগঞ্জের বিবিয়ানা থেকে টাঙ্গাইলের ধনুয়া পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি লাইন স্থাপনের কাজ ২০১২ সালের মধ্যে শেষ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নর্থ-সাউথ পাইপলাইনের সমান্তরাল আরেকটি লাইন বসানোর কাজও শুরু করা হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা ধারণা দিয়েছেন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বর্তমানে বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এ হিসাবে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১১০ কোটি টাকা।
সরকারের তিন বছর পার হওয়ার পরও গ্যাস সংকট সমাধানে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন ঘটেনি।
No comments