চে গুয়েভারা থেকে গান্ধিঃ মোহসেন মাখমালবাফের জগৎ, ভাষান্তর- রুদ্র আরিফ
ভারতীয় সাংবাদিক বি হরিদাস ইরানি সিনেমা নির্মাতা মোহসেন মাখমালবাফের প্রথম যে সিনেমাটি দেখেছিলেন, সেটি হলো ‘অ্যা মোমেন্ট অব ইনোসেন্স’। সেই থেকে এই সিনেমাটি তার খুব পছন্দের। ২০০৪-এর জুলাইয়ে পরিবার নিয়ে মাখমালবাফ এসেছিলেন ভারতের সিনেফ্যান ফিল্ম ফ্যাস্টিভালে যোগ দিতে।
সেই সুযোগে মাখমালবাফের সঙ্গে তার সিনেমা জগতের ভ্রমণ নিয়ে অনেক চিন্তার একটা পূর্ণাঙ্গ আড্ডা দেন হরিদাস। আড্ডায় মাখমালবাফ বলেছেন সিনেমা বানানো স্টাইল, মিডিয়া, শিক্ষা, রাজনীতি আরো যা-যা তিনি পছন্দ করেন। আড্ডায় মাখমালবাফের কথাবার্তা এই ইরানি সিনেমা কিংবদন্তির নিজস্ব ওয়েব সাইট থেকে বাংলা করেছেন রুদ্র আরিফ
১. সিনেমা নির্মাতার কাজ
ছয়দিনের জন্য বিয়ে করেছিলেন, এমন দম্পতি আমাকে জন্ম দিয়েছেন। এই ছয়দিনের যেকোনো একদিন মার গর্ভে আমার সূচনা হয়েছিল, তারপর বাবা তাকে ফেলে চলে গেছেন। কিন্তু তারা দুজনই পরে আমার দখল নিতে লড়াই করেছেন। শেষমেষ বাবা অবশ্য আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তার কারাগারের মতো বাসায় কেটেছে আমার দেড়টা বছর।
ভালো ব্যাপার হলো, আমার খালা তখন আমাকে পড়াশোনা শেখানো শুরু করেন। পাশের বাড়ি থেকে তিনি আমার জন্য বই ধার নিয়ে আসতেন। তাই খুব তাড়াতাড়ি অনেক বই পড়া হয়ে গেছে আমার। সাহিত্য, ফিকশান, ধর্ম ইত্যাদির বই। ফিরে তাকালে মনে হয়, এই যে আমি ত্রিশটার মতো বই লিখে ফেলেছি, আমার এই লেখক হয়ে ওঠার পেছনে তখনকার বইপড়াও প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারিনি; এমনকি হাইস্কুলও শেষ করতে পারিনি আর্থিক টানাটানিতে। ১২ বছর বয়সে উপার্জন শুরু করতে হয়েছিল আমাকে। বাজার করা থেকে শুরু করে ম্যাগাজিনে কাজ করা, আর এখন যা করছি এর মধ্যে প্রায় ১৩ ধরনের চাকরি করেছি।
চাকরি জীবনের শুরুতে দেশের অবস্থা দেখে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এমনকি রাজনীতি শুরুও করে দিয়েছিলাম। চে গুয়েভারা দিয়ে প্রভাবিত হয়ে আমি ও আমার বন্ধুরা চেয়েছিলাম আমাদের সমাজটাকে বদলে দিতে, চেয়েছিলাম বিপ্লব। এরকমই এক কাজে আমি পুলিশকে আক্রমণ করে বসি। ছুরি মেরে অস্ত্র ছিনিয়ে নিই। ভাগ্য ভালো ছিল, পুলিশটা বেশি আহত হয়নি। শেষমেষ আমাকে ধরে জেলে ঢুকানো হয়। পরে এই ঘটনা সময়ের ব্যবধানে আমার মনে যে দাগ কেটেছে, তা নিয়েই ‘অ্যা মোমেন্ট অব ইননোসেন্স’ বানিয়েছিলাম।
যখন জেলে ঢুকি, ১৭ বয়স আমার। কারাগারে আটক ছিলাম ৫ বছর। এই সময়টাতে কী করে আমাদের সমাজকে বদলে দিতে পারি--- এসব নিয়ে অনেকভাবে ভেবেছি। তারপর আস্তে আস্তে, চে গুয়েভারারা প্রতি শ্রদ্ধা সমুন্নত রেখে বুঝতে পারলাম, আমি যে সমাজ বদলের কথা ভাবছি, সে সমাজ বদল কোনো সহিংসতা দিয়ে না আসাই ভালো। আর এক্ষেত্রে গান্ধীকে আমার মহানায়ক মনে হলো।
জেল থেকে বেরিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতি থেকে সংস্কৃতিতে সরিয়ে আনলাম। আমি বিশ্বাস করেছিলাম, এখনো বিশ্বাস করি, ইরানি সমাজের সমস্যাটা রাজনীতিতে না ; আর তা একটা সরকার বা সরকারীনীতি বদলে গেলেই সেরে যাবে না। সমস্যাটা সাংস্কৃতিক। মানুষের কিছু মানসিকতা, কিছু চিন্তার জায়গা বদলে দিতে পারলেই কেবল এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। ইরানি সমাজ বিশ্বাস করে, জীবনে পথ একটাই--- এক ভাষা, এক ক্ষমতা, এক সত্য। এই বিশ্বাস তাদের চরম প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে। তাই জেল থেকে বেরিয়ে গল্প, উপন্যাস, আর্টিক্যাল লিখতে শুরু করলাম; পরে বানাতে থাকলাম সিনেমা। অতঃপর বিপ্লব এলো। এক সঙ্গে জেলখাটা আমার বন্ধু রাষ্ট্রপতি হলো, প্রধানমন্ত্রী হলো। আমার বন্ধুরা বিপ্লব আনল, আর আমি আনলাম সামিরাকে [সামিরা মাখমালবাফ]। সামিরা যখন জন্মাল, আমার বয়স ২৩। আমি সাংস্কৃতিক জগতে আমার কাজের গতি বাড়িয়ে দিলাম।
২। নির্মাণ তো আয়না, জানালা না
বেশকিছু ফিচারফিল্ম আর শর্টফিল্ম বানিয়েছি। সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি ইরানি সিনেমায় নতুন স্টাইল পোক্ত করতে ভূমিকা রাখল এগুলো। আমার ও আরো কয়েকজন ভালো সিনেমা নির্মাতার বানানো সিনেমাগুলো ইরানি সিনেমায় নতুন ধারা সৃষ্টি করল। সারা দুনিয়া তা অভিবাদন জানিয়ে গ্রহণ করল। এর কারণ হলো, হলিউড ও বলিউডের ভঙ্গির চেয়ে একেবারেই আলাদা আমাদের নিজস্ব ভঙ্গি আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম। হলিউড আমার কাছে একটা কারখানা, একটা ইন্ডাস্ট্রি--- যেখানে বেশিরভাগ সিনেমারই বিষয় ও ভঙ্গি এক রকম। হলিউডের সিনেমায় নতুন কিছুর ছোঁয়া পাওয়া যায় অতিসামান্য মাত্রায়। তাদের কাছে এটা ব্যবসা, আর্ট না। তাদের সামাজিক সংস্কৃতি নিয়ে কিছুই করার নেই যেন। আমরা প্রকৃত ইরানি সংষ্কৃতির আরো কাছে যেতে চাই।
আমার কাছে আমাদের সিনেমা একটা আয়নার মতো। একটা আয়না, যার সামনে আমাদের জনগণের আত্মাকে আমরা হাজির করি, ফলে তারা আয়নার ভেতর দিয়ে নিজেদের দিকে তাকাতে পারে। যখন আপনি আয়নায় নিজেকে দেখবেন, তখন নিশ্চয়ই আপনার কিছু ব্যাপারকে বদলে ফেলতে চাইবেন? তার মানে, একজন সত্যটাকে আয়নার ভেতর দিয়ে দেখতে পারে। এটা কি আমি নাকি আমি নিজেকে যেমনটা ভেবে এসেছি-- সে? আর আপনি যদি বুঝতে পারেন আপনার চাওয়ার কিছু একটা আপনার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না, আপনি তাকে নিজের মধ্যে আনতে চাইবেন।
আমার বিবেচনায় সত্যজিৎ রায় হলেন ভারতীয় সিনেমার আয়না। তিনি ভারতীয় আত্মাকে তার নির্মাণ দিয়ে আয়নার সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন; কিন্তু বলিউডে আমি কোনো প্রকৃত ভারতীয় আত্মা খুঁজে পাইনি। হলিউডেও না। আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্রে যান, দেখবেন একদম আলাদা জীবন। কিন্তু তাদের সিনেমায় দেখবেন, বেশিরভাগ সময়ই কেউ না কেউ কাউকে না কাউকে খুন করছে। আমরা এখানে বসে কথা বলছি; আমাদের চারপাশে এবং এর বাইরে জীবন কিন্তু চলছেই। কিন্তু আপনি যদি বলিউডের সিনেমা দেখেন, দেখবেন বেশিরভাগ সময় কেউ না কেউ নাচছে কিংবা মারামারি করছে। তাদের বাস্তবজীবন কিন্তু এমন না। তাই এটা জনগণের সামনে কোনো আয়না না। খুব সম্ভবত হলিউড ও বলিউড হলো জানালার মতো। অলস সময়ে যে জানালায় উঁকি দিয়ে মানুষ হয়তো অন্যত্র আনন্দ খুঁজছে, আর তা দিয়ে অন্যরা ব্যবসা করছে। প্লিজ ভারত, বলিউডকে থামাও!
আমি ও আমার পরিবারের কাছে সিনেমা নির্মাণ হলো সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মানবিক কাজকারবার। এটা ব্যবসা না। ২০০৩ সালে সামিরা ভারত এসেছিল। আইএফএফআই প্রাইজ জিতে ১২,০০০ ডলার পেয়েছিল। টাকা সঙ্গে নিয়ে সে ফিরতে চায়নি ইরানে। সামিরার চেয়ে ভারতের গরিব বাচ্চাগুলোর এ টাকাটা বেশি দরকারি। তাই টাকাটা সে ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। একজন শিল্পীর অনেক টাকা বা খ্যাতির দরকার নেই; তার দরকার হৃদয়, অনুভূতি ও সততা।
৩. বাস্তবতা থেকে কাহিনী বানানো
আমার কাছে আমাদের সিনেমা একটা আয়নার মতো। একটা আয়না, যার সামনে আমাদের জনগণের আত্মাকে আমরা হাজির করি, ফলে তারা আয়নার ভেতর দিয়ে নিজেদের দিকে তাকাতে পারে। যখন আপনি আয়নায় নিজেকে দেখবেন, তখন নিশ্চয়ই আপনার কিছু ব্যাপারকে বদলে ফেলতে চাইবেন? তার মানে, একজন সত্যটাকে আয়নার ভেতর দিয়ে দেখতে পারে। এটা কি আমি নাকি আমি নিজেকে যেমনটা ভেবে এসেছি-- সে? আর আপনি যদি বুঝতে পারেন আপনার চাওয়ার কিছু একটা আপনার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না, আপনি তাকে নিজের মধ্যে আনতে চাইবেন।
আমার বিবেচনায় সত্যজিৎ রায় হলেন ভারতীয় সিনেমার আয়না। তিনি ভারতীয় আত্মাকে তার নির্মাণ দিয়ে আয়নার সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন; কিন্তু বলিউডে আমি কোনো প্রকৃত ভারতীয় আত্মা খুঁজে পাইনি। হলিউডেও না। আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্রে যান, দেখবেন একদম আলাদা জীবন। কিন্তু তাদের সিনেমায় দেখবেন, বেশিরভাগ সময়ই কেউ না কেউ কাউকে না কাউকে খুন করছে। আমরা এখানে বসে কথা বলছি; আমাদের চারপাশে এবং এর বাইরে জীবন কিন্তু চলছেই। কিন্তু আপনি যদি বলিউডের সিনেমা দেখেন, দেখবেন বেশিরভাগ সময় কেউ না কেউ নাচছে কিংবা মারামারি করছে। তাদের বাস্তবজীবন কিন্তু এমন না। তাই এটা জনগণের সামনে কোনো আয়না না। খুব সম্ভবত হলিউড ও বলিউড হলো জানালার মতো। অলস সময়ে যে জানালায় উঁকি দিয়ে মানুষ হয়তো অন্যত্র আনন্দ খুঁজছে, আর তা দিয়ে অন্যরা ব্যবসা করছে। প্লিজ ভারত, বলিউডকে থামাও!
আমি ও আমার পরিবারের কাছে সিনেমা নির্মাণ হলো সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মানবিক কাজকারবার। এটা ব্যবসা না। ২০০৩ সালে সামিরা ভারত এসেছিল। আইএফএফআই প্রাইজ জিতে ১২,০০০ ডলার পেয়েছিল। টাকা সঙ্গে নিয়ে সে ফিরতে চায়নি ইরানে। সামিরার চেয়ে ভারতের গরিব বাচ্চাগুলোর এ টাকাটা বেশি দরকারি। তাই টাকাটা সে ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। একজন শিল্পীর অনেক টাকা বা খ্যাতির দরকার নেই; তার দরকার হৃদয়, অনুভূতি ও সততা।
৩. বাস্তবতা থেকে কাহিনী বানানো
আমাদের সিনেমা বানানোর পথটা খুবই প্রাকৃতিক। অনেক সময় আমরা কোনো রকম লিখিত স্ক্রিপ্ট ছাড়াই কাজ করি। যখন আপনার কাছে একটা পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট থাকবে, কাজ করার সময় সেটা আপনার মনে অনেক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে জ্বালাতন করতে পারে। কিন্তু আপনার কাছে যদি শুধু আউটলাইনটা থাকে, তাহলে নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা যায়। আমরা আমাদের স্ক্রিপ্টে বাতাসকে বইয়ে যেতে দেই, তারপর দেখি বাস্তবতা বা রিয়্যালিটি নিজে নিজেই ঢুকে পড়ছে। এমনকি অভিনেতা নির্বাচনের সময়ও আমরা কাউকে খুঁজে বেড়াই না; ঘরে বসেই ঠিক করে ফেলি। আমরা খুঁজি চরিত্রকে। তারপর তাদের নিজের জীবনে ছেড়ে দেই। তাদের অভিজ্ঞতাকেও প্রবেশ করাই সিনেমায়। অনেক সময় অভিনেতা তাদের নিজস্ব সংলাপ ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। বাস্তবতার খুব কাছাকাছি সিনেমাকে নিয়ে যেতেই এ প্রচেষ্টা। এটা আমাদের কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনেক সময় শুটিং শেষ হওয়ার আগে আমাদের সিনেমার প্রধান চরিত্রও সিনেমারটির মূল গল্প জানতে পারে না। অভিনেতারা প্রতিনিয়ত কাজের ভেতর দিয়ে গল্পটা একটু একটু করে ধরতে পারে এবং সিনেমাটাকে আত্মস্থ করে ফেলে। শুরু থেকেই সব জেনে ফেললে তাদের পারফর্মেন্স আর্টিফিসিয়াল হয়ে যেতে পারে।
আমাদের ক্যামেরাও বাস্তবতার একদম কাছাকাছি চলে। আমরা খালি চোখে যা দেখি, তারই চিত্রায়ণ করি; ফলে অনেকেই ডকুমেন্টারির সঙ্গে এগুলোকে গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু না! সবকিছুই পরিকল্পনা করে বানানো। এই বানানোটা হয় আমাদের চারপাশের বাস্তবতা নিয়ে। তাই হয়তো আমাদের সিনেমাকে ডকুমেন্টারি ও ফিকশনের মাঝামাঝি কিছু বলা যেতে পারে। অনেকটা ইতালিয়ান নিও রিয়্যালিস্ট সিনেমার মতো। ওগুলোও প্রাত্যহিক জীবনের খুব কাছাকাছি থাকত। সেট, ম্যাক আপ, লাইটিং সহ আরো যা যা লাগে সিনেমা বানাতে, সবকিছুর কথা ভুলে যান। এটা এক ধরনের সিনেমা, আমাদের ধরনের সিনেমা, কিন্তু কথিত কোনো সিনেমাটিক সিনেমা না। সেখানে সব ধরনের ব্যাপার থাকবে। যদি এক ধরনের সিনেমা থাকে, তাহলে সেটা পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু না। আর সিনেমা উৎসবগুলো হলো বিভিন্ন আঙ্গিকের সিনেমা দেখার গণতান্ত্রিক জায়গা।
৪. নিজের ওপর বিশ্বাস রাখার শিক্ষা
স্কুলে পড়ার সময় ইরানি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক হতাশ ছিল সামিরা। সবকিছুতেই ধর্ম। ভাষায় ধর্ম, ভূগোলে ধর্ম, বিজ্ঞানে ধর্ম, অঙ্কে ধর্র্ম। এরকম পড়াশোনায় সামিরা অনেকটা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল, এমনকি কয়েকবার মরে যেতেও চেয়েছিল। ওর আচরণে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। ওকে পড়াশোনা থামাতে বললাম। ও জানাল, ও সিনেমা বানাতে চায়। ঐ সময়ে আমি ইরানি সরকারের কাছে একটা ফিল্ম স্কুল খোলার অনুমতি চেয়ে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই স্কুলে এক হাজার শিশুকে সিনেমা বানানো শিখাতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু সরকার আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাই আমরা বাড়িতেই একটা ছোট্ট প্রাইভেট ফিল্ম স্কুল চালু করেছিলাম। আমরা একে ‘মাখমালবাফ ফিল্ম হাউস’ বলতাম। এই নামের পেছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে। আমার ‘অ্যা মোমেন্ট অব ইনোসেন্স’ সিনেমার কাজ যখন শেষ করেছি, তখন সরকার থেকে জানানো হলোÑ আমরা যদি কোনো থিয়েটারে এটা দেখাতে চাই, তাহলে অনেক অংশ সেন্সর করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার প্রযোজক এতে রাজি হয়ে গেল। কারণ, সে অনেক টাকা লগ্নি করেছিল। কিন্তু আমি এটা মানতে পারলাম না। আমি প্রযোজককে জানালাম, টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে সিনেমাটা কিনে নেব। আমি আমার স্ত্রী মারজিয়েহ, সন্তান সামিরা, মাইসাম আর হানাকে ডাকলাম। তাদের জানালাম, আমাদের সামনে দুইটা রাস্তা আছে। এক. সিনেমাটা রেখে বাড়িটা বেচে দেওয়া। দুই. বাড়িটা রেখে সিনেমাটাকে সেন্সর করার জন্য ওদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। ওরা বলল সিনেমাটা রেখে দিতে। বাড়ি বেচে দিলাম আমি। সেই টাকায় সিনেমাকে রেখে দিলাম। এরপর থেকে ‘মাখমালবাফ ফিল্ম হাউস’ নামটাই শুধু আছে; বাড়ির কোনো কাঠামো বা শারীরিক অস্তিত্ব নেই। এর বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই আমার নিজের পরিবারের মানুষ। আমার স্ত্রী, সামিরা, মাইসাম, হানা আর আমার কয়েক বন্ধু। আমাদের স্কুলটাও গতানুগতিক স্কুল ছিল না। এখানে রান্না করা, সাঁতার কাটা, ভ্রমণসহ সিনেমা বানানোতে যা যা লাগে সেসব শেখানো হতো। সচেতনভাবে আমি কেবল একটা জিনিস উসকে দিতাম; তা হলো : তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর ক্ষমতা। গতানুগতিক শিক্ষা-ব্যবস্থায় আমরা শিশুদের আত্মবিশ্বাসকে খুন করে ফেলি; কারণ, আগে কেউ একজন পেয়েছে এমন জিনিস আমরা পুনরাবৃত্তি করতে থাকি। যা আগেই পাওয়া হয়ে গেছে তা যদি অনুসরণ করি, তাহলে কেন আমরা পৃথিবীতে আছি? আমি বিশ্বাস করি, আত্মবিশ্বাস বাড়ানো কোনো শিক্ষা নেওয়া গেলেই অলৌকিক কিছু পাওয়ার আশা করতে পারে কেউ, তার আগে না।
৫. তীব্র ঝড়ে সুদৃঢ়ভাবে টিকে থাকা
মানুষকে কোনো ম্যাসেজ দিতে না, এমনকি তাদের সামনে বাস্তবতা তুলে ধরার জন্যও সিনেমা বানাই না আমি। আমি বাস্তবতার ভিন্ন অবস্থান দেখাতে চাই। কেননা, সেখানে সত্যের মতো কিছু নেই। সত্য কেবল একপাক্ষিক না, সত্যের আরেকটা দিকও সেখানে আছে। আমি সত্যের আলাদা দিক দর্শকদের দেখাতে চাই, যাতে তারা আরো বেশি গণতান্ত্রিক চিন্তার হয়। ইরানে একটা কথা আছে--- সত্য হলো স্রষ্টার হাতের এক আয়না, যা ভেঙ্গে গেছে। আর আমরা সবাই তার একটা টুকরো পেয়েছি। আমরা ভাবি, আমাদের হাতে যা আছে তা-ই সত্য। নাহ্! সবার হাতেই সত্যের টুকরো বা ভগ্নাংশ আছে। আপনি হয়তো বলতে পারেন, আপনার হাতে যে টুকরো আছে, তাতেই আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন; কিন্তু কেবল তাকেই আপনি সত্য বলতে পারেন না। আপনি যদি ভাবেন, সত্য কেবল এক ধরনের হয়; তাহলে সেখানে কোনো গণতন্ত্র, কোনো আলাপ চলে না। আমার কাছে সিনেমা হলো আলাপ বা কথোপকথন।
এই শতাব্দিতে স্যাটেলাইট টেলিভিশন মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। তারা যা জানে, তা-ই আমাদের জানাচ্ছে। কিন্তু তারা যা নিয়ে চিন্তা করতে চায় না, তা আমাদের জানাচ্ছে না। তারা ১১ সেপ্টেম্বরের [যুক্তরাষ্ট্রে টুইন-টাওয়ার হামলা বা নাইন-ইলেভেন] আগের আফগানিস্তান নিয়ে আমাদের জানাতে চায় না। ১১ সেপ্টেম্বরের পরে তারা আমাদের বলেছে, তারা আফগানিস্তানের দিকে মন দিচ্ছে। কিন্তু এক বছর পর আবার আমাদের জানিয়েছে, এখন থামতে হবে। এখন ইরাকের দিকে মন দেওয়ার সময় হয়েছে। কিছু সময় যাওয়ার পর তারা ইরাক প্রসঙ্গেও আমাদের থামিয়ে দেবে। বলবে, এখন সময় হয়েছে আরেক সত্যের দিকে মনোযোগী হওয়ার। আফগান নারীরা ইসলামী বোরখার নিচে; আর আমরা আছি সিএনএন ও বিবিসির বোরখার নিচে। আমাদের এ বোরখা ছিড়ে ফেলে বেরিয়ে আসা উচিত। প্রকৃত সিনেমা দিয়েই স্যাটেলাইটের এ জাল থেকে বেরুনো সম্ভব। কেননা, সিনেমা সত্যের আরেক দিকে মন দেয়, আর আমাদের প্রভাবিত করে ক্ষমতাধরের হাতে নাচতে থাকা মিডিয়ার প্রলোভন থেকে বেরিয়ে নিজেদের চিন্তাশক্তিকে যাচাই করে নিতে। ভালো একটা পৃথিবীর লক্ষ্যে আমাদের মুক্তচিন্তার চর্চা শুরু করা জরুরি।
সহজ না এটা। যে সময়ে আমরা বেঁচে আছি, বাতাস সবদিক থেকে বেশ জোরালোভাবেই বইছে। কিন্তু আমরা যদি নিজেদের জন্য ভাবতে পারি, যদি গভীরভাবে ভাবতে পারি, আমরা দৃঢ়চেতা হতে পারব। দাঁড়াতে পারব নিজের পায়ের উপর। কোনো বাতাসই আমাদের অন্যত্র উড়িয়ে নিতে পারবে না।
৬. সিনেমা নির্মাতা থেকে সক্রিয় কর্মী
৩০ বছর সিনেমা বানানোর পর আমি বুঝতে পারলাম, সিনেমা বানানোই যথেষ্ট কিংবা একমাত্র পথ না। আপনি যদি মুহূর্তের জন্য গরিব মানুষ নিয়ে সিনেমা বানান, আপনি তাদের ভুলে যেতে পারবেন না; পরের সিনেমায়ও এর রেশ থাকবে। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক কিছু বিষয়ও বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকতে হবে আপনার নির্মাণে। ১১ সেপ্টম্বরের দুই বছর আগে তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানের হেরাত শহরে একটা গোপন ভ্রমণ করেছিলাম। ক্ষুধা ও নিপীড়নে বিশ হাজারেরও বেশি মানুষকে রাস্তার পাশে পরে পরে মরতে দেখে থমকে গিয়েছিলাম আমি। তখন সারা দুনিয়াকে এই চিত্র জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ‘কান্দাহার’ সিনেমাটা যদি দেখেন, বুঝবেন, এটা কেবলই সিনেমা না। রাষ্ট্র যা ভুলে গেছে, এমন অজস্র তথ্য জানাচ্ছে এটা। ‘দ্য বুদ্ধ ওয়াজ নট ডিমুলিশড ইন আফগান, ইট কল্যাপসড আউট অব শেইম ’ [আফগানে বুদ্ধের বিনাশ হয়নি, এটা লজ্জায় ভেঙ্গে পড়েছে] শিরোনামে একটা বই লিখেছিলাম। ক্যানেস সিনেমা উৎসবে কয়েক কপি নিয়ে গিয়েছিলাম। সিনেমা বানানো নিয়ে যে সাংবাদিকরা আমাকে প্রশ্ন করেছে, তাদের বইটা দিয়ে দিছি। ওই উৎসবে ৩০০টার মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম আমি। প্রত্যেকটা সাক্ষাৎকারের পরপরই বইটা দিয়ে তাদের বলেছি-- এই দেশটাকে পৃথিবী ভুলে গেছে; প্লিজ আফগানিস্তানকে নিয়ে লিখুন, নিপীড়িত আফগান মানুষদের নিয়ে লিখুন। কিন্তু বেশিরভাগ সাংবাদিকই বিষয়টা বুঝতে পারেনি। অনেকেই বিশ্বাস করেনি পৃথিবীতে এমনটা হতে পারে। তিন মাস পর ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ঘটল। আর মুহূর্তেই অজস্র নজর পড়ল আফগানিস্তানের দিকে। সবগুলো স্যাটেলাইট চ্যানেল জুড়েই আফগানিস্তান। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ছিল কেবল বলার জন্য বলা।
আফগান মানুষের ১১ সেপ্টেম্বরের পরবর্তী অবস্থান বদলে দিতে আমি কিছু কাজের চেষ্টা করেছি। ইরানে আশ্রয় নেওয়া আফগান শরণার্থী শিশুরা, যারা ভিসা বা পর্যাপ্ত বৈধ ডকুমেন্টের অভাবে স্কুলে পড়তে যেতে পারেনি না, তাদের উপর ‘আফগান অ্যালফাবেট’ নামে একটা ডকুমেন্টারি বানিয়েছি। ইরানি আইনের কারণে গত আট বছরে সাত লক্ষ শিশু স্কুলে যেতে পারেনি। আমার কাছে এ বিষয়টাকে আফগানিস্তানের তালেবান নীতির মতো মনে হয়েছে। ইরানি সরকারের সঙ্গে এটা নিয়ে টানা তিন মাস কথা বলেছি এবং ইরানে ও ইরানের বাইরে সিনেমাটা দেখিয়েছি। শেষমেষ ইরান সরকারের মত বদলাতে পেরেছি। ২০০৩-এ পাঁচ লক্ষ আফগান শিশু ইরানের স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছে। আফগানিস্তানেও একই অবস্থা ছিল। ৯৮% নারী আর ৮০% পুরুষ তালেবান শাসনামলে স্কুলে যেতে পারেনি। তাই তিন বছর আমি সিনেমা বানানো থামিয়ে আফগান শিশুদের শিক্ষা, স্কুল স্থাপন, শিক্ষক খোঁজা ইত্যাদি সম্পর্কিত ৮০টির মতো প্রজেক্টে কাজ করেছি। আমি আমার সব সম্পদ, অ্যাওয়ার্ডের সব টাকা এতে খরচ করেছি। আমার কাছে এটা সিনেমা বানানোর চেয়েও ভালো কিছু।
আমাদের ক্যামেরাও বাস্তবতার একদম কাছাকাছি চলে। আমরা খালি চোখে যা দেখি, তারই চিত্রায়ণ করি; ফলে অনেকেই ডকুমেন্টারির সঙ্গে এগুলোকে গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু না! সবকিছুই পরিকল্পনা করে বানানো। এই বানানোটা হয় আমাদের চারপাশের বাস্তবতা নিয়ে। তাই হয়তো আমাদের সিনেমাকে ডকুমেন্টারি ও ফিকশনের মাঝামাঝি কিছু বলা যেতে পারে। অনেকটা ইতালিয়ান নিও রিয়্যালিস্ট সিনেমার মতো। ওগুলোও প্রাত্যহিক জীবনের খুব কাছাকাছি থাকত। সেট, ম্যাক আপ, লাইটিং সহ আরো যা যা লাগে সিনেমা বানাতে, সবকিছুর কথা ভুলে যান। এটা এক ধরনের সিনেমা, আমাদের ধরনের সিনেমা, কিন্তু কথিত কোনো সিনেমাটিক সিনেমা না। সেখানে সব ধরনের ব্যাপার থাকবে। যদি এক ধরনের সিনেমা থাকে, তাহলে সেটা পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু না। আর সিনেমা উৎসবগুলো হলো বিভিন্ন আঙ্গিকের সিনেমা দেখার গণতান্ত্রিক জায়গা।
৪. নিজের ওপর বিশ্বাস রাখার শিক্ষা
স্কুলে পড়ার সময় ইরানি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক হতাশ ছিল সামিরা। সবকিছুতেই ধর্ম। ভাষায় ধর্ম, ভূগোলে ধর্ম, বিজ্ঞানে ধর্ম, অঙ্কে ধর্র্ম। এরকম পড়াশোনায় সামিরা অনেকটা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল, এমনকি কয়েকবার মরে যেতেও চেয়েছিল। ওর আচরণে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। ওকে পড়াশোনা থামাতে বললাম। ও জানাল, ও সিনেমা বানাতে চায়। ঐ সময়ে আমি ইরানি সরকারের কাছে একটা ফিল্ম স্কুল খোলার অনুমতি চেয়ে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই স্কুলে এক হাজার শিশুকে সিনেমা বানানো শিখাতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু সরকার আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাই আমরা বাড়িতেই একটা ছোট্ট প্রাইভেট ফিল্ম স্কুল চালু করেছিলাম। আমরা একে ‘মাখমালবাফ ফিল্ম হাউস’ বলতাম। এই নামের পেছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে। আমার ‘অ্যা মোমেন্ট অব ইনোসেন্স’ সিনেমার কাজ যখন শেষ করেছি, তখন সরকার থেকে জানানো হলোÑ আমরা যদি কোনো থিয়েটারে এটা দেখাতে চাই, তাহলে অনেক অংশ সেন্সর করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার প্রযোজক এতে রাজি হয়ে গেল। কারণ, সে অনেক টাকা লগ্নি করেছিল। কিন্তু আমি এটা মানতে পারলাম না। আমি প্রযোজককে জানালাম, টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে সিনেমাটা কিনে নেব। আমি আমার স্ত্রী মারজিয়েহ, সন্তান সামিরা, মাইসাম আর হানাকে ডাকলাম। তাদের জানালাম, আমাদের সামনে দুইটা রাস্তা আছে। এক. সিনেমাটা রেখে বাড়িটা বেচে দেওয়া। দুই. বাড়িটা রেখে সিনেমাটাকে সেন্সর করার জন্য ওদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। ওরা বলল সিনেমাটা রেখে দিতে। বাড়ি বেচে দিলাম আমি। সেই টাকায় সিনেমাকে রেখে দিলাম। এরপর থেকে ‘মাখমালবাফ ফিল্ম হাউস’ নামটাই শুধু আছে; বাড়ির কোনো কাঠামো বা শারীরিক অস্তিত্ব নেই। এর বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই আমার নিজের পরিবারের মানুষ। আমার স্ত্রী, সামিরা, মাইসাম, হানা আর আমার কয়েক বন্ধু। আমাদের স্কুলটাও গতানুগতিক স্কুল ছিল না। এখানে রান্না করা, সাঁতার কাটা, ভ্রমণসহ সিনেমা বানানোতে যা যা লাগে সেসব শেখানো হতো। সচেতনভাবে আমি কেবল একটা জিনিস উসকে দিতাম; তা হলো : তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর ক্ষমতা। গতানুগতিক শিক্ষা-ব্যবস্থায় আমরা শিশুদের আত্মবিশ্বাসকে খুন করে ফেলি; কারণ, আগে কেউ একজন পেয়েছে এমন জিনিস আমরা পুনরাবৃত্তি করতে থাকি। যা আগেই পাওয়া হয়ে গেছে তা যদি অনুসরণ করি, তাহলে কেন আমরা পৃথিবীতে আছি? আমি বিশ্বাস করি, আত্মবিশ্বাস বাড়ানো কোনো শিক্ষা নেওয়া গেলেই অলৌকিক কিছু পাওয়ার আশা করতে পারে কেউ, তার আগে না।
৫. তীব্র ঝড়ে সুদৃঢ়ভাবে টিকে থাকা
মানুষকে কোনো ম্যাসেজ দিতে না, এমনকি তাদের সামনে বাস্তবতা তুলে ধরার জন্যও সিনেমা বানাই না আমি। আমি বাস্তবতার ভিন্ন অবস্থান দেখাতে চাই। কেননা, সেখানে সত্যের মতো কিছু নেই। সত্য কেবল একপাক্ষিক না, সত্যের আরেকটা দিকও সেখানে আছে। আমি সত্যের আলাদা দিক দর্শকদের দেখাতে চাই, যাতে তারা আরো বেশি গণতান্ত্রিক চিন্তার হয়। ইরানে একটা কথা আছে--- সত্য হলো স্রষ্টার হাতের এক আয়না, যা ভেঙ্গে গেছে। আর আমরা সবাই তার একটা টুকরো পেয়েছি। আমরা ভাবি, আমাদের হাতে যা আছে তা-ই সত্য। নাহ্! সবার হাতেই সত্যের টুকরো বা ভগ্নাংশ আছে। আপনি হয়তো বলতে পারেন, আপনার হাতে যে টুকরো আছে, তাতেই আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন; কিন্তু কেবল তাকেই আপনি সত্য বলতে পারেন না। আপনি যদি ভাবেন, সত্য কেবল এক ধরনের হয়; তাহলে সেখানে কোনো গণতন্ত্র, কোনো আলাপ চলে না। আমার কাছে সিনেমা হলো আলাপ বা কথোপকথন।
এই শতাব্দিতে স্যাটেলাইট টেলিভিশন মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। তারা যা জানে, তা-ই আমাদের জানাচ্ছে। কিন্তু তারা যা নিয়ে চিন্তা করতে চায় না, তা আমাদের জানাচ্ছে না। তারা ১১ সেপ্টেম্বরের [যুক্তরাষ্ট্রে টুইন-টাওয়ার হামলা বা নাইন-ইলেভেন] আগের আফগানিস্তান নিয়ে আমাদের জানাতে চায় না। ১১ সেপ্টেম্বরের পরে তারা আমাদের বলেছে, তারা আফগানিস্তানের দিকে মন দিচ্ছে। কিন্তু এক বছর পর আবার আমাদের জানিয়েছে, এখন থামতে হবে। এখন ইরাকের দিকে মন দেওয়ার সময় হয়েছে। কিছু সময় যাওয়ার পর তারা ইরাক প্রসঙ্গেও আমাদের থামিয়ে দেবে। বলবে, এখন সময় হয়েছে আরেক সত্যের দিকে মনোযোগী হওয়ার। আফগান নারীরা ইসলামী বোরখার নিচে; আর আমরা আছি সিএনএন ও বিবিসির বোরখার নিচে। আমাদের এ বোরখা ছিড়ে ফেলে বেরিয়ে আসা উচিত। প্রকৃত সিনেমা দিয়েই স্যাটেলাইটের এ জাল থেকে বেরুনো সম্ভব। কেননা, সিনেমা সত্যের আরেক দিকে মন দেয়, আর আমাদের প্রভাবিত করে ক্ষমতাধরের হাতে নাচতে থাকা মিডিয়ার প্রলোভন থেকে বেরিয়ে নিজেদের চিন্তাশক্তিকে যাচাই করে নিতে। ভালো একটা পৃথিবীর লক্ষ্যে আমাদের মুক্তচিন্তার চর্চা শুরু করা জরুরি।
সহজ না এটা। যে সময়ে আমরা বেঁচে আছি, বাতাস সবদিক থেকে বেশ জোরালোভাবেই বইছে। কিন্তু আমরা যদি নিজেদের জন্য ভাবতে পারি, যদি গভীরভাবে ভাবতে পারি, আমরা দৃঢ়চেতা হতে পারব। দাঁড়াতে পারব নিজের পায়ের উপর। কোনো বাতাসই আমাদের অন্যত্র উড়িয়ে নিতে পারবে না।
৬. সিনেমা নির্মাতা থেকে সক্রিয় কর্মী
৩০ বছর সিনেমা বানানোর পর আমি বুঝতে পারলাম, সিনেমা বানানোই যথেষ্ট কিংবা একমাত্র পথ না। আপনি যদি মুহূর্তের জন্য গরিব মানুষ নিয়ে সিনেমা বানান, আপনি তাদের ভুলে যেতে পারবেন না; পরের সিনেমায়ও এর রেশ থাকবে। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক কিছু বিষয়ও বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকতে হবে আপনার নির্মাণে। ১১ সেপ্টম্বরের দুই বছর আগে তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানের হেরাত শহরে একটা গোপন ভ্রমণ করেছিলাম। ক্ষুধা ও নিপীড়নে বিশ হাজারেরও বেশি মানুষকে রাস্তার পাশে পরে পরে মরতে দেখে থমকে গিয়েছিলাম আমি। তখন সারা দুনিয়াকে এই চিত্র জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ‘কান্দাহার’ সিনেমাটা যদি দেখেন, বুঝবেন, এটা কেবলই সিনেমা না। রাষ্ট্র যা ভুলে গেছে, এমন অজস্র তথ্য জানাচ্ছে এটা। ‘দ্য বুদ্ধ ওয়াজ নট ডিমুলিশড ইন আফগান, ইট কল্যাপসড আউট অব শেইম ’ [আফগানে বুদ্ধের বিনাশ হয়নি, এটা লজ্জায় ভেঙ্গে পড়েছে] শিরোনামে একটা বই লিখেছিলাম। ক্যানেস সিনেমা উৎসবে কয়েক কপি নিয়ে গিয়েছিলাম। সিনেমা বানানো নিয়ে যে সাংবাদিকরা আমাকে প্রশ্ন করেছে, তাদের বইটা দিয়ে দিছি। ওই উৎসবে ৩০০টার মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম আমি। প্রত্যেকটা সাক্ষাৎকারের পরপরই বইটা দিয়ে তাদের বলেছি-- এই দেশটাকে পৃথিবী ভুলে গেছে; প্লিজ আফগানিস্তানকে নিয়ে লিখুন, নিপীড়িত আফগান মানুষদের নিয়ে লিখুন। কিন্তু বেশিরভাগ সাংবাদিকই বিষয়টা বুঝতে পারেনি। অনেকেই বিশ্বাস করেনি পৃথিবীতে এমনটা হতে পারে। তিন মাস পর ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ঘটল। আর মুহূর্তেই অজস্র নজর পড়ল আফগানিস্তানের দিকে। সবগুলো স্যাটেলাইট চ্যানেল জুড়েই আফগানিস্তান। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ছিল কেবল বলার জন্য বলা।
আফগান মানুষের ১১ সেপ্টেম্বরের পরবর্তী অবস্থান বদলে দিতে আমি কিছু কাজের চেষ্টা করেছি। ইরানে আশ্রয় নেওয়া আফগান শরণার্থী শিশুরা, যারা ভিসা বা পর্যাপ্ত বৈধ ডকুমেন্টের অভাবে স্কুলে পড়তে যেতে পারেনি না, তাদের উপর ‘আফগান অ্যালফাবেট’ নামে একটা ডকুমেন্টারি বানিয়েছি। ইরানি আইনের কারণে গত আট বছরে সাত লক্ষ শিশু স্কুলে যেতে পারেনি। আমার কাছে এ বিষয়টাকে আফগানিস্তানের তালেবান নীতির মতো মনে হয়েছে। ইরানি সরকারের সঙ্গে এটা নিয়ে টানা তিন মাস কথা বলেছি এবং ইরানে ও ইরানের বাইরে সিনেমাটা দেখিয়েছি। শেষমেষ ইরান সরকারের মত বদলাতে পেরেছি। ২০০৩-এ পাঁচ লক্ষ আফগান শিশু ইরানের স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছে। আফগানিস্তানেও একই অবস্থা ছিল। ৯৮% নারী আর ৮০% পুরুষ তালেবান শাসনামলে স্কুলে যেতে পারেনি। তাই তিন বছর আমি সিনেমা বানানো থামিয়ে আফগান শিশুদের শিক্ষা, স্কুল স্থাপন, শিক্ষক খোঁজা ইত্যাদি সম্পর্কিত ৮০টির মতো প্রজেক্টে কাজ করেছি। আমি আমার সব সম্পদ, অ্যাওয়ার্ডের সব টাকা এতে খরচ করেছি। আমার কাছে এটা সিনেমা বানানোর চেয়েও ভালো কিছু।
No comments