জনপ্রশাসন-দিনবদলে ব্যর্থ প্রশাসন by আশরাফুল হক রাজীব

রকারের তিন বছরে প্রশাসন পুরনো বৃত্তে আটকে আছে। এ সময় নেওয়া সিদ্ধান্তে কোনো চমক নেই। মন্ত্রীদের প্রধানমন্ত্রী ও আমলাদের ওপর নির্ভরতা ছিল অতিমাত্রায়। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে চৌকস নেতৃত্ব না থাকায় ফাঁদে আটকা পড়েছে দিনবদলের সনদ। পদোন্নতিতে নিয়ম না মানায় প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। গুরুত্বহীন নথি নিষ্পত্তিতে সচিবরা যত সময় দিয়েছেন, তার চেয়ে কম সময় দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ নথি নিষ্পত্তিতে। গুরুত্বপূর্ণ নথি


এলেই তাঁরা মন্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে ছুটেছেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। সেখানেই সব সিদ্ধান্ত হয়। সব মিলিয়ে প্রশাসন ছিল 'নিয়ম না মানার প্রশাসন'। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই মহাজোট সরকার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে আস্থাভাজনদের বসায়। তাঁদের এসব জায়গায় বসাতে গিয়ে দফায় দফায় পদোন্নতি দিতে হয়েছে। এসব পদোন্নতিতে কোনো নীতিমালা অনুসরণ না করায় অনেক অযোগ্য লোকজন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসে পড়েছেন। দলীয় লেবাসে তাঁরা সেসব পদ দখল করে রাখলেও কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না সরকারের লক্ষ্য পূরণে। তাঁদের এসব পদে বসাতে সরকারকে গত তিন বছরে প্রায় এক হাজার জনকে পদোন্নতি দিতে হয়েছে। এসব দলীয় কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে প্রায় ৭০০ কর্মকর্তাকে সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও বঞ্চিত করা হয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাঁদের বঞ্চনা অবসানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও গত তিন বছরে তা হয়নি। এতে বঞ্চিত কর্মকর্তারা কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আর গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে যোগ্যতাহীন দলীয় কর্মকর্তারা সরকারের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে পারছেন না। এই দুইয়ে মিলে প্রশাসনে ভরাডুবি হয়েছে। পাশাপাশি পদোন্নতি দিতে গিয়ে নীতিমালা না মানায় সিনিয়ররা নিচে পড়ে গেছেন। আর জুনিয়ররা ওপরে উঠে গেছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এ ধরনের কর্মকর্তার সংখ্যা চার শতাধিক। অর্থাৎ তাঁরা সিনিয়র ও যোগ্য হয়েও পদের দিক থেকে জুনিয়র হয়ে আছেন। এসব কর্মকর্তা মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিদিন অফিস করেন। অফিসে গিয়ে চেষ্টা করেন কোনো রকমে দিনটি পার করার জন্য। কারণ কাজ করতে গেলেই তাঁর 'জুনিয়র বসের' নির্দেশনা শুনতে হবে। এতে করে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে।
জনপ্রশাসন সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান বলেছেন, প্রশাসন থেকে দলাদলি বন্ধ করতে না পারলে কিছুই হবে না। কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণেই প্রশাসন ব্যর্থ।
মহাজোট সরকারের ইমেজকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যেসব বিষয় তাদের মধ্যে অন্যতম হলো_যথাসময়ে কোনো নিয়োগ শেষ করতে না পারা। দলীয় লোকজনদের চাকরি দিতে এমপিরা তো বটেই, মন্ত্রীরা পর্যন্ত তালিকা নিয়ে তদবির করেছেন। এতে যোগ্য ও মেধাবীরা চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেননি। আর চাকরি হয়েছে যাঁরা সরকারদলীয় রাজনীতি করতেন তাঁদের। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের চাকরিও হয়নি। কারণ তালিকা চূড়ান্ত করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে। একমত হতে না পারায় অনেক নিয়োগ দিনের পর দিন স্থগিত রয়েছে। এসব নিয়োগের মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। সরকারের মন্ত্রী ও দলীয় এমপিদের পছন্দের লোকের চাকরি না হওয়ায় পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। পানিসম্পদমন্ত্রী তো আরো একধাপ এগিয়ে রয়েছেন। তিনি তো ঠাকুরগাঁওয়ে ঘোষণাই দিয়েছিলেন_ছাত্রলীগের নেতাদের আগে চাকরি হবে, পরে অন্যদের। দলীয় লোকজনদের চাকরি দেওয়ার এ চিত্র সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে।
প্রশাসনের অদক্ষতার কারণেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের বেহাল। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, মন্ত্রণালয়-বিভাগ পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ১১৬টি প্রকল্প শুরু করে সরকার। এরই মধ্যে ৬৪ শতাংশ প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রকল্পব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণ। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ২১টি প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় সরকারের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। এসব প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে কর্মকর্তাদের অদক্ষতাও বড় কারণ।
প্রশাসনে সামান্য আশার খবরও রয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর ঘটনায় প্রশাসনে খুশির আমেজ বইছে। তবে এর একটি বিরোধী গ্রুপও রয়েছে। চাকরিতে মধ্য সারির কর্মকর্তারা এটা মানতে চাননি। তাঁদের যুক্তি হলো এতে পদোন্নতি আটকে যাবে এবং নতুন চাকরির পথ রুদ্ধ হবে। শেষ পর্যন্ত চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। পদ না থাকার পরও মধ্য সারির কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে শূন্য পদ পূরণে উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন না হলেও সরকার আইনটির খসড়া প্রণয়ন করে ওয়েবসাইটে দিয়ে একধাপ এগিয়েছে। যদিও পরবর্তীতে আইনটি প্রণয়নে সরকারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। প্রশাসনের জুনিয়র ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের মতবিরোধে আইনের খসড়া নিয়ে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না বলে জানা গেছে। খসড়া আইনে উপসচিবসহ তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতির জন্য লিখিত পরীক্ষার বিধান রাখা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সিনিয়র কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে ধাপে ধাপে সচিব হয়েছেন। তাঁরা কোনো স্তরের পদোন্নতির জন্য লিখিত পরীক্ষায় বসেননি। এখন তাঁরা আইনের খসড়া করেছেন। সেখানে আমাদের পদোন্নতির জন্য লিখিত পরীক্ষায় বসার সুপারিশ রয়েছে। নিজেরা লিখিত পরীক্ষা না দিয়ে সচিব হয়েছেন। আর আমাদের লিখিত পরীক্ষা ছাড়া পদোন্নতি হবে না_এটা হতে পারে না।'
আগের দুই বছরের মতো ২০১১ সালেও সরকারের বিভিন্ন অফিসে রেকর্ডসংখ্যক কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে তিন শতাধিক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন সচিবসহ মূল পদে দায়িত্ব পালন করছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত কর্মকর্তারা। বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতো সামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তারাও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন। শুধু সাবেক সামরিক কর্মকর্তারাই নয়, প্রশাসনে বর্তমান সামরিক কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তিও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিভিন্ন সরকারি সংস্থা যেমন বিটিএমসি, বিআরটিসি, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রকল্পে তাঁদের ব্যাপক হারে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুযোগ কমছে।
এই সরকারের তিন বছরে প্রশাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যেসব বিষয় তাদের মধ্যে অন্যতম হলো_পাবনা জেলা প্রশাসনের ঘটনা। স্থানীয় এমপির নেতৃত্ব ছাত্রলীগ নেতাদের তাণ্ডব যেভাবে সমাধান দেওয়া হয়েছে, তা যথাযথ নয় বলে প্রশাসনে ক্ষোভ রয়েছে। বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ করে দুর্নীতির সুযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া পিএসসির নানা আইনকানুন সংস্কার করা হয়েছে। এখন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পদ খালি না থাকার জন্য কাউকে শূন্য হাতে ফিরে যেতে হয় না। এ ক্ষেত্রে ক্যাডার সার্ভিসের জন্য নির্ধারিত শূন্য পদ পূরণের পর মেধাক্রম অনুসারে নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণী গেজেটেড শূন্য পদে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
২০১১ সালের শুরুতেই হাইকোর্টের এক রায় পুরো প্রশাসনকে নাড়িয়ে দেয়। 'ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স' অবৈধ ঘোষণা করে তিন বাহিনী প্রধান ও সচিবদের ওপরে জেলা জজদের পদমর্যাদা দেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ রায় নিয়ে প্রশাসনে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। সরকার আপিল করলে রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। বর্তমানে বিষয়টি উচ্চ আদালতের বিবেচনায় রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.