শিক্ষা-শিক্ষা মন্ত্রণালয় জ্বালাচ্ছে আশার প্রদীপ by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জ্বালাচ্ছে আশার প্রদীপ। হচ্ছে না, হবে না রবের পরিবর্তে এ খাতে এখন শুধুই হচ্ছে কিংবা হবে 'ধ্বনি'। তবে এ প্রদীপের নিচেও আছে অন্ধকার। গত তিন বছরে শুধু এ মন্ত্রণালয়েরই নয়, পুরো সরকারের অন্যতম অর্জন 'অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি'। চমক দেওয়ার মতো কিছু উদ্যোগ থাকলেও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল না দেওয়ায়ও অসন্তোষ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমান সরকারের গত তিন বছরে শিক্ষা খাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন


পাস করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ, প্রথম শ্রেণীর ভর্তিতে লটারি পদ্ধতি অবলম্বন, প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে বছরের প্রথম দিনই নতুন বই দেওয়া, বছরের প্রথম দিনই ক্লাস শুরু করা, নতুন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করাসহ শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু কাজ প্রশংসিত হয়েছে। ইতিহাসবিদদের নিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিকৃত ইতিহাস সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন, মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজ ও পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল এবং ভর্তিতে অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহার সব মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। অন্যদিকে, গত তিন বছরে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, যানজট লাঘবের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, ইভ টিজিংয়ের নানা অঘটন ও সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের লাগামহীন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড, শিক্ষকদের শূন্যপদে এমপিওভুক্তি বন্ধ রাখার কারণে ওই সব ভালো উদ্যোগকে কিছুটা ম্লান করেছে। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষায় সব শিশুকে স্কুলে আনা হলেও ঝরেপড়া রোধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই। সাফল্য নেই দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার ক্ষেত্রেও।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিক্ষাক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জাতির ইতিহাসে প্রথম অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি হয়েছে। সে অর্থে বলা যায় এটা বড় অর্জন। এ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের ইতিবাচক উপাদান আছে। সংসদে পাস হওয়া শিক্ষানীতি নিয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিতর্কে জড়ায়নি। তবে অনেকেই বলেছেন, এটা বাস্তবায়ন কঠিন হবে। আমাদের তো কঠিন কাজই করতে হবে। নতুন প্রজন্মকেও কঠিন কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ শিক্ষানীতির পাশাপাশি গত বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে প্রায় ২৩ কোটি নতুন বই তুলে দেওয়া নিশ্চয়ই বড় কাজ ছিল। তবে আমার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষার মান বাড়ানো। মানসম্মত শিক্ষাই বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে আমিও মনে করি কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু আমি এ অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট নই।'
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর মোর্চা 'গণস্বাক্ষরতা অভিযান'-এর প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি হিসাবে সব শিশুকে স্কুলে আনার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। প্রায় ৯০ শতাংশ শিশুকে স্কুলে আনা হয়েছে। এ ছাড়া মানের ক্ষেত্রেও শিক্ষা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। গ্রাম-শহরের মধ্যে একটা বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে শিক্ষা একটি পণ্য হয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন।
শিক্ষাক্ষেত্রের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিতরণে কিছু ত্রুটি থাকলেও গত দুই বছরে প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে নতুন বই দেওয়া হয়। আগে কেবল প্রাথমিক স্তরে বিনা মূল্যে বই দেওয়া হতো। তবে সব নতুন বই নয়। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীকে নতুন বই দেওয়া হতো, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের অর্ধেক নতুন ও অর্ধেক পুরনো বই দেওয়া হতো। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকেই বিনা মূল্যে নতুন বই দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ চূড়ান্ত করা গত তিন বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বড় ধরনের কোনো বাধা ছাড়াই শিক্ষানীতি চূড়ান্ত হয়। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, শুধু চূড়ান্ত নয়, স্বাধীনতার পর এই প্রথম কোনো শিক্ষানীতি বাস্তবায়নও হতে চলল। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির হিসাব অনুসারে এটি বাস্তবায়ন করতে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা লাগবে। তা ছাড়া কিছু বিষয় আছে বেশ জটিল। সে হিসাবে এ শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন হবে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত, মাধ্যমিক শিক্ষা নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত করা এবং সব ধারার শিক্ষায় কিছু অভিন্ন বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানোসহ কিছু বিষয় বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ২০১০ সালে নতুন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি (শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ মাসিক সরকারি টাকা প্রদান)। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর স্থগিত থাকার পর ২০১০ সালের ৭ মে এক হাজার ৬২৪টি নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত হওয়ায় দলীয় নেতা-কর্মীর পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকার লোকজন ক্ষোভ-বিক্ষোভ করে। সংসদ সদস্যদের ক্ষোভের মুখে পড়েন শিক্ষামন্ত্রী। এরপর ২০১০ সালের ১০ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও বঞ্চিত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের তোপের মুখে পড়েন শিক্ষামন্ত্রী। বিষয়টি পুনর্মূল্যায়নের (রিভিউ) নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমেদের মধ্যে টানাপড়েন দেখা দেয়। একপর্যায়ে এমপিওভুক্তির পুরো দায়িত্ব উপদেষ্টার হাতে তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী। এরপর কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম সংযোজন-বিয়োজন করে ২০১০ সালের মে মাসের শেষে এমপিওভুক্ত করে আবারও আদেশ জারি করা হয়। পরে অবশ্য শিক্ষা উপদেষ্টার বিরুদ্ধেও অভিযোগ তোলেন ভুক্তভোগী অনেকেই। এরপর ২০১১ সালে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য বলা হলেও একটিও হয়নি।
২০১০ সালের আগস্টে যানজট নিরসনের পাশাপাশি রমজান মাসে ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকদের কষ্ট লাঘবে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি ও সমমানের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগাম ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। এতে প্রায় এক মাসের জন্য বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের দিকেও সরকারের নজর ছিল যথেষ্ট। দেশের ৩০টি মাদ্রাসাকে মডেল মাদ্রাসায় রূপান্তর করা, কিছু মাদ্রাসায় অনার্স চালু করা, প্রাথমিকের পাশাপাশি এবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু করাসহ কিছু বিষয় ছিল মাদ্রাসার জন্য একেবারেই নতুন। এ ছাড়া প্রায় এক হাজার মাদ্রাসায় নতুন ভবন নির্মাণের কাজেও হাত দেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতনও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমান করা হয়েছে। ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ফর মাদ্রাসা এডুকেশন প্রকল্পের আওতায় ১০০টি মাদ্রাসায় ভোকেশনাল শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়েছে এবং সাধারণ শিক্ষার অনুরূপ মাদ্রাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান ও কম্পিউটার শাখা চালু করা হয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আগের আইন রহিত করে নতুন আইন করাও ছিল ২০১০ সালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অনেকটা নমনীয়ভাবে আইন করা সত্ত্বেও মালিকদের পক্ষ থেকে তা বাস্তবায়নে অসহযোগিতা করার অভিযোগ ওঠে। আইনের আলোকে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার বিষয়ে মতামত নিয়ে মালিকরা টালবাহানা করতে থাকলে ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে শর্ত ভঙ্গকারী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা জারি করেন। শিক্ষামন্ত্রী জানান, যারা এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি তারা ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের পর নতুন করে আর কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে না। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর এ ঘোষণা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। অন্যদিকে নতুন কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও অনুমোদন দেয় সরকার।
কারিগরি শিক্ষার কারিকুলাম সময়োপযোগী করার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। পাশাপাশি ঢাকার তেজগাঁওয়ের টেঙ্টাইল কলেজকে টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। এ খাতের উন্নয়নে বড় মাপের কিছু প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে।
২০১০ সালে অষ্টম শ্রেণী পড়াশোনা শেষ করা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা। একই সঙ্গে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষাও প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়। আর ২০০৯ সালে শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষাসমাপনী পরীক্ষা। পরীক্ষাগুলোয় পাসের হারও ভালো।
চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৩৯ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ঞছও প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ৯৮ হাজার জন শ্রেণী শিক্ষক, ১৬ হাজার ৫০০ জন প্রধান শিক্ষক, ৪৫ হাজার স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য এবং এক হাজার ১০০ জন শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান সরকারের সময় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে শ্রেণী পাঠদান কার্যক্রম বিটিভির মাধ্যমে প্রচার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন জনের সহায়তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুপুরের টিফিন সরবরাহের উদ্যোগটিও ইতিবাচক। দরিদ্র অথচ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা সহায়তা প্রদানের জন্য 'প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড' গঠনপূর্বক এ ফান্ডে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বছরের শেষ দিকে জাতীয়করণের দাবিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলে। নভেম্বর মাসে ঘোষণা দিয়ে ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ থেকে কয়েক হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের অবস্থান কর্মসূচি হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। একপর্যায়ে ২৭ ডিসেম্বর শিক্ষকরা আত্মাহুতির ঘোষণা দিলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফসারুল আমিন তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বাড়ি ফেরান। কিন্তু ১৫ জানুয়ারির মধ্যে চাকরি জাতীয়করণ করা না হলে স্কুলগুলোয় তালা ঝুলবে বলে ঘোষণা দিয়েই মাঠ ছাড়েন তাঁরা।

No comments

Powered by Blogger.