রমনায় শীতসকালে প্রাণের উচ্ছ্বাস by এসএম মুন্না

'দিন ধরে শীতের তীব্রতা তেমন অনুভূত না হলেও গতকাল শুক্রবার ভোরে হঠাৎ বৃষ্টিতে আবারও জেঁকে বসে শীত। দিনের বেশিরভাগ সময় কুয়াশায় ঢাকা ছিল সূর্য। সঙ্গে ছিল হিমেল হাওয়া। অবশ্য ছুটির দিনে এমন হিমেল হাওয়ায় স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ ছাড়া ঘর থেকে তেমন কেউ বের হন না। তবে বছরের প্রথম শুক্রবারটির কথা আলাদা। এদিন কাকডাকা ভোরেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন সংস্কৃতিকর্মীরা। কারণ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক উৎসবগুলোর একটি পৌষমেলার


প্রথমদিন ছিল গতকাল। রমনার অশথমূলে (বটমূল নয়) যখন সংস্কৃতিকর্মীরা এসে জড়ো হচ্ছিলেন, তখনও দেখা নেই সূর্যের। কুয়াশাচ্ছন্ন সবুজ রমনা পাখিদের কলকাকলিতে মুখর। অন্যান্য দিনের চেয়ে মানুষের উপস্থিতি বেশি থাকায় পাখিদের কোলাহলও যেন মনে হচ্ছিল বেশি। গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষ যেমন মাটির পাত্রে তুষে আগুন জ্বেলে শরীর উষ্ণ করেন, তেমনি নিজেদের উষ্ণ করতে এবং পৌষমেলার উদ্বোধনের জন্য মাটির পাত্রে আগুন জ্বালানোর আয়োজনেও ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেক সংস্কৃতিকর্মী।
বৃষ্টির কারণে নির্ধারিত সময়ে মেলার উদ্বোধন সম্ভব হয়নি। ঘড়ির কাঁটা ডানে যত ঘুরেছে ততই মেলা প্রাঙ্গণে বাড়তে থাকে
সংস্কৃতিপ্রেমীদের ভিড়। ছুটির দিনে অনেকেই পুরো পরিবার নিয়ে এসেছিলেন এ উৎসবে শামিল হতে। গান, নাচ, আবৃত্তিতে যখন মেলা বেশ জমে উঠতে শুরু করেছে, তখন নিজেদের আরও চাঙ্গা করতে গরম গরম পিঠা ও চায়ে চুমক দিয়ে নিচ্ছিলেন উৎসবে আগতরা। পৌষের পুরো আমেজ নিয়েই মেলা প্রাঙ্গণে পিঠাপুলির আয়োজন সাজিয়ে বসেছিল ৩৫টি স্টল। এসব স্টলে শুধু পিঠাই নয়, ছিল নানা ধরনের খাবার, মধু, বুটিকের পোশাক ইত্যাদি। গরম গরম ভাপা, চিতই ও তেলের পিঠা ছাড়াও স্টলগুলোতে ছিল দুধরাজ, পুলি, পানতোয়া, পাটিসাপটা, ফুলঝুরি, মুখপ্রাসন, ঝালপিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, খেজুরের পিঠা, সেমাই, মেরা পিঠা, পাকান পিঠা, রস পিঠা, নারকেল পিঠা, চিড়ার মোয়া, কাউনের মোয়া, ঝালপোয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া এ যান্ত্রিক নগরীতে প্রায় দুষ্প্রাপ্য খেজুরের রসের স্বাদও গ্রহণ করেছেন অনেকে।
পিঠাপুলির স্বাদ গ্রহণ করতে করতে উৎসবে আগত অতিথিরা উপভোগ করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান 'পৌষ এলো গো, পৌষ এলো'। সম্মেলক কণ্ঠে গানটি পরিবেশন করে 'নিবেদন'। এরপর সঙ্গীত পরিবেশন করেন নাসিমা শাহিন ফেন্সি, সফিউল আলম রাজা, ফকির আলমগীর, রূপু খান, নার্গিস চৌধুরী, আবুবকর সিদ্দিক ও বুলবুল ইসলাম। দলীয় নৃত্যে অংশ নেয় স্পন্দন ও নটরাজ। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন বেলায়েত হোসেন ও লায়লা আফরোজ।
পাখিদের কলকাকলি আর শিল্পীদের নাচ, গান, আবৃত্তিতে যখন মুখরিত হয়ে ওঠে রমনার অশথমূল, ঠিক তখনই পৌষমেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য মঞ্চে আসেন উদ্বোধক বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ও লোক গবেষক শামসুজ্জামান খান। 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে' স্লোগান নিয়ে শাশ্বত বাংলার সেই চিরায়ত নিয়মেই মাটির পাত্রে আগুন জ্বেলে পৌষমেলার উদ্বোধন করেন তিনি। এ সময় আবৃত্তিকার রফিকুল ইসলাম পাঠ করেন শীতের কবিতা 'হে শীতের সূর্য'। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন চৌধুরী সামসুল হুদা সেলিম।
পৌষমেলার এ পর্ব চলে সকাল ১১টা পর্যন্ত। পর্বটি সরাসরি সম্প্রচার করে চ্যানেল আই। বিকেলের পর্বে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন অনুপ ভট্টাচার্য, নাদিরা বেগম, সালাউদ্দিন আহমেদ, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, মহাদেব ঘোষ, আজগর আলীম প্রমুখ। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে ঋষিজ, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, স্বভূমি লেখক শিল্পী কেন্দ্র ও দৃষ্টি। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন আহকামউল্লাহ, শাহাদাৎ হোসেন নিপু, মাশকুর-ই-সাত্তার কল্লোল ও নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলি। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে মুক্তধারা আবৃত্তিচর্চা কেন্দ্র। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে দিব্য ও আচিক কালচারাল একাডেমী। লোকসঙ্গীত পরিবেশন করবেন কুষ্টিয়ার সমীর বাউল ও তার দল।
আজ মেলার দ্বিতীয় দিনেও রয়েছে দু'পর্বের অনুষ্ঠান।

No comments

Powered by Blogger.