দিনবদল-চুপসে যাচ্ছে প্রত্যাশার বেলুন by আহমেদ দীপু ও পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য
মহাজোট সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশার বেলুন ক্রমেই চুপসে যাচ্ছে। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম বর্ষপূর্তির আগে থেকেই বেলুনের বাতাস বেরোতে থাকে। তিন বছরের মাথায় এসে সেই প্রত্যাশা হতাশায় পরিণত হয়েছে। খোদ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাই নির্বাচনী ইশতেহার শতভাগ বাস্তবায়নের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। 'ভোট ও ভাতের অধিকার, দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার' শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহার 'দিনবদলের সনদ'-এর মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের তিন বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং প্রত্যাশা নিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে মহাজোট।
বিপুল সম্ভাবনা, জনসমর্থন ও প্রত্যাশা নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন মহাজোট সরকার গত তিন বছরে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে সামান্যই। ফলে তিন বছরের শাসনামলে জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে তৈরি হয়েছে বিশাল ব্যবধান, যা আগামী দুই বছরে কমানো প্রায় অসম্ভব।
'সংকটের আবর্তে ডুবে থাকা দেশকে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে একটি উন্নত, সুখী-সুন্দর জীবন গড়ে তোলাই হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একমাত্র ব্রত'_এই বাক্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের কর্মসূচি, অঙ্গীকার ও ঘোষণা শুরু হলেও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে সরকার গত তিন বছরে সেই ব্রতের কাছাকাছিও যেতে পারেনি।
দিনবদলের স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও দিনবদল কতটা হয়েছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় অ্যানালগ সংস্কৃতিতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলা হলেও কার্যকর হয়নি সংসদ। একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতির চাকা। নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতায় কোনো সংযম নেই, সহনশীলতার অভাব সর্বত্র। বিরোধী দলের সদস্যদের ওপর পুলিশের মারমুখী আচরণ, বিরোধী দলের রাজনৈতিক কার্যালয় অবরুদ্ধ রেখে সরকার নিজেই তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চলেছে। মহাজোটও যে মিলেমিশে থাকবে তা নয়। সেখানেও দ্বন্দ্ব, মতবিরোধ। সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনগুলো প্রায় তিন বছর ধরেই সারা দেশে দাপিয়ে বেড়িয়েছে।
এ ধরনের কাজে পিছিয়ে ছিলেন না সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও কেউ কেউ। সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্প পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে শুধু একজন নীতিনির্ধারকের সর্বগ্রাসী মনোভাবের কারণে। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, প্রতিবেশী ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ব্যর্থতা, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ধীরগতি, আইন লঙ্ঘন করে দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, জেলা পরিষদে দলীয় লোক নিয়োগ, সারা দেশের রাস্তাঘাটের বেহাল_এসব বিতর্ক নিয়েই কেটেছে সরকারের তৃতীয় বছর। তিন বছরে আওয়ামী লীগের 'একলা চলো' নীতি নিয়ে সমালোচনামুখর ছিল খোদ ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দলগুলো। সরকারের সিদ্ধান্তে তাদের মতামত গ্রহণে অনিচ্ছা, আলোচনা না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষুব্ধ মহাজোটের শরিকরা। উলি্লখিত সময়ের মধ্যে দু-একটি খাতে সরকারের সাফল্য যে নেই তা বলা যাবে না। যেমন শিক্ষা, বিদ্যুৎ, কৃষি, পাট, খাদ্য, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড প্রশংসারও দাবি রাখে। কয়েকটি খাত রয়েছে, যেখানে তেমন উল্লেখ করার মতো কাজ না হলেও দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়নি। এগুলোকে যদি সাফল্য হিসেবে ধরা হয় তাহলে তা শুধু ম্লানই নয়, এ ধরনের ছোটখাটো সাফল্যকে গ্রাস করেছে শেয়ার কেলেঙ্কারি। গত মেয়াদে ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও শেয়ার কেলেঙ্কারি হয়েছিল। কিন্তু সে সময় কেলেঙ্কারির হোতাদের বিচার হয়নি। এবার ক্ষমতায় আসার পর আবারও সেই শেয়ারবাজারেই বিপর্যয়। বর্তমান সরকার গত মেয়াদের অভিজ্ঞতা থেকে শেয়ারবাজারের বিষয়ে শিক্ষা নিয়েছে এমনটা ধরে নিয়ে সাধারণ গৃহবধূ থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের আমলারা পর্যন্ত এবার শেয়ারবাজারে তাঁদের সঞ্চয় বিনিয়োগ করেন। কিন্তু সরকার সচেতন না থাকায় সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কারসাজিবাজরা। এর দায়দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। অন্যান্য খাতে পরিস্থিতি সামাল দিলেও শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি ভালো করতে না পারলে ভবিষ্যতে সরকারের খুব বেশি ভালো হবে বলে কেউ মনে করছেন না।
নির্বাচনী ইশতেহারের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন না হলেও সরকারের সাফল্য তুলে ধরতে এখন সরকার ও দলে চলছে সর্বশেষ প্রস্তুতি। আজ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরবেন তাঁর সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের ফিরিস্তি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার শেরাটন হোটেলে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে 'দিনবদলের সনদ' নামে ২৪ পৃষ্ঠার একটি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই ঘোষিত ১৪ দলের ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি এবং ২২ নভেম্বর গৃহীত ২৩ দফা অভিন্ন নূ্যনতম কর্মসূচির আলোকে এবং বিগত সাত বছরের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে এই কর্মসূচি (ইশতেহার) প্রণীত হয়েছে। ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং বিশ্বমন্দার মোকাবিলায় সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, দারিদ্র্য ঘোচাও, বৈষম্য রোখো এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছিল ইশতেহারের অগ্রাধিকার পাওয়া পাঁচটি খাত।
কিন্তু বাস্তবে সন্ত্রাস, দুর্নীতি রয়েছে আগের চেহারায়, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ দিশাহারা। দেশের অর্থনীতির রুগ্ণ দশা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সরকারের তিন বছরের মাথায়। বর্তমান সরকারকে সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ আখ্যায়িত করে ইতিমধ্যে একাধিকবার সরকারের পদত্যাগের দাবি উঠেছে বিরোধী দলের মুখ থেকে। উপরন্তু বছরজুড়ে সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিল মহাজোটের শরিক দলগুলো।
নির্বাচনী ইশতেহারের স্থানীয় সরকার কর্মসূচিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদকে শক্তিশালী করার কথা থাকলেও সরকারের কর্মকাণ্ডে তা প্রতীয়মান হয়নি। উপজেলা পরিষদের বর্তমান আইনে উপজেলা চেয়ারম্যানদের সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। বছরের শেষভাগে দলের নেতাদের জেলা পরিষদে নিয়োগ দিয়ে বিরোধী দল এবং মহাজোটের শরিকদের কাছ থেকে সমালোচনা শুনতে হয়েছে মহাজোট প্রধান আওয়ামী লীগকে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠা অধ্যায়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার অঙ্গীকার থাকলেও সরকারের তিন বছর মেয়াদে তা বন্ধ হয়নি। বরং সরকারের অনেক মন্ত্রী তাঁদের মন্তব্যে এটাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার পাশাপাশি তিন বছরের মাথায় যোগ হয়েছে গুপ্তহত্যা। এ ব্যাপারেও সরকারের তরফ থেকে শুধু বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানো ছাড়া সঠিক তদন্ত করে উদ্ঘাটন করা হয়নি সত্য রহস্যের।
নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ ও পানিসম্পদ রক্ষায় কার্যকর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও সরকার নিজের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিলেও তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে কার্যকর সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি ভারতের সঙ্গে। বাংলাদেশের প্রাপ্যতা, হিস্যা ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান পানি সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ একটি সমন্বিত পানিনীতি প্রণয়ন এবং আঞ্চলিক পানি নিরাপত্তা গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগ উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিলেও এ বিষয়ে তিন বছরে সরকারের কোনো উদ্যোগই ফলপ্রসূ হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি ইনকিউবেটর এবং কম্পিউটার ভিলেজ স্থাপন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি গত তিন বছরে।
'সংকটের আবর্তে ডুবে থাকা দেশকে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে একটি উন্নত, সুখী-সুন্দর জীবন গড়ে তোলাই হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একমাত্র ব্রত'_এই বাক্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের কর্মসূচি, অঙ্গীকার ও ঘোষণা শুরু হলেও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে সরকার গত তিন বছরে সেই ব্রতের কাছাকাছিও যেতে পারেনি।
দিনবদলের স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও দিনবদল কতটা হয়েছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় অ্যানালগ সংস্কৃতিতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলা হলেও কার্যকর হয়নি সংসদ। একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতির চাকা। নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতায় কোনো সংযম নেই, সহনশীলতার অভাব সর্বত্র। বিরোধী দলের সদস্যদের ওপর পুলিশের মারমুখী আচরণ, বিরোধী দলের রাজনৈতিক কার্যালয় অবরুদ্ধ রেখে সরকার নিজেই তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চলেছে। মহাজোটও যে মিলেমিশে থাকবে তা নয়। সেখানেও দ্বন্দ্ব, মতবিরোধ। সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনগুলো প্রায় তিন বছর ধরেই সারা দেশে দাপিয়ে বেড়িয়েছে।
এ ধরনের কাজে পিছিয়ে ছিলেন না সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও কেউ কেউ। সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্প পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে শুধু একজন নীতিনির্ধারকের সর্বগ্রাসী মনোভাবের কারণে। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, প্রতিবেশী ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ব্যর্থতা, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ধীরগতি, আইন লঙ্ঘন করে দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, জেলা পরিষদে দলীয় লোক নিয়োগ, সারা দেশের রাস্তাঘাটের বেহাল_এসব বিতর্ক নিয়েই কেটেছে সরকারের তৃতীয় বছর। তিন বছরে আওয়ামী লীগের 'একলা চলো' নীতি নিয়ে সমালোচনামুখর ছিল খোদ ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দলগুলো। সরকারের সিদ্ধান্তে তাদের মতামত গ্রহণে অনিচ্ছা, আলোচনা না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষুব্ধ মহাজোটের শরিকরা। উলি্লখিত সময়ের মধ্যে দু-একটি খাতে সরকারের সাফল্য যে নেই তা বলা যাবে না। যেমন শিক্ষা, বিদ্যুৎ, কৃষি, পাট, খাদ্য, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড প্রশংসারও দাবি রাখে। কয়েকটি খাত রয়েছে, যেখানে তেমন উল্লেখ করার মতো কাজ না হলেও দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়নি। এগুলোকে যদি সাফল্য হিসেবে ধরা হয় তাহলে তা শুধু ম্লানই নয়, এ ধরনের ছোটখাটো সাফল্যকে গ্রাস করেছে শেয়ার কেলেঙ্কারি। গত মেয়াদে ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও শেয়ার কেলেঙ্কারি হয়েছিল। কিন্তু সে সময় কেলেঙ্কারির হোতাদের বিচার হয়নি। এবার ক্ষমতায় আসার পর আবারও সেই শেয়ারবাজারেই বিপর্যয়। বর্তমান সরকার গত মেয়াদের অভিজ্ঞতা থেকে শেয়ারবাজারের বিষয়ে শিক্ষা নিয়েছে এমনটা ধরে নিয়ে সাধারণ গৃহবধূ থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের আমলারা পর্যন্ত এবার শেয়ারবাজারে তাঁদের সঞ্চয় বিনিয়োগ করেন। কিন্তু সরকার সচেতন না থাকায় সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কারসাজিবাজরা। এর দায়দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। অন্যান্য খাতে পরিস্থিতি সামাল দিলেও শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি ভালো করতে না পারলে ভবিষ্যতে সরকারের খুব বেশি ভালো হবে বলে কেউ মনে করছেন না।
নির্বাচনী ইশতেহারের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন না হলেও সরকারের সাফল্য তুলে ধরতে এখন সরকার ও দলে চলছে সর্বশেষ প্রস্তুতি। আজ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরবেন তাঁর সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের ফিরিস্তি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার শেরাটন হোটেলে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে 'দিনবদলের সনদ' নামে ২৪ পৃষ্ঠার একটি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই ঘোষিত ১৪ দলের ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি এবং ২২ নভেম্বর গৃহীত ২৩ দফা অভিন্ন নূ্যনতম কর্মসূচির আলোকে এবং বিগত সাত বছরের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে এই কর্মসূচি (ইশতেহার) প্রণীত হয়েছে। ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং বিশ্বমন্দার মোকাবিলায় সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, দারিদ্র্য ঘোচাও, বৈষম্য রোখো এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছিল ইশতেহারের অগ্রাধিকার পাওয়া পাঁচটি খাত।
কিন্তু বাস্তবে সন্ত্রাস, দুর্নীতি রয়েছে আগের চেহারায়, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ দিশাহারা। দেশের অর্থনীতির রুগ্ণ দশা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সরকারের তিন বছরের মাথায়। বর্তমান সরকারকে সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ আখ্যায়িত করে ইতিমধ্যে একাধিকবার সরকারের পদত্যাগের দাবি উঠেছে বিরোধী দলের মুখ থেকে। উপরন্তু বছরজুড়ে সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিল মহাজোটের শরিক দলগুলো।
নির্বাচনী ইশতেহারের স্থানীয় সরকার কর্মসূচিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদকে শক্তিশালী করার কথা থাকলেও সরকারের কর্মকাণ্ডে তা প্রতীয়মান হয়নি। উপজেলা পরিষদের বর্তমান আইনে উপজেলা চেয়ারম্যানদের সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। বছরের শেষভাগে দলের নেতাদের জেলা পরিষদে নিয়োগ দিয়ে বিরোধী দল এবং মহাজোটের শরিকদের কাছ থেকে সমালোচনা শুনতে হয়েছে মহাজোট প্রধান আওয়ামী লীগকে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠা অধ্যায়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার অঙ্গীকার থাকলেও সরকারের তিন বছর মেয়াদে তা বন্ধ হয়নি। বরং সরকারের অনেক মন্ত্রী তাঁদের মন্তব্যে এটাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার পাশাপাশি তিন বছরের মাথায় যোগ হয়েছে গুপ্তহত্যা। এ ব্যাপারেও সরকারের তরফ থেকে শুধু বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানো ছাড়া সঠিক তদন্ত করে উদ্ঘাটন করা হয়নি সত্য রহস্যের।
নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ ও পানিসম্পদ রক্ষায় কার্যকর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও সরকার নিজের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিলেও তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে কার্যকর সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি ভারতের সঙ্গে। বাংলাদেশের প্রাপ্যতা, হিস্যা ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান পানি সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ একটি সমন্বিত পানিনীতি প্রণয়ন এবং আঞ্চলিক পানি নিরাপত্তা গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগ উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিলেও এ বিষয়ে তিন বছরে সরকারের কোনো উদ্যোগই ফলপ্রসূ হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি ইনকিউবেটর এবং কম্পিউটার ভিলেজ স্থাপন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি গত তিন বছরে।
No comments