নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের বিকল্প নেই-সরকারের তিন বছর

তিন বছর পূর্তিতে জনমনে এই ধারণাই স্পষ্ট যে অনেক বেশি কিছু অর্জনের সুযোগ সরকার হেলায় হারিয়েছে। কোনো সমাজকেই দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাসের মতো সামাজিক ব্যাধিমুক্ত বলা চলে না। দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্সের সূচকে ২০০৬-২০০৭ সালে বাংলাদেশ ‘আধা গণতন্ত্র আধা স্বৈরতান্ত্রিক’ (হাইব্রিড ডেমোক্রেসি) দেশ ছিল। কিন্তু তিন বছরের নির্বাচিত শাসনের পরও ২০১০ সালেও তা অপরিবর্তিত। প্রথম আলোর নতুন জনমত জরিপের সার্বিক ফলাফলেও ওই


‘হাইব্রিড’-ব্যবস্থাই কার্যত সমর্থিত হয়েছে। দুই নেত্রীর শাসনেই ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ (অথরটারিয়ান) মানে সর্বনিম্ন চতুর্থ ধাপ থেকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ অর্থাৎ দ্বিতীয় ধাপে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছিল। কিন্তু সেখান থেকে উত্তরণ না ঘটে পশ্চাদমুখী তৃতীয় ধাপে পতন ঘটেছে। এর মুখ্য দায় ক্ষমতাসীনদের হলেও বিরোধী দলও দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তারা পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিজেদের বন্দী রেখেছে।
তবে নাজুক হাইব্রিড-ব্যবস্থায়ও যে ভালো কিছু করা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে সাফল্য এবং কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধিই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সে কারণে বলা চলে, সরকারপ্রধান চাইলে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দিয়ে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করে ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। দুর্নীতি দমন, তথ্য, আইন ও মানবাধিকার কমিশনগুলোকে সচল ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে পারেন। এরা যে বর্তমানে খুঁড়িয়ে চলছে, সে জন্য বিএনপিকে দায়ী করা যাবে না।
সরকারের পুনরায় ক্ষমতায় আসার আকাঙ্ক্ষা দোষের নয়। কিন্তু দোষটা হলো, বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন ও হেনস্তা করার মধ্য দিয়ে নিজের দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা করা। আবার প্রধান বিরোধী দল যদি শয়নে-স্বপনে সরকারের ব্যর্থতা কামনা করে, তাহলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে বাধ্য। এই অস্থিরতার সঙ্গে গুপ্তহত্যা একটা দমবন্ধ পরিবেশ বয়ে আনছে। দায় এড়িয়ে সরকার যা করছে, তা আগুন নিয়ে খেলার শামিল।
বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে সরকার বিন্দুমাত্র ছাড় দিয়েছে, তা প্রতীয়মান হয় না। সরকার সাফল্যের সঙ্গে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে না পারা দুঃখজনক। এই বিচারকে যেমন রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে, তেমনি এর স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করতে হবে।
পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসা যেকোনো সরকারের জন্য তিন বছর কম সময় নয়। নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনেরা যেসব প্রতিশ্রুতি জনগণকে দিয়েছিল, তার অনেকাংশ অপূর্ণই রয়ে গেছে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকেও সরকার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি; বরং গেল বছরটিতে উপর্যুপরি জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, যা সরকারের অনেক সাফল্যই ম্লান করে দিয়েছে। সর্বোপরি যোগাযোগ খাতের অধোগতি সরকারকে এই বার্তাই দিয়েছে যে, যোগ্য ব্যক্তিতে যোগ্য স্থানে পদায়নের বিকল্প নেই।
রাষ্ট্রপতির সংলাপে বিরোধী দলের ইতিবাচক সাড়া সরকারের জন্য তাদের সঙ্গে একটি রফা করার সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা মনে করি, উভয় পক্ষ আন্তরিক হলে আলোচনার মাধ্যমে কেবল নির্বাচন কমিশন গঠন নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসহ সব বিতর্কের অবসান ঘটানো যেতে পারে। বিরোধী দলকে ঘায়েল না করে জনকল্যাণে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের মাধ্যমেই সরকারকে জনচিত্ত জয় করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.