যোগাযোগ-বড় ব্যর্থতায় ছোট অর্জন ম্লান by পার্থ সারথি দাস
মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে যোগাযোগ খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু প্রকল্প। সরকারের তিন বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুললে গত সেপ্টেম্বর থেকেই প্রকল্প অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রকল্পটি এই সরকারের সময়ে বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শুধু পদ্মা সেতু নয়, মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পে তিন বছরে কাজ হয়েছে
মাত্র আট শতাংশ। তবে এরই মধ্যে অর্থ ব্যয় হয়েছে ১৬ শতাংশ। সরকারের বাকি সময়ের মধ্যে ৯২ শতাংশ কাজ কোনোভাবেই শেষ করা সম্ভব হবে না। এভাবেই যোগাযোগ খাতে একের পর ছোট-বড় প্রায় ২০০ প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছেই। ট্রানজিটের অবকাঠামো নির্মাণে তোড়জোড় দেখা গেলেও দেশের সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ছিল নিষ্ক্রিয়। এ অবস্থায় ২০১১ সালের আগস্ট মাসে দেখা দেয় মহাসড়কে বিপর্যয়ও। এ কারণে সরকারের ভাবমূর্তি খানিকটা হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে।
তবে বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই সরকারই রেলকে নিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করেছে। শুধু তা-ই নয়, রেলে গতি আনতে সবচেয়ে বেশি প্রকল্প গ্রহণ করেছে এ সরকারই। কিন্তু প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও প্রতিশ্রুত বৈদেশিক অর্থের অভাবে রেলের ২০ প্রকল্পই ঝুলে আছে। সরকার সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব না দিয়ে ট্রানজিটের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সময়ক্ষেপণ করলেও বাস্তবে ট্রানজিট উপযোগী প্রকল্পও থমকে আছে। প্রধানমন্ত্রী আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিলেও তিন বছরেও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত রেলের ১২টি প্রকল্পও অগ্রগতিহীন। দুর্নীতির অভিযোগে সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ওবায়দুল কাদেরকে নতুন মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন মন্ত্রী কোন কোন প্রকল্প শেষ করা যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না।
তিন বছরে যোগাযোগ খাতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, ইউএনএসকাপের সাবেক পরিচালক ও বর্তমানে সিপিডির সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো ড. এম রহমতুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, এই সরকারের অনেক শুভ উদ্যোগ ছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও সময়ক্ষেপণে অর্জন ইতিবাচক হয়নি। একসঙ্গে অনেক কাজে হাত দিয়ে সাফল্য আনা সম্ভব হয়নি যোগাযোগ খাতে। এই সরকারই অবহেলিত রেলের ওপর নজর দিয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পে ঠিকাদাররা কাজ করেননি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় তদারকি করেনি সময়মতো। এ অবস্থায় আমি বলব, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই কাজ করে সাফল্য অর্জন করতে হবে।
স্থবির ১০০ কোটি ডলার ঋণের ২০ প্রকল্প : ভারতের ১০০ কোটি ডলার ঋণে সড়ক ও রেলের ২০টি প্রকল্প আছে। এর মধ্যে রেলের প্রকল্প আছে ১২টি। ২০১০ সালে ঋণচুক্তির পর একটি প্রকল্পেরও বাস্তব অগ্রগতি নেই। এর মধ্যে সড়ক খাতের চারটি প্রকল্পও ভেস্তে যেতে বসেছে। এ চার প্রকল্প হলো_সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সুলতানপুর-চিনইর-আখাউড়া-সেনারবাদী স্থলবন্দর সড়ক জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করা, জুরাইন রেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ, রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর সংযোগ সড়ক ও লালমনিরহাট-বুড়িমারী সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ দিয়ে সওজের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার পরিকল্পনা চলছে।
তিন বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে পাঁচ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবু অর্থাভাব ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতায় ১৫২টি প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ৯টি প্রকল্পও রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন, জরুরি সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পও রয়েছে। এসব প্রকল্পে আশানুরূপ অগ্রগতি নেই। তবু জেলা পর্যায়ের ৮৩ প্রকল্প থেকে ২২৩ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে।
৫০০ কোটি টাকার লোকসান নিয়ে চলছে রেল : তিন বছরে সরকার রেলওয়ের লোকসান কমাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমানে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার লোকসান নিয়ে চলছে রেল। বর্তমান সরকার তিন বছরে রেলওয়ের উন্নয়নে একের পর এক ২৮ প্রকল্প ও আগে অনুমোদিত প্রকল্পসহ ৪৬ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু জনবল সংকট, যাত্রীসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, নিরাপত্তাব্যবস্থার বেহাল কাটাতে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। গ্রহণ করা প্রকল্পগুলোয় প্রয়োজনীয় বরাদ্দও নেই। এ কারণে রেলওয়ে দাঁড়াতে পারছে না স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে।
সরকারের তিন বছরে প্রায় ১৩ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৮টি নতুন প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে রেলের।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত ১১টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে এবং ৯টি রুটের ট্রেন সার্ভিস বর্ধিত করা হয়েছে। সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে রেলওয়ের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। সরকারের তিন বছরে ১৩টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-জয়দেবপুর মিটারগেজ সেকশনকে দ্বৈতগেজে রূপান্তর প্রকল্পও আছে।
বর্তমান সরকারের সময়ে তারাকান্দি থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব পর্যন্ত রেলওয়ে সংযোগ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় নতুন ৩৫ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। রেলওয়ের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নতুন ১২৮ কিলোমিটার মিটারগেজ ও ১৯৩ কিলোমিটার ব্রডগেজসহ মোট ৩২১ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া ১৭২ কিলোমিটার বন্ধ সেকশন আবার চালু করা হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সেকশনটি সম্পূর্ণ ডাবল লাইনে উন্নীত করার লক্ষ্যে টঙ্গী-ভৈরববাজার, লাকসাম-চিনকি আস্তানা ও আখাউড়া-লাকসাম সেকশনে ডাবল লাইন নির্মাণ এবং দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
কিছু সাফল্য : বর্তমান সরকারের সময়ে এসে শেষ হয়েছে কিছু সেতু ও সড়ক প্রকল্প। এরপর এগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে যানচলাচলের জন্য। এর মধ্যে আছে বরিশাল-পটুয়াখালী সড়কে আবদুর রব সেরনিয়াবাত সেতু (দপদপিয়া সেতু), জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর হয়ে ঢাকা বাইপাস সড়ক, ঢাকার বসিলায় শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু, টঙ্গী-কালিগঞ্জ-ঘোড়াশাল-পাঁচদোনা সড়কে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু, শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর সুলতানা কামাল সেতু, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর শাহ আমানত সেতু ও ভোগাই সেতু। শুরু হতে যাচ্ছে মাদারীপুরের কাজিরটেকে আড়িয়ালখাঁ নদের ওপর সপ্তম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু ও পটুয়াখালী জেলায় লেবুখালী সেতুর কাজ।
রূপগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা, শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর আরো একটি সেতু নির্মাণের জন্য গত ৯ অক্টোবর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। শরীয়তপুর-মাদারীপুর, ফরিদপুর-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা, জয়দেবপুর-চন্দ্রা-হাতিকামরুল, ঢাকা-মাওয়া সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার জন্য প্রকল্পও গ্রহণ করেছে সরকার। সরকার এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক, নবীনগর-চন্দ্রা, রংপুর বিভাগীয় শহরের সড়ক, চট্টগ্রামের অঙ্েিজন মোড়-হাটহাজারী অংশ প্রশস্তকরণ ও গাবতলী-সোয়ারীঘাট-বাদামতলী সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে উদ্যোগ নিচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ছয় লেন এঙ্প্রেসওয়ে নির্মাণে এখন পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।
রাজধানীর যানজট নিরসনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে মিরপুর ১২ থেকে জিয়া কলোনি পর্যন্ত উড়াল সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। মিরপুর ১২ নম্বর থেকে বিমানবন্দর সড়কের জিয়া কলোনি পর্যন্ত ফ্লাইওভার এবং বনানী লেভেল ক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্পটি ৬ এপ্রিল ২০১০ সালে অনুমোদন লাভ করে। এক হাজার ৮৭৪ মিটার দীর্ঘ এবং ১৫ দশমিক ৫২ মিটার প্রশস্ত এই ফ্লাইওভারে থাকছে ছয়টি সংযোগ সড়ক বা র্যাম্প। উড়াল সেতু ও ওভারপাসকে সংযুক্ত করবে প্রায় ৮০০ মিটার দীর্ঘ সংযোগ সেতু। চলতি বছরের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা।
No comments