ধানকেন্দ্রিক পূজা by নিসার হোসেন
কোজাগর হচ্ছে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা। এ পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ঘরে ঘরে এ পূজার আয়োজন করে। বারোয়ারি পূজারও চল রয়েছে। শরৎ ঋতুর এ পূজা ধানকেন্দ্রিক। আউশ ধানের মৌসুম শেষ। আমন ধান বোনা হয়ে গেছে। এখন কাটার অপেক্ষা। দুর্গাপূজা শেষ হয়েছে শুক্লপক্ষের দশমীতে। পূর্ণিমার রাতে লক্ষ্মীপূজা। লক্ষ্মী দেবীর গায়ের রঙ সাধারণত পাকা ধানের রঙ। এ দেবীর বাহন হিসেবে রয়েছে প্যাঁচা। এ প্রাণী পোকামাকড় ও
ইঁদুরের উৎপাত থেকে ধান রক্ষা করে। এ কারণে প্যাঁচাও সমাদৃত। বাংলাদেশের মৃৎশিল্প সমৃদ্ধ। উপযুক্ত মাটির সহজলভ্যতা সম্ভবত এর কারণ। উৎপন্ন পণ্য সহজে নানা স্থানে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য ছিল নৌপথ। গত দেড়শ' বছরে ভারতবর্ষের ঐহিত্যবাহী শিল্পকলার বিভিন্ন ধারা চিহ্নিত করে যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই বাংলার মৃৎশিল্পকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ স্থান। বাংলার বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে এবং এমনকি কিছু মসজিদেও মৃৎশিল্পীদের উন্নত দক্ষতার স্বাক্ষর আমরা দেখতে পাই। এখন অনেক সচ্ছল পরিবারে মাটির তৈরি নানা শিল্পকর্ম স্থান করে নিয়েছে। তবে যুগ যুগ ধরে উচ্চবিত্ত ও সুশিক্ষিতরা আমাদের নিজস্ব এই উচ্চমানের শিল্প ঐতিহ্যের পৃষ্ঠপোষকতা না করে নিজেদের প্রাসাদ ও বাসগৃহ সাজানোর জন্য পাশ্চাত্যের শিল্পদ্রব্যের প্রতি যে আগ্রহ দেখিয়েছেন তার জের কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না। সহজলভ্য প্লাস্টিক দ্রব্যের সঙ্গে পাল্লা দেওয়াও মৃৎশিল্পের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশে প্রতিমা নির্মাণ ও বিসর্জনের রীতিটি কিন্তু শিল্প ঐহিত্য এবং এর সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের কাজের ধারা বজায় রাখার সহায়ক। পূজা হয় নতুন মূর্তিতে। 'বারোমাসে তেরো পার্বণের' জন্য বানানো হয়ে থাকে মূর্তি। এ কারণে কাজের ধারাবাহিকতা থাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে যায় শিল্পীর প্রতিভা।
তবে তাদের প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগোতে হয়। সামাজিক প্রতিকূলতাও অনেক। শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় বরিশাল শহরে মৃৎশিল্পী সম্মাননা অনুষ্ঠানে যোগদানের সুযোগ হয়েছিল। পিরোজপুর, কলসকাঠি, রাজবাড়ী, গৈলা, মাধবপাশা প্রভৃতি এলাকা থেকে এসেছিলেন শিল্পীরা। গৈলার কুমারপাড়ায় মৃৎশিল্পীদের অনেক বাড়িতে আমি গিয়েছি। একসময় এ এলাকায় দেড়শ'র বেশি পরিবার ছিল। এখন কমে এসেছে ২৫-৩০টিতে। তাদের কাজের দক্ষতা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। নারী-পুরুষ সবাই মিলে কাজ করেন। এক তরুণী গৃহবধূকে দেখলাম, খুব কম সময়ের মধ্যে ঘটে মনসা দেবীর মূর্তি এঁকে দিলেন। লক্ষ্মীমূর্তি দেখলাম প্রায় সব ঘরে। শত শত মূর্তি। চমৎকার রঙের কাজ। পাইকারি ও খুচরা বাজারে বিক্রির জন্য তৈরি করা হয়েছে। লক্ষ্মীর পটও দেখা গেল কয়েকটি। তাতে ধানের ছড়া রয়েছে। তবে এ এলাকায় পটের কাজ হয় না। এর জন্য প্রসিদ্ধ হচ্ছে মাদারীপুর-শরীয়তপুরের একটি এলাকা। গৈলায় রয়েছে বিজয় গুপ্তের মনসা মন্দির। সেখানে প্রায় এক টন ওজনের পিতলের দেবীমূর্তি নির্মিত হয়েছে। মূর্তির সামনে রয়েছে বিজয় গুপ্ত স্থাপিত ঘট, যার বয়স পাঁচশ' বছরের বেশি। সিঁদুরের প্রলেপ পড়তে পড়তে ঘট হয়ে উঠেছে অনেক বড়। গৈলা ও বানারীপাড়ায় শিল্পীরা ঘটে মনসা দেবীর মূর্তি আঁকেন। তাদের কাজে বিজয় গুপ্তের মনসা মঙ্গলের প্রভাব রয়েছে। এ মন্দিরেও মাটির কিছু কাজ থাকবে বলে আশা।
নিসার হোসেন :অধ্যাপক, অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments