প্রতিক্রিয়া-‘জরুরি টিপাইমুখে কীটপতঙ্গের দাঙ্গা’ by নাহরীন আই খান

বাঙালি আত্মঘাতী জাতি কি না জানি না, তবে তার রসবোধ প্রবল, তার প্রমাণ পেলাম ২৯ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে জনাব মহিউদ্দিন আহমদ সাহেবের লেখা পড়ে। ওনার রসবোধসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক (!) লেখাটির একটা উত্তর দিতে চাই।
আপনি বলেছেন, এই বাঁধ ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। কিন্তু জানেন কি, এই বাঁধের লোড ফ্যাক্টর ২৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যার অর্থ হলো সারা বছর বাঁধের সর্বোচ্চ ক্ষমতার (১৫০০ মেগাওয়াট) মাত্র ২৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ


বা ৪০১ দশমিক ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। সারা বছর ১২ শতাংশ বিনা মূল্যের বিদ্যুৎ যদি উত্তরাঞ্চলের অস্থিতিশীল জনগোষ্ঠীকে শান্ত অথবা সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সামরিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হয়, তবে সেটাই কি ভারতের জন্য লাভজনক হবে না? আর যেখানে নিজেদের চাহিদাই পূরণ করতে পারবে না, ভারত সেখানে আমাদের ‘সমতাভিত্তিক অংশীদারি’ প্রসঙ্গটাই কি হাস্যকর নয়?
৩. আপনার রিভার-মরফোলজিক্যাল বর্ণনায় বুঝতে পারলাম না, নদীর গতিপথের বর্ণনা দিয়ে কী বোঝাতে চাইছেন। না বুঝে যা বুঝলাম তা হলো, যেটুকু পানি এই বরাক অববাহিকা দিয়ে আসে তা আমাদের পানি, আর আমাদের পানির এই প্রাকৃতিক প্রবাহের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা, তাই না? আপনার সূত্রহীন উপাত্তের উৎস হচ্ছে ফ্লাড অ্যাকশন প্লানের (FAP) রিপোর্ট। নব্বইয়ের দশকের এই ফ্যাপ রিপোর্টগুলো ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। ড. আইনুন নিশাত, যিনি সরাসরি এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তিনি স্বীকার করেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই এই রিপোর্টের তথ্য/ফলাফল ধারণাপ্রসূত; যা কিনা জনাব মহিউদ্দিন ব্যতীত সবারই জানা। এ রকম একটা বিতর্কিত রিপোর্টকে ভিত্তি করে সব গবেষক, সুশীল সমাজ বা আপামর জাতিকে পঙ্গপাল বলাটা কতটা যৌক্তিক, তা বুঝলাম না। আর এই রিপোর্টকে যদি বিবেচনায় আনিও, তাহলে ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান ৬ (FAP6)-এর ১৯৯২-৯৪ সালের গবেষণায় এই বাঁধ ভেঙে গেলে কীভাবে/কী পরিমাণ বা কতটা সময়ের মধ্যে পানি আমাদের এখানে প্রবেশ করবে, তার একটি হিসাব দেখানো হয়; যা আমি পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম।
সাধারণত বন্যার পানি ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার গতিবেগে প্রবাহিত হয়, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার বেগেও প্রবাহিত হতে দেখা যায়। গবেষণায় ১০ কিলোমিটার গতিবেগের হিসাবে বাঁধ থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের পার্বত্য উপত্যকা, ১৪০ কিলোমিটার দূরের শিলচর এবং ২০০ কিলোমিটার দূরের অমলশিদ এলাকায় (অমলশিদ হলো আসাম-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। এখানে বরাক দুই ভাগ হয়ে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবেশ করে) পানি পৌঁছার সময়ের একটা হিসাব কষা হয়। দেখা যায়, বাঁধ থেকে পানি অমলশিদ পৌঁছাতে পৌঁছাতে স্রোতের বেগ কমে এলেও ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে বাঁধের পানি মোটামুটি পাঁচ মিটার উচ্চতা নিয়ে হাজির হবে এবং ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পানি তার সর্বোচ্চ উচ্চতা ২৫ মিটারের পৌঁছাবে, যা প্লাবনভূমির উচ্চতার চেয়ে আট মিটার বেশি উঁচু। ফলে প্লাবনভূমিকে আট মিটার পানির নিচে তলিয়ে রাখবে ১০ দিন বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে! এখন আপনার উল্লিখিত গবেষণার এই দিকটি কেন এড়িয়ে গেলেন? আপনি বলেছেন ‘ভূমিকম্পের জুজুর ভয়’। বাঁধের কারণে সংঘটিত সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পটি ১৯৬৭ সালে কোথায় হয়েছিল? বরাক অববাহিকায় ২০০ বছরে ৫ মাত্রা কয়টি বা গত ১৫০ বছরের টিপাইমুখের ১০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ৭+ মাত্রার কয়টি ভূমিকম্প হয়েছে, দয়া করে জেনে নেবেন।
৪. আপনি নিশ্চয়ই বোঝেন ইকো সিস্টেমের স্বতন্ত্রতা। হাওর এলাকার ভূমিরূপ, ফসল ফলানোর সময়-অসময় সম্পূর্ণভাবে এই প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি ইকো সিস্টেমের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্যটি থেকে ভিন্ন। আপনি যে পানি বাড়া-কমার হিসাব দেখাচ্ছেন, তা ওই বিতর্কিত ফ্যাপ রিপোর্টের, যা কিনা এক যুগের বেশি সময়ের পুরোনো। আপনি জানেন আশা করি, টিপাইমুখের পুরো জলাধার ভরাট হতে লাগবে ১৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি, যার আট বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি থাকবে pondage বা dead storage-এ, যা বাঁধের পেছনে জমা রাখা হয় (টারবাইনের ঘূর্ণন সচল রাখার জন্য)। জলাধার পুরো ভরে গেলে ভারত অবশ্যই পানি ছাড়বে। কিন্তু বাংলাদেশ এমনকি ভারতের কেউ কি জানেন, কী পরিমাণ পানি প্রতিদিন ছাড়া হবে? ভারত কি এই water release schedule বাংলাদেশের সঙ্গে মিলেমিশে করবে?
৫. কো-ফাইন্যান্সিংয়ের কথা বলছেন? যারা কিনা ২২ অক্টোবর ২০১১ আমাদের না জানিয়ে একটি আন্তর্জাতিক নদীর বাঁধের চুক্তি করল, তাদের সঙ্গে! এ কেমন ‘যৌথ’তা? গঙ্গা চুক্তির অনুচ্ছেদ ৯-এর এই চরম লঙ্ঘন দেখে আমরা পতঙ্গরা আতঙ্কিত হই। কীভাবে এত বলিষ্ঠভাবে বলছেন বাংলাদেশের লাভের কথা? ডিসেম্বর ৩, ২০১১এ ভারত সরকার তার পরিবেশছাড়পত্র জারি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে তো কোনো পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (EPA) হয়নি। সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিকভাবে ‘বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না’—এই আশ্বাস দিয়ে ভারত ৪০ মিলিয়ন হাওরবাসীর জীবনকে যে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন, তাকে কেন যে আপনি বা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবৈজ্ঞানিক ভাবছেন না, তা বুঝলাম না!
৬. ভারত শুধু টিপাইমুখেই নয়, বরাকের ওপর আরও চারটি, ব্রহ্মপুত্রের ওপর ১২টি ড্যাম নির্মাণ করবে এবং আমাদের ন্যায্য পানি বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই বাইপাস করে গঙ্গা, মহানদী হয়ে ভারতের অন্যান্য জায়গায় প্রবাহিত করার মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। তখন শুধু মেঘনাই নয়, ব্রহ্মপুত্রও অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের water management-এর অধ্যাপক বিজয় পারাঞ্জেপি এই মেগা প্রজেক্ট পর্যালোচনা করে বলেন, ‘হ্যাঁ, আপনারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, কারণ আপনারা উচ্ছেদ হবেন না। আপনারা বন্যায় ভেসেও যাবেন না, সত্যি। কিন্তু আপনারা শুকিয়ে যাবেন। কারণ, ব্রহ্মপুত্রের বাড়তি সব পানি বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে।’ (পাঠক, সময় পেলে লিংকটি দেখুন): http://www.facebook.com/photo.php?v=2166037388845)। মহিউদ্দিন সাহেব, বিজয় পারাঞ্জেপি কি পতঙ্গ, তিনি কি আমাদের মতো দাঙ্গাপ্রিয় জনতা, বলবেন কি?
সংযুক্তি: ১৯৬৭ ভারতের মহারাষ্ট্রে কোয়েনা বাঁধের কারণে (৬ দশমিক ৩ মাত্রার) ভূমিকম্প তার কেন্দ্র থেকে ২৩০ কিলোমিটার দূরেও তীব্র আঘাত হেনেছিল। বরাক অববাহিকার অসংখ্য fault line-এর জন্য সমগ্র এলাকায় গত ২০০ বছরে ৫ মাত্রা বা তারও বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে ১০০টিরও বেশি। গত ১৫০ বছরের টিপাইমুখের ১০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ২টি ৭+ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, যার মধ্যে ১৯৫৭ সালের ভূমিকম্পটি ছিল প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ থেকে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার দূরে।
নাহরীন আই খান: জার্মানিতে অধ্যয়নরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.