বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
২৭৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।মো. আজাদ আলী, বীর প্রতীক সহযোদ্ধার ভুলে কবজি উড়ে গেল তাঁর রাতে মো. আজাদ আলীর নেতৃত্বে গোপন শিবির থেকে বেরিয়ে পড়লেন একদল মুক্তিযোদ্ধা। অন্ধকারে হেঁটে পৌঁছালেন রেললাইনের ধারে। সেখানে তাঁরা রেললাইনে বিস্ফোরক লাগাতে থাকলেন। কাজ শেষ হতে কিছু বাকি। এমন সময় হঠাৎ দূরে দেখা গেল ট্রেন ইঞ্জিনের আলো। ক্রমশ এগিয়ে আসছে।
দ্রুত তাঁরা আড়ালে অবস্থান নিলেন। কিন্তু ট্রেনটি অদূরে থেমে গেল। এই সুযোগে মো. আজাদ আলী সহযোদ্ধাদের নিয়ে আবার কাজ শুরু করলেন। কিন্তু এক সহযোদ্ধার ভুলে আগেই ঘটল বিস্ফোরণ। উড়ে গেল আজাদ আলীর বাঁ হাতের কবজি। তিনি টেরও পেলেন না। ঘটনাচক্রে তাঁদের অপারেশনও সফল হলো। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর নাবিরপাড়ায়।
নাটোর জেলার অন্তর্গত নাবিরপাড়া। ঈশ্বরদী-রাজশাহী রেলপথের পাশে। নাবিরপাড়ার কাছেই আবদুলপুর রেল জংশন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই রেলপথ সচল রাখার জন্য ট্রেনে নিয়মিত টহল দিত। নভেম্বর মাসে মো. আজাদ আলীর নেতৃত্বাধীন গেরিলা দলের ওপর দায়িত্ব পড়ে ওই টহল ট্রেনে অ্যাম্বুশের। তাঁরা রেকি করে স্থান নির্ধারণ করেন নাবিরপাড়া। তখন সেখানে জনবসতি ছিল না। দুই পাশে ছিল বিস্তৃত আখখেত।
সেদিন বিস্ফোরক লাইনের নিচে স্থাপনের পর তাঁরা যখন মাইনের সঙ্গে যুক্ত তার (কেব্ল) ক্যামোফ্লেজ করছিলেন তখন দূরে ট্রেন ইঞ্জিনের আলো দেখা যায়। সেই ট্রেন অদূরে আবদুলপুর রেল জংশনে এসে থেমে থাকে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মো. আজাদ আলী সহযোদ্ধাদের নিয়ে বাকি কাজ সম্পন্ন করছিলেন। কথা ছিল টহল ট্রেন অ্যাম্বুশস্থলে এলে তাঁরা বিস্ফোরণ ঘটাবেন। কিন্তু তাঁর এক সহযোদ্ধার ভুলে ছয়টি মাইন একসঙ্গে আগেই বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের পর মো. আজাদ আলী ও তাঁর সহযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে যেতে থাকেন। তখনো তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর বাঁ হাতের কবজি উড়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর ঘড়িতে সময় দেখতে গিয়ে দেখেন তাঁর হাতের কবজি নেই।
এদিকে বিস্ফোরণের শব্দ শুনে আবদুলপুরে অবস্থানরত টহল ট্রেনটি দ্রুত নাবিরপাড়ার দিকে আসার সময় মাইন বিস্ফোরণে সৃষ্ট গর্তে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি প্রচণ্ড হুড়মুড় শব্দে খাদের ভেতর উল্টে পড়ে। এতে ১৬ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য ছিল টহল ট্রেনকে অ্যাম্বুশ করে বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দেওয়ার। কিন্তু দৈব ঘটনার কারণে তা সম্ভব না হলেও অমোঘ নিয়তি সেখানে পাকিস্তানিদের ট্রেনকে নিয়ে আসে।
মো. আজাদ আলী ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শ্রেণীর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। মে মাসে ভারতে যান। জুন মাসের শেষে তাঁকে মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে চাকুলিয়ায় প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে সাত নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাবসেক্টর এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ করেন। বেশ কয়েকটি গেরিলা অপারেশন করে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি পান।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আজাদ আলীকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৩৬৬।
মো. আজাদ আলীর পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানি পৌরসভার কুশবাড়িয়া গ্রামে। বর্তমানে বসবাস করেন ঢাকার বারিধারা ডিওএইচএসে। তাঁর বাবার নাম আরজান আলী প্রামাণিক। মা রাজিয়া খাতুন। স্ত্রী আজাদ সুলতানা। তাঁদের দুই ছেলে, এক মেয়ে।
মো. আজাদ আলী বললেন, ‘বাংলাদেশের বয়স এখন ৪০। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের চেষ্টা করা দরকার। আমাদের জীবনের মূল্যবান অর্জন দেশের স্বাধীনতা। একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের বিচার হচ্ছে এটা আমাদের চরম পাওয়া।’
সূত্র: মো. আজাদ আলী বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৭।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com
নাটোর জেলার অন্তর্গত নাবিরপাড়া। ঈশ্বরদী-রাজশাহী রেলপথের পাশে। নাবিরপাড়ার কাছেই আবদুলপুর রেল জংশন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই রেলপথ সচল রাখার জন্য ট্রেনে নিয়মিত টহল দিত। নভেম্বর মাসে মো. আজাদ আলীর নেতৃত্বাধীন গেরিলা দলের ওপর দায়িত্ব পড়ে ওই টহল ট্রেনে অ্যাম্বুশের। তাঁরা রেকি করে স্থান নির্ধারণ করেন নাবিরপাড়া। তখন সেখানে জনবসতি ছিল না। দুই পাশে ছিল বিস্তৃত আখখেত।
সেদিন বিস্ফোরক লাইনের নিচে স্থাপনের পর তাঁরা যখন মাইনের সঙ্গে যুক্ত তার (কেব্ল) ক্যামোফ্লেজ করছিলেন তখন দূরে ট্রেন ইঞ্জিনের আলো দেখা যায়। সেই ট্রেন অদূরে আবদুলপুর রেল জংশনে এসে থেমে থাকে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মো. আজাদ আলী সহযোদ্ধাদের নিয়ে বাকি কাজ সম্পন্ন করছিলেন। কথা ছিল টহল ট্রেন অ্যাম্বুশস্থলে এলে তাঁরা বিস্ফোরণ ঘটাবেন। কিন্তু তাঁর এক সহযোদ্ধার ভুলে ছয়টি মাইন একসঙ্গে আগেই বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের পর মো. আজাদ আলী ও তাঁর সহযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে যেতে থাকেন। তখনো তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর বাঁ হাতের কবজি উড়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর ঘড়িতে সময় দেখতে গিয়ে দেখেন তাঁর হাতের কবজি নেই।
এদিকে বিস্ফোরণের শব্দ শুনে আবদুলপুরে অবস্থানরত টহল ট্রেনটি দ্রুত নাবিরপাড়ার দিকে আসার সময় মাইন বিস্ফোরণে সৃষ্ট গর্তে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি প্রচণ্ড হুড়মুড় শব্দে খাদের ভেতর উল্টে পড়ে। এতে ১৬ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য ছিল টহল ট্রেনকে অ্যাম্বুশ করে বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দেওয়ার। কিন্তু দৈব ঘটনার কারণে তা সম্ভব না হলেও অমোঘ নিয়তি সেখানে পাকিস্তানিদের ট্রেনকে নিয়ে আসে।
মো. আজাদ আলী ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শ্রেণীর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। মে মাসে ভারতে যান। জুন মাসের শেষে তাঁকে মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে চাকুলিয়ায় প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে সাত নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাবসেক্টর এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ করেন। বেশ কয়েকটি গেরিলা অপারেশন করে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি পান।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আজাদ আলীকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৩৬৬।
মো. আজাদ আলীর পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানি পৌরসভার কুশবাড়িয়া গ্রামে। বর্তমানে বসবাস করেন ঢাকার বারিধারা ডিওএইচএসে। তাঁর বাবার নাম আরজান আলী প্রামাণিক। মা রাজিয়া খাতুন। স্ত্রী আজাদ সুলতানা। তাঁদের দুই ছেলে, এক মেয়ে।
মো. আজাদ আলী বললেন, ‘বাংলাদেশের বয়স এখন ৪০। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের চেষ্টা করা দরকার। আমাদের জীবনের মূল্যবান অর্জন দেশের স্বাধীনতা। একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের বিচার হচ্ছে এটা আমাদের চরম পাওয়া।’
সূত্র: মো. আজাদ আলী বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৭।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com
No comments