কৃষি-শুভ সূচনায় অশুভর হাতছানি by শফিকুল ইসলাম জুয়েল
নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন সরকার বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছিল, 'শুভ সূচনা' হিসেবে। এর মধ্যে কৃষি খাতে উচ্চমূল্যের নন-ইউরিয়া সারের মূল্য কমিয়ে অর্ধেকের নিচে নামানো, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন ফসল ও ডিজেলের ভর্তুকি প্রদান, গ্রোয়ার্স মার্কেট স্থাপন। খাদ্য বিভাগে বোরো ও আমনের ভরা মৌসুমে ধানের সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা এবং মজুদ শুরু। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ
সেক্টরে মাছ ও প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ কৃষকের মতো মৎস্যজীবীদেরও পরিচয়পত্র দেওয়াসহ বেশ কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। যার ফলে কৃষক সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে বিনিয়োগ ও কায়িক শ্রম দিতে আরো আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাড়তে থাকে ফসল, মৎস্য ও প্রাণিজ খাতের উৎপাদন। কিন্তু এর পর থেকেই পরের দেড় বছরে ডিজেলের তিন দফা মূল্যবৃদ্ধির পর কৃষি খাতে ডিজেলের ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া, ইউরিয়া সারের দাম প্রতি কেজিতে আট টাকা বাড়ানো হয়। খাদ্য বিভাগ ভরা মৌসুমের এক থেকে দেড় মাস পর ঘোষণা করে সংগ্রহ মূল্য। ফলে ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয় কৃষক। সুষ্ঠু তদারকির অভাবে ঘোষণার দুই বছর পরও মৎস্যজীবীরা পরিচয়পত্র পায়নি। অ্যানথ্রাঙ্রে সুযোগে অতিমুনাফা হাতিয়ে মুরগি ব্যবসায়ীরা জিম্মি করে রাখেন ক্রেতাদের। বার্ড ফ্লু প্রতিরোধক উৎপাদনে কোনো পদক্ষেপ না নিতে পারায় প্রাণিসম্পদ খাতের পোলট্রি শিল্প এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নাজুক পরিস্থিতি পার করছে।
জাতীয় বীজ বোর্ডের তালিকাভুক্ত কৃষক প্রতিনিধি যশোরের আলতাব হোসেন, নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার দোডাঙ্গী গ্রামের কৃষক অ্যাডভোকেট শাহরিয়ার সিমু, ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল সদর উপজেলার কৃষক মোবারক আলীসহ অসংখ্য কৃষক বলছেন, 'তিন বছর ধরে ফসলের উৎপাদন বাড়লেও কৃষকের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সরকারের সরাসরি বিপণনব্যবস্থা গড়ে না ওঠা এবং মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত চিত্র সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ায় কৃষকের লাভ পোকায় খাচ্ছে।
কৃষি খাত : বিশেষজ্ঞরা কৃষি খাতের পর্যালোচনা করে বলছেন, এই সরকারের উদ্যোগেই প্রথম দুই বছরে তিন দফায় (২০০৯ সালের ১৪ জানুয়ারি ও ২ নভেম্বর এবং ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর) নন-ইউরিয়া সারের দাম কমেছে। ফলে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ৮০ টাকা কেজির টিএসপি এখন ২২ টাকায়, ৭০ টাকা কেজির এমওপি ১৫ টাকায় এবং ৯০ টাকা কেজির ডিএপি ২৭ টাকায় কিনতে পারছে কৃষক। প্রথম বছরে কৃষক পেয়েছে ডিজেলের দামে ৭২১ কোটি টাকা ভর্তুকি। প্রথম দুই বছরে মিলেছে সারসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন খাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি। প্রযুক্তি ক্রয়ে মিলেছে ২৫ শতাংশ নগদ ভর্তুকি। আবার এই সরকারের সিদ্ধান্তেই গত বছরে প্রায় ৮২ লাখ কৃষক ডিজেল কেনা বাবদ ৭৫০ কোটি টাকার ভর্তুকিবঞ্চিত হয়েছে। ১ জুন নেওয়া সিদ্ধান্তের পর থেকে ১২ টাকা কেজির ইউরিয়া সার কিনছে ২০ টাকায়। ফলে বার্ষিক চাহিদার প্রায় ২৮ লাখ টন ইউরিয়া কেনায় মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে কৃষককে বাড়তি গুনতে হচ্ছে এক হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি বছরে পাঁচ টাকা করে পরপর তিনবার (সেপ্টেম্বর, ১০ নভেম্বর ও সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বর) দাম বাড়ানোর ফলে কৃষি খাতে ব্যবহার্য প্রায় সাড়ে ১২ কোটি লিটার ডিজেলে গত বছরের তুলনায় কৃষকের ব্যয় বেড়েছে আরো প্রায় এক হাজার ৪৫০ কোটি টাকা।
সরকারের ইতিবাচক ও নেতিবাচক নানা সিদ্ধান্তের মধ্যেও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও কায়িক শ্রমের সমন্বয়ে ৩৮ জাতের ফসলের মধ্যে প্রায় সব ধরনের উৎপাদন বাড়িয়েছে কৃষক। কিন্তু গত দুই বছর ধরেই উৎপাদন অনুযায়ী ব্যবহার পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। এমনকি সরকারের সুষ্ঠু তদারকি ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের অভাবও ছিল প্রায় দুই বছরজুড়েই। ফলে রাজধানীসহ অধিকাংশ শহুরে মানুষ পণ্যমূল্যের তাপে দাহ হলেও কৃষক ধান, পাট, আলু, সবজিসহ বেশকিছু পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে কৃষক। স্থানভেদে কৃষক ৫০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা মণ দরে পাট বিক্রি করেছে। উৎপাদন খরচের তুলনায় বিক্রয়মূল্য কম হওয়ায় যশোরের মতো অনেক স্থানেই আগুন দিয়ে পাট পুড়িয়ে মনের জ্বালা ও ক্ষোভ মিটিয়েছে কৃষকরা। প্রায় একই পরিস্থিতি ছিল আলুর দামেও। কোল্ড স্টোরেজে স্থানভেদে তিন থেকে ছয় টাকা কেজিতে আলু বিক্রি হওয়ায় অনেক কৃষক কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলুই তোলেনি। আবার অনেকে খাবার আলু বেচতে না পেরে তা এবার বীজ আলু হিসেবে চাষ করেছে। পরপর দুই বছর ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় অনেক কৃষক আলু চাষ থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে বিএডিসি ও ব্যবসায়িক পর্যায়ের নির্ধারিত বীজের প্রায় অর্ধেকই অবিক্রীত থেকে গেছে। দামের প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি ছিল কৃষক পর্যায়ে উৎপাদিত বিভিন্ন সবজির ক্ষেত্রেও। অথচ সরকারের নির্ধারিত গ্রোয়ার্স মার্কেটগুলো কার্যকর পদক্ষেপ রাখতে পারলে অসংখ্য কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হতো না।
তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে বর্তমান সরকার কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি টিএসপিতে ২৮ টাকা, এমওপিতে ৩২ টাকা, ডিএপিতে ৩১ টাকা এবং ইউরিয়ায় ১৭ টাকা করে ভর্তুকি দিচ্ছে। ফলে ২০১০-১১ অর্থবছরে পরিশোধিত ভর্তুকি ছিল পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, ২০০৯-১০ অর্থবছরে চার হাজার ৯২২ কোটি টাকা এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল পাঁচ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ রয়েছে চার হাজার কোটি টাকা।
কৃষিসচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দেশের কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে সব ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত সরকার। ডিজেলের দাম বাড়ায় উৎপাদিত পণ্যের সামান্য খরচ বাড়বে। আর সে হিসাবে পণ্যের দামও বাড়ানোর ব্যাপারে দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। ইউরিয়ার দাম বাড়ানোর ফলে ফসলে সারের সুষম ব্যবহার হচ্ছে। এতে মাটির গুণাগুণ রক্ষা পাচ্ছে।' তিনি জানান, 'আগামীতে ডিজেলে ভর্তুকির বিষয়েও ভাবা হবে।'
কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, 'বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় তিন বছর ধরেই অব্যাহতভাবে ফসল উৎপাদন বেড়ে চলছে। কৃষকদের দুর্ভোগ লাঘবে এক কোটি ৮২ লাখ কৃষক পরিবারকে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেওয়া হয়েছে। ১০ টাকায় কৃষককে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দিয়ে তার মাধ্যমে ফসল, ডিজেলসহ নানা ভর্তুকির টাকা সরাসরি পেঁৗছানো হচ্ছে। পাটের জন্মরহস্য উদ্ঘাটনে এ সরকার যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়েছে। পাটের আঁশ ছাড়াতে এবং আমন-আউশের উৎপাদন বাড়াতে নগদ ও উপকরণ সহায়তা দিয়ে কৃষককে সহায়তা করতে নূ্যনতম কুণ্ঠাবোধ করছে না সরকার।'
খাদ্য বিভাগ : সংশ্লিষ্টরা খাদ্য বিভাগের পর্যালোচনায় বলছেন, খাদ্য বিভাগের বিভিন্ন পদে নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ ছিল। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, গত দুই বছরে 'অতিরিক্ত ময়েশ্চারের' অজুহাত তুলে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের সিদ্ধান্ত বিলম্বে নেওয়ায় চাহিদা ও ক্রেতা সংকটে পড়েছে কৃষক। এতে করে বোরো ও আমনের ভরা মৌসুমেও কৃষককে ধান বিক্রি করতে হয়েছে স্থানভেদে ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকা মণ দরে। অথচ এ সময়ে সরকার দেশের বাজারে চালের দাম না বাড়ানোর অজুহাত তুলে বেশি দামে আমদানিতেই আগ্রহী ছিল। এতে করে ফসলের ভরা মৌসুমে ধার-দেনা পরিশোধ করতে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে অপূরণীয় ক্ষতিতে পড়েছে কৃষক।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ মনে করেন, 'ভরা মৌসুমে ধান সংগ্রহের ঘোষণা না দেওয়ায় কৃষকদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়, যার প্রভাব ফসল চাষে অনাগ্রহ বাড়াবে।'
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. জহুরুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ফসলের ভালো ফলন ও দামের সুযোগ নিয়ে সরকার নীরবতা দেখালে সাময়িকভাবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদিতে দেশ উৎপাদন হারাবে। এ ছাড়া বাজারের নিয়ন্ত্রণ যাবে ফড়িয়াদের দখলে। আর সরকারের প্রতি আস্থা কমবে কৃষকের।' তিনি অভিযোগ করেন, 'মার্চ থেকে বোরো ধান কাটা শুরু হলেও সরকার বিলম্বে (এপ্রিল-মে মাসে) সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করে। এতে অভাবগ্রস্ত (ধান কেটে মাড়াই শেষেই বিক্রি করে বলে) কৃষকরা সরকারের ঘোষিত ন্যায্যমূল্য-বঞ্চিত হয়। লাভবান হয় ফড়িয়া, মজুদদার ও চালকল মালিকরা।'
কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, 'ধান চাষে খরচ ও লাভ হিসাব করে সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করা হয়। আর ধান ওঠার ভরা মৌসুমে ময়েশ্চার (আর্দ্রতা) বেশি থাকে, যা গুদামজাতের জন্য উৎকৃষ্ট হয় না। ফলে ধান শুকানোর পরই কেবল সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করা হয়। তবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রয়োজনে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য ধান ওঠার সময়ই ঘোষণা করার চেষ্টা করা হবে।'
জাতীয় বীজ বোর্ডের তালিকাভুক্ত কৃষক প্রতিনিধি যশোরের আলতাব হোসেন, নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার দোডাঙ্গী গ্রামের কৃষক অ্যাডভোকেট শাহরিয়ার সিমু, ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল সদর উপজেলার কৃষক মোবারক আলীসহ অসংখ্য কৃষক বলছেন, 'তিন বছর ধরে ফসলের উৎপাদন বাড়লেও কৃষকের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সরকারের সরাসরি বিপণনব্যবস্থা গড়ে না ওঠা এবং মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত চিত্র সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ায় কৃষকের লাভ পোকায় খাচ্ছে।
কৃষি খাত : বিশেষজ্ঞরা কৃষি খাতের পর্যালোচনা করে বলছেন, এই সরকারের উদ্যোগেই প্রথম দুই বছরে তিন দফায় (২০০৯ সালের ১৪ জানুয়ারি ও ২ নভেম্বর এবং ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর) নন-ইউরিয়া সারের দাম কমেছে। ফলে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ৮০ টাকা কেজির টিএসপি এখন ২২ টাকায়, ৭০ টাকা কেজির এমওপি ১৫ টাকায় এবং ৯০ টাকা কেজির ডিএপি ২৭ টাকায় কিনতে পারছে কৃষক। প্রথম বছরে কৃষক পেয়েছে ডিজেলের দামে ৭২১ কোটি টাকা ভর্তুকি। প্রথম দুই বছরে মিলেছে সারসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন খাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি। প্রযুক্তি ক্রয়ে মিলেছে ২৫ শতাংশ নগদ ভর্তুকি। আবার এই সরকারের সিদ্ধান্তেই গত বছরে প্রায় ৮২ লাখ কৃষক ডিজেল কেনা বাবদ ৭৫০ কোটি টাকার ভর্তুকিবঞ্চিত হয়েছে। ১ জুন নেওয়া সিদ্ধান্তের পর থেকে ১২ টাকা কেজির ইউরিয়া সার কিনছে ২০ টাকায়। ফলে বার্ষিক চাহিদার প্রায় ২৮ লাখ টন ইউরিয়া কেনায় মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে কৃষককে বাড়তি গুনতে হচ্ছে এক হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি বছরে পাঁচ টাকা করে পরপর তিনবার (সেপ্টেম্বর, ১০ নভেম্বর ও সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বর) দাম বাড়ানোর ফলে কৃষি খাতে ব্যবহার্য প্রায় সাড়ে ১২ কোটি লিটার ডিজেলে গত বছরের তুলনায় কৃষকের ব্যয় বেড়েছে আরো প্রায় এক হাজার ৪৫০ কোটি টাকা।
সরকারের ইতিবাচক ও নেতিবাচক নানা সিদ্ধান্তের মধ্যেও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও কায়িক শ্রমের সমন্বয়ে ৩৮ জাতের ফসলের মধ্যে প্রায় সব ধরনের উৎপাদন বাড়িয়েছে কৃষক। কিন্তু গত দুই বছর ধরেই উৎপাদন অনুযায়ী ব্যবহার পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। এমনকি সরকারের সুষ্ঠু তদারকি ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের অভাবও ছিল প্রায় দুই বছরজুড়েই। ফলে রাজধানীসহ অধিকাংশ শহুরে মানুষ পণ্যমূল্যের তাপে দাহ হলেও কৃষক ধান, পাট, আলু, সবজিসহ বেশকিছু পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে কৃষক। স্থানভেদে কৃষক ৫০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা মণ দরে পাট বিক্রি করেছে। উৎপাদন খরচের তুলনায় বিক্রয়মূল্য কম হওয়ায় যশোরের মতো অনেক স্থানেই আগুন দিয়ে পাট পুড়িয়ে মনের জ্বালা ও ক্ষোভ মিটিয়েছে কৃষকরা। প্রায় একই পরিস্থিতি ছিল আলুর দামেও। কোল্ড স্টোরেজে স্থানভেদে তিন থেকে ছয় টাকা কেজিতে আলু বিক্রি হওয়ায় অনেক কৃষক কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলুই তোলেনি। আবার অনেকে খাবার আলু বেচতে না পেরে তা এবার বীজ আলু হিসেবে চাষ করেছে। পরপর দুই বছর ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় অনেক কৃষক আলু চাষ থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে বিএডিসি ও ব্যবসায়িক পর্যায়ের নির্ধারিত বীজের প্রায় অর্ধেকই অবিক্রীত থেকে গেছে। দামের প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি ছিল কৃষক পর্যায়ে উৎপাদিত বিভিন্ন সবজির ক্ষেত্রেও। অথচ সরকারের নির্ধারিত গ্রোয়ার্স মার্কেটগুলো কার্যকর পদক্ষেপ রাখতে পারলে অসংখ্য কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হতো না।
তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে বর্তমান সরকার কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি টিএসপিতে ২৮ টাকা, এমওপিতে ৩২ টাকা, ডিএপিতে ৩১ টাকা এবং ইউরিয়ায় ১৭ টাকা করে ভর্তুকি দিচ্ছে। ফলে ২০১০-১১ অর্থবছরে পরিশোধিত ভর্তুকি ছিল পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, ২০০৯-১০ অর্থবছরে চার হাজার ৯২২ কোটি টাকা এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল পাঁচ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ রয়েছে চার হাজার কোটি টাকা।
কৃষিসচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দেশের কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে সব ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত সরকার। ডিজেলের দাম বাড়ায় উৎপাদিত পণ্যের সামান্য খরচ বাড়বে। আর সে হিসাবে পণ্যের দামও বাড়ানোর ব্যাপারে দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। ইউরিয়ার দাম বাড়ানোর ফলে ফসলে সারের সুষম ব্যবহার হচ্ছে। এতে মাটির গুণাগুণ রক্ষা পাচ্ছে।' তিনি জানান, 'আগামীতে ডিজেলে ভর্তুকির বিষয়েও ভাবা হবে।'
কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, 'বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় তিন বছর ধরেই অব্যাহতভাবে ফসল উৎপাদন বেড়ে চলছে। কৃষকদের দুর্ভোগ লাঘবে এক কোটি ৮২ লাখ কৃষক পরিবারকে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেওয়া হয়েছে। ১০ টাকায় কৃষককে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দিয়ে তার মাধ্যমে ফসল, ডিজেলসহ নানা ভর্তুকির টাকা সরাসরি পেঁৗছানো হচ্ছে। পাটের জন্মরহস্য উদ্ঘাটনে এ সরকার যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়েছে। পাটের আঁশ ছাড়াতে এবং আমন-আউশের উৎপাদন বাড়াতে নগদ ও উপকরণ সহায়তা দিয়ে কৃষককে সহায়তা করতে নূ্যনতম কুণ্ঠাবোধ করছে না সরকার।'
খাদ্য বিভাগ : সংশ্লিষ্টরা খাদ্য বিভাগের পর্যালোচনায় বলছেন, খাদ্য বিভাগের বিভিন্ন পদে নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ ছিল। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, গত দুই বছরে 'অতিরিক্ত ময়েশ্চারের' অজুহাত তুলে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের সিদ্ধান্ত বিলম্বে নেওয়ায় চাহিদা ও ক্রেতা সংকটে পড়েছে কৃষক। এতে করে বোরো ও আমনের ভরা মৌসুমেও কৃষককে ধান বিক্রি করতে হয়েছে স্থানভেদে ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকা মণ দরে। অথচ এ সময়ে সরকার দেশের বাজারে চালের দাম না বাড়ানোর অজুহাত তুলে বেশি দামে আমদানিতেই আগ্রহী ছিল। এতে করে ফসলের ভরা মৌসুমে ধার-দেনা পরিশোধ করতে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে অপূরণীয় ক্ষতিতে পড়েছে কৃষক।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ মনে করেন, 'ভরা মৌসুমে ধান সংগ্রহের ঘোষণা না দেওয়ায় কৃষকদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়, যার প্রভাব ফসল চাষে অনাগ্রহ বাড়াবে।'
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. জহুরুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ফসলের ভালো ফলন ও দামের সুযোগ নিয়ে সরকার নীরবতা দেখালে সাময়িকভাবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদিতে দেশ উৎপাদন হারাবে। এ ছাড়া বাজারের নিয়ন্ত্রণ যাবে ফড়িয়াদের দখলে। আর সরকারের প্রতি আস্থা কমবে কৃষকের।' তিনি অভিযোগ করেন, 'মার্চ থেকে বোরো ধান কাটা শুরু হলেও সরকার বিলম্বে (এপ্রিল-মে মাসে) সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করে। এতে অভাবগ্রস্ত (ধান কেটে মাড়াই শেষেই বিক্রি করে বলে) কৃষকরা সরকারের ঘোষিত ন্যায্যমূল্য-বঞ্চিত হয়। লাভবান হয় ফড়িয়া, মজুদদার ও চালকল মালিকরা।'
কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, 'ধান চাষে খরচ ও লাভ হিসাব করে সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করা হয়। আর ধান ওঠার ভরা মৌসুমে ময়েশ্চার (আর্দ্রতা) বেশি থাকে, যা গুদামজাতের জন্য উৎকৃষ্ট হয় না। ফলে ধান শুকানোর পরই কেবল সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করা হয়। তবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রয়োজনে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য ধান ওঠার সময়ই ঘোষণা করার চেষ্টা করা হবে।'
No comments